প্রযুক্তি, প্রগতি ও আমাদের নীতিবোধ কাজী সুলতানা শিমি
শুরুতেই বলে নেই আমি প্রগতি বা প্রযুক্তি বিরোধী নই। প্রগতি ও প্রযুক্তি আজকাল প্রায় সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যাবহার হয় বলে এ কথা বলা। আমি শুধু এর যথাযথ ব্যাবহারের জন্য একটা নীতিগত পরিবর্তন দরকার বলে মনে করি। আর এই নীতিবোধ আসা দরকার আমাদের নিজস্ব চিন্তা ও মনন থেকে। আজকাল বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, ইন্টারনেট সাইট ও সামাজিক মাধ্যম গুলোর পরস্পর বিরোধী সংবাদ, তথ্য ও তত্বের বিস্তর ভিন্নতা দেখে মাঝেমাঝে খুব দিশেহারা ও শঙ্কিত বোধ হয়। কোনটা যে সত্যি আর কোনটা মিথ্যা সেটা নিয়ে নিজের বুদ্ধি বিচারের উপর নিজেই সন্দিহান হয়ে পরি। প্রযুক্তি ও প্রগতি নিয়ে দ্বিধায় পরে যাই।
‘কম্পিউট’ বা হিসাব করার জন্য কম্পিউটার যন্ত্রটি আবিষ্কার হয়েছিল। এখন এই যন্ত্রটির বহুবিধ ও বিচিত্র ব্যাবহারে মানব সভ্যতায় অবিস্মরণীয় পরিবর্তন এসেছে। এটি দিয়ে যা কিছু কাজ করা যাবে সেটি নিয়ন্ত্রিত হতে পারে শুধুমাত্র মানুষের নৈতিক মূল্যবোধ ও সৃজনশীলতা দিয়ে। সৃজনশীলতা যে সবসময় সঠিক পথে যায় তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেজন্য সচেতন হতে হবে মানুষকেই।
এ ক্ষেত্রে হোয়াইট বিয়ার এফেক্ট থিওরিটি প্রাসঙ্গিক বলে মনে হল। মনোবিজ্ঞানীদের মতে একজন মানুষ সিগারেট ছাড়তে চাইলে সেটা তাকে আরো বেশি ধরে বসে, চকলেটে আসক্ত কেউ কম খেতে চাইলে আরো বেশি চকলেটের প্রতি মোহ বাড়ে তার। আর এসবের কারণ হচ্ছে এই হোয়াইট বিয়ার এফেক্ট। সাদা ভাল্লুককে যতটাই নেই নেই মনে করা হোক সেটা আরও বেশি মনের ভেতরে চলে আসে। ঠিক তেমনি সামাজিক মাধ্যম গুলোতে পারস্পরিক কটাক্ষ, তিক্তবাণের ছড়াছড়ি আর বিদ্রূপ যেন অনেকটা হোয়াইট বিয়ার এফেক্ট এর মতোই নেশা হয়ে পড়েছে। হয়তো চাইছেন না তারপরও অতিরিক্ত সময় এসবে আসক্ত হয়ে পড়ছেন। ভোলার চেষ্টা করলে তাকে যেমন আরো বেশি মনে পড়ে। তেমনি ইন্টারনেট তথা ফেসবুক নেশার মতো হয়ে পড়েছে। তাই নেশা কাটানোর বিকল্প কিছু খুঁজে নেয়া দরকার।
সেদিন যেমন লাঞ্চ ব্রেকে বসে ডেইলি টেলিগ্রাফ দেখছিলাম। একটা নিউজের শিরোনাম দেখে চোখ আটকে গেলো। একটু ধাক্কা খেলাম। নিউজটা ছিল নতুন নিয়ম অনুযায়ী সকল প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আবার স্পেলিং টেস্ট দিতে হবে। পাশ হলে চাকরী থাকবে না হলে নয়। নিউজটা আমাকে অবাক করেছে এজন্য যে, প্রাইমারী স্কুলের কোমল মতি বাচ্চাদের বানান শেখাবে যে শিক্ষক তারাই নাকি বানান জানেনা। তাই এই টেস্টের আয়োজন। কেননা আজকাল কেউ আর ব্রেন আর চিন্তা-চেতনা’র প্রয়োগ করতে চায়না। সবাই এতটাই প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে গেছে যে মস্তিষ্কের ব্যাবহার প্রযুক্তির উপর ছেড়ে দিয়ে সব যন্ত্র হয়ে বসে আছে। সাধারণ স্পেলিং করতে ও তাদের ফোন বা আইপ্যাড এর সহায়তা নিতে হচ্ছে। হাতের মুঠোয় তা দেখে নিচ্ছে। এইভাবে যন্ত্র হতে হতে কোথায় ছুটছে তারা হয়তো নিজেও জানেনা। মস্তিস্কের উৎকর্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রযুক্তি দরকার তাই বলে এভাবে চিন্তা শক্তিকে বিপন্ন করে নয়।
