আবেগ নয় আত্মশুদ্ধিতে শাণিত হোক স্বাধীনতার চেতনা কাজী সুলতানা শিমি
আমরা জানি যে, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙ্গালির উপর অতর্কিত আক্রমণ করেছিলো। তাই ২৬শে মার্চ থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বলে ঘোষণা হয়। ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম দিন। পৃথিবীর মানচিত্রে আমাদের স্বাধীনতার ও স্বকীয়তার আত্মপ্রকাশের দিন। বাঙালির অর্জনের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার প্রথম উদ্দেশ্য ছিল ভৌগোলিক স্বাধীনতা, যা আমরা একাত্তরের ২৬শে মার্চ নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা লাভের মাধ্যমে অর্জন করেছিলাম। এ ছিল অর্জনের শুরু। অর্জনের দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার এখনো অনেক বাকি। সত্যিকার অর্থে ভৌগোলিক স্বাধীনতাই একমাত্র স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতা মানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি যা আমরা এখনো পাইনি। আর প্রকৃত অর্থে সে গন্তব্য এখনো বহুদূর।
দেশে দেশে যুদ্ধ হয়, জয় পরাজয় ও হয়। সেই জয়ের গৌরব মহিমান্বিত হয় পরবর্তী সাফল্যর মাপকাঠিতে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিতে। শুধু কটাক্ষ ও উস্কানিমূলক বাক্যবাণে নয়। একটি সভ্য জাতি রূপে বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের তুলে ধরতে প্রয়োজন স্থিরতা ও অধ্যবসায়। নৈতিক ও মানসিক সমৃদ্ধি। মূল্যবোধ ও সামাজিক সচেতনতা। ঘৃণা দিয়ে ঘৃণা মোছা যায়না বরং ক্ষমা করে মহানুভবতার পরিচয় পাওয়া যায়। তাই ঘৃণা ও শোক যেন শক্তি ও সাফল্যর প্রতীক হয় আমাদের সে চেষ্টা করা দরকার। স্বাধীনতা দিবস মানে কেবল সভা, সেমিনার ও অনুষ্ঠান করেই ক্ষান্ত দেয়া নয়, বরং প্রতি স্বাধীনতা দিবসে আমাদের প্রয়োজন নতুন করে নিজেকে উজ্জীবিত করা। চিন্তা ও মানসিকতায় দেশাত্মবোধকে নতুন করে শাণিত করা। কেবল আবেগ নয় দায়িত্ব ও বাস্তবতা থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প করা। চলে যাওয়া সময় গুলোতে কেবল সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে পরস্পর দোষারোপ, ঘৃণা আর কটাক্ষ করার কারণে দেশের উন্নতিতে আসলে দুই পা এগিয়েছি তো এক পা পিছিয়েছি। এখন আমাদের প্রয়োজন আত্মশুদ্ধির অনুশীলন। শোককে শক্তিতে পরিণত করতে হবে। ঘৃণাকে সাফল্যে রূপান্তরের ইতিবাচক পদক্ষেপেই সম্ভব নিজেকে শুদ্ধ করা। আমাদের প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের কাছে আগামীর ভাবনাগুলো তুলে ধরা। বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। একই ভূখণ্ড ও একই ভাষাভাষীর মানুষ আমরা; এই চেতনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সময় এসেছে। সময় এসেছে বিভাজন মুক্ত বাংলাদেশ গড়ার। আমরাই পারি ছোট ছোট চেষ্টা দিয়ে বড় বড় সাফল্য অর্জন করতে। আর এজন্য প্রয়োজন সম্মেলিত উদ্যোগ।