নার্সিসিজম, অহংবোধ ও সেলফি
গ্রিক পুরাণে নার্সিসিজমের আরেকটি সংস্করণ আছে: ক্লান্ত ও পিপাসিত শিকারি নারসিসাস জলাশয়ে জলপান করার সময় নিজের ছায়া দেখে এতই মুগ্ধ যে জগত সংসার ভুলে আত্মমগ্ন হয়ে নিজের ছায়া দেখতে লাগল। এ দেখার শেষ নেই। বিধাতা করূণাবশতঃ আত্ম-প্রেমিক উন্মাদকে একটি নারসিসাস ফুল গাছে পরিণত করলেন। এক ছবিতে দেখেছিলাম জলাশয়ের তীরে নারসিসাস গাছের ফুল ঝুঁকে নিজের ছায়া দেখছে। ড্যাফোডিল এক জাতীয় নারসিসাস ফুল।
ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখলাম নার্সিসিজম একটা মানসিক বিকৃতি। আরও জানলাম নার্সিসিজম ও অহংবোধ দুটো এক নয়। দার্শনিক ও গবেষক শিমি সেলফিকে আধুনিক সমাজের নার্সিসিজম রূপে আখ্যায়িত করেছেন। মনোঃরোগের চিকিৎসকেরা নার্সিসিজমের দশটি লক্ষণ উল্লেখ করেছেন। সেলফি এ লক্ষণগুলির মধ্যে নেই। সেলফি নার্সিসিজমের নতুন কোন লক্ষণ হলে তা মনোঃরোগের চিকিৎসকদের বিবেচনায় আসত। সেলফি অবশ্যই একটি ক্রেজ, যেমন ক্রেজ ফেসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা, ছবির পর ছবি আপলোড করা ইত্যাদি। আমার মনে হয়, যারা নার্সিসিষ্ট তাদের সেলফির চেয়ে আয়নার সামনেই একাকী বেশী সময় দেয়ার কথা। এবার সিডনী অলিম্পিক পার্কের বৈশাখী মেলায় মেলার কর্মকর্তাদের দেখেছি ছুটোছুটি করে লেবার ও কোয়ালিশন পার্টি নেতাদের সাথে সেলফি তুলছেন। এটা নিশ্চয় আত্ম-প্রেম নয়, তবে দৃষ্টি আকর্ষণ করার কিছু একটা বটে! বারাক ওবামা ম্যান্ডেলার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সেলফি তুলে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিও সেলফির আকর্ষণ উপেক্ষা করতে পারেননি।
শিমি তার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া যে বিকৃত সেলফির কথা বলেছেন, আমার ধারনা এটা আমজনতার দৃষ্টি আকর্ষণ করার এক উন্মাদনা। আমারই পরিচিত এক দম্পতি কিছুদিন আগে হাইওয়েতে এক্সিডেন্টে প্রায় অক্ষত থেকে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন, কিন্তু তাদের গাড়ি চুরমার হয়ে গিয়েছিল। তারপর দুর্ঘটনাস্থল থেকে এসএমএস করে তাদের পাঠান ধ্বংস-প্রায় গাড়ির ছবি সাথে সাথেই দেখতে পেয়েছি। প্রযুক্তি মানুষের এত হাতের কাছে চলে এসেছে, সবাই তা নিয়ে খেলতে চায় শিশুদের মত। এই সেলফিওয়ালারা, চটকদার প্রযুক্তি যারা নির্মাণ ও বাজারজাত করছে, তাদের হাতে খেলার পুতুল মাত্র।
আমরা সবাই কম বেশী অহংবোধের দাস বা অহংবোধ দ্বারা তাড়িত। যারা অহংকারী, তারা জানেন অহংকারী হওয়া শোভনীয় নয়। এদেরকে মানুষ এড়িয়ে চলে। অহংকারী মানুষ শেষ পর্যন্ত নিঃসঙ্গ মানুষে পরিণত হয়। অহংকারী মানুষের বিপরীতে মাটির মানুষের অবস্থান।
নার্সিসিসট মানুষ খুব সম্ভবত নিভৃতচারী বা Closet বাসী। যে সব নারী রূপচর্চায় বেশী সময় ব্যয় করেন, তারা নার্সিসিসট হতে পারেন। জীবন সঙ্গী খুঁজে খুঁজে যারা জীবনের মধ্যগগন পার করেছেন, একবার মনের আয়নায় নিজেকে দেখে আত্মপোলব্ধি করতে পারেন, তারা নার্সিসিজমে আক্রান্ত কিনা!
- ফারুক কাদের
|