এই দেশে নতুন প্রজন্মের কাছে কম্পিউটারের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ হয়ে গেছে গেম। প্রযুক্তির প্রতি আমরা এতটাই নির্ভর হয়ে গেছি যে বাবা-মা যখন দেখেছেন তাদের ছেলে মেয়েরা সব কাজকর্ম ফেলে দিনরাত কম্পিউটারের মনিটরে মুখ গুঁজে পড়ে আছে তখন তারা চিন্তিত না হয়ে বরঞ্চ আনন্দিত বোধ করেন। কোথাও কোন আড্ডা বা ঘরোয়া মজলিশে আজকাল বাচ্চাদের আর কথা বলতে দেখি-ই না যার যার মতো তারা তাদের গেম নিয়ে বুধ হয়ে নেশায় পড়ে আছে। খুবই অসাধারণ এবং নিরাপদ একটা প্রযুক্তি নিয়ে বাড়াবাড়ি করে ভয়ঙ্কর একটা বিপদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। এ প্রসঙ্গে ডেইলি টেলিগ্রাফের আরেকটি নিউজের কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক বলে মনে হচ্ছে। নিউজটি ছিল এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা শিক্ষাগত ভাবে অনেক এগিয়েছে কিন্তু পারস্পরিক সামাজিকতা কি জিনিষ তা জানেনা। শুধু মাত্র ট্যাক্স, ম্যাসেজ আর চ্যাট করে সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা আদান প্রদান করায় পেশাগত ব্যাবহারে তারা পূর্ণ বাক্য বলতে পারছেনা। তাই চাকরি উপযোগী করার উদ্দেশে পূর্ণ বাক্য বলার নতুন কোর্স চালু করতে যাচ্ছে সরকার। যাতে করে পেশাগত ভাবে হলেও তারা আন্তরিকতা বা বন্ধুত্ব সুলভ হয়ে কথা বলতে পারে। সামাজিকতা না জানা বা কথা বলতে না পারা প্রযুক্তিগত সুফল নয়।
সাইকোলজিক্যাল সায়েন্সের জার্নাল অনুসারে আমাদের জীবন থেকে ভালোবাসার মানুষগুলোর প্রত্যাখ্যান আমাদের হৃদপিণ্ডের গতিকে কমিয়ে দেয়। প্রযুক্তি আজ ভালোলাগা ও ভালবাসার মানুষের বিকল্প রূপে জায়গা করে নিয়েছে। সারাদিন কাজ শেষে যদি আবারো প্রযুক্তি নিয়ে পরে থাকি তাহলে শুধু ভালোবাসার মানুষই নয় সব ধরণের মানুষই একাকী ও ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পরবে। সায়েন্টিফিক জার্নাল অফ অ্যামেরিকান মতে এই নিঃসঙ্গতার কষ্ট কেবল আমাদের মনের নয়। শরীরেরও। কেবল খুব কাছের বা প্রিয় মানুষই নয়, অচেনা কারো কাছ থেকে পাওয়া বাজে ব্যবহারও আমাদের মস্তিষ্কের কিছু স্থানে আঘাত করে আর শরীরের বিভিন্ন স্থানে তৈরি করে ব্যথা। কিন্তু এজন্য ইন্টারনেটই কেবল তার বিকল্প হতে পারেনা। নিজেকে সময় দিন। শরীর আর মনকে সুস্থ হতে দিন। ভালোলাগার মানুষদের সাথে কথা বলুন। অবশ্য কথা বলার মানুষ পাওয়া ও আজকাল দুরহ হয়ে পড়েছে প্রযুক্তির আধিপত্যর কারণে।
নতুন প্রযুক্তি দেখলেই সেটা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার অভ্যাস আমাদের ছাড়া দরকার। যে কোনো নতুন একটা প্রযুক্তি দেখলে সেটাকে যাচাই-বাছাই করে নেয়া মোটেও সেকেলে মানসিকতা নয়, বরঞ্চ বুদ্ধিমানের কাজ। এর সবচেয়ে সহজ উদাহরণ হচ্ছে কম্পিউটার। এই অসাধারণ একটি প্রযুক্তি আমাদের পুরো সভ্যতাটাকেই নতুন করে সাজিয়ে দিয়েছে। কোনো মানুষই আজ কম্পিউটার ব্যবহার না করে চলতে পারবেনা। কিন্তু তার ব্যাবহারের ও একটা মানদণ্ড দরকার। এর বিকল্প হিসেবে তাই অস্ট্রেলিয়ান সরকার ফিটনেস প্রোগ্রামকে অত্যাবশ্যকীয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেন্টার লিংক থেকে এর জন্য বিশেষ কোর্স ও অর্থায়ন বরাদ্দ করার চিন্তা-ভাবনা চলছে। এভাবে নীতিমালা প্রয়োগ করে প্রযুক্তির উপর থেকে মানুষের আসক্তি কমানোর পদক্ষেপ গ্রহণ অতি জরুরি হয়ে পড়েছে।
জরিপে দেখা গেছে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর শতকরা আশি ভাগ মানুষ ফেসবুক ব্যাবহার করে। বলা যায় ইন্টারনেট এবং ফেসবুক এখন একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। ফেসবুক ব্যাবহার করার কারণে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে বহু গুন হয়েছে। কিন্তু এর বড় একটা সংখ্যা আসলে কমবয়সী কিশোর-কিশোরী এমন কী শিশু! অপরিণত বয়সে এই ফেসবুক ও ইন্টারনেট আসক্তি মানসিক বিকাশ ও নীতিগত দিক থেকে মোটেও স্বাভাবিক নয়।
এ লিখাটি কোনো সামাজিক সমাধান দেয়ার জন্য নয়, কিছু লেখালেখি আর মতামত দিয়েই কোন সমস্যার সমাধান দেয়া যায় বলে আমি মনে করি না। কম্পিউটার জগতে আজ ইন