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এ জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। কিছুসংখ্যক বিভ্রান্ত মানুষ ছাড়া সবাই এজন্য সংগ্রাম করেছেন, সহ্য করেছেন সীমাহীন যন্ত্রণা। কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়-সংকল্প ছিলেন সবাই। সেজন্যই অতি অল্প সময়ের মধ্যে এত বড় অর্জন সম্ভব হয়েছে। বৃহৎ অর্জনের জন্যে ঐক্যবদ্ধ জাতীয় উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। এমন বৃহৎ অর্জনের পর একটি নতুন জাতি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব অনেক। সময়ের আবর্তে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়েছে, বিভক্তি এসেছে চেতনায়। জাতীয় লক্ষ্যও অনেক সময় ম্রিয়মাণ হয়েছে। তারপর ও আমরা থেমে নেই। অনেক ক্রান্তিকাল আমরা উৎরে এসেছি আমাদের দৃঢ়তায়। এখন সময় এসেছে নিজেদের স্খলন, পতন ও ত্রুটি উপলব্ধি করা এবং শোধরানোর সঠিক পথে অগ্রসর হওয়া। পারস্পরিক দোষারোপ নয়, এ জন্য প্রয়োজন আত্ম-সমালোচনা। মুক্তমন নিয়ে আত্ম-সমালোচনার মাধ্যমেই আত্ম-সংশোধন সম্ভব। আত্মতুষ্টি নয় বরঞ্চ আত্ম-সমালোচনার মাধ্যমেই কেবল দেশের সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের সকলের এ আত্মত্যাগ এখন ভীষণ প্রয়োজন।
আমরা যারা দেশের বাইরে থাকি নানা উদ্দীপনা, উৎসব ও আয়োজনের মাধ্যমে বিজয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত হই। এ আয়োজন ও উদ্যোগ দেখে এখানে জন্ম নেয়া নতুন প্রজন্ম ও ধীরে ধীরে এর চেতনা ও ইতিহাস সম্পর্কে অবহিত হচ্ছে। তাদের কাছে এই বার্তা প্রকাশের দায়িত্ব আমাদের সকলের। আর এ দায়িত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো যথাসম্ভব দেশীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য পালন। আর সে লক্ষেই আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ইতিহাস, দেশীয় সংস্কৃতি, মুক্তিযোদ্ধাদের বীর-গাঁথা ও দেশীয় কৃষ্টি তুলে ধরা দরকার। কিন্তু তা শুধু আবেগ দিয়ে নয় আত্মশুদ্ধি দিয়ে নতুন করে পথ চলার ক্ষেত্র তৈরি করা। শোক যেন শক্তিতে পরিণত হয়, ক্ষুব্ধতা যেন ইতিবাচক উত্তরণের প্রদর্শক হয় স্বাধীনতা দিবসে সেটাই হোক আমাদের নতুন অঙ্গীকার।
মার্চের এই স্বাধীনতার উৎসব বাংলাদেশ তো বটেই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশি তথা সমগ্র জনসমষ্টির সার্থকতা ও গৌরবের উৎসব। আমাদের জাতীয় জীবনের সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত অধ্যায় রচিত হয়েছে বলেই মার্চ এলে আমরা প্রত্যেকেই অনুভব করি দেশের জন্য এক অন্যরকম অনুভূতি। পুলকিত হই এক অনির্বচনীয় আত্মবিশ্বাসে। এক অভূতপূর্ব অনুভবে। এ মাসটি বাংলাদেশের জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছিল মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তা বিধান ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায়। একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, একটি নিজস্ব পতাকা একটি স্বতন্ত্র আত্মপরিচয় অর্জনের জন্য দেশের সর্বস্তরের জনগণ জীবন বাজী রেখে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মরণপণ যুদ্ধে। তাই দেশাত্মবোধের তাগিদে পারস্পরিক নিন্দা ও সমালোচনা ভুলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে বহুদূর। আর এভাবেই যদি আমরা এগিয়ে যাই, তবেই পৃথিবীর যে কোন ভূখণ্ডে বাংলা সংস্কৃতির পত্তন সম্ভব। কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগে হলেও আমদের সমৃদ্ধ ইতিহাস আর অনেক তিতিক্ষায় পাওয়া স্বাধীনতার আনন্দটা অন্তত নতুন প্রজন্মের চিন্তা চেতনা ও মননে জাগ্রত করা দরকার। স্বাধীনতা দিবসে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়াসই হোক আমাদের আগামীর পথচলা। তাই বৃহত্তর স্বার্থে শুধু আবেগ নয় আত্মশুদ্ধি দিয়েই শাণিত হোক স্বাধীনতার চেতনা।
কাজী সুলতানা শিমি, সিডনী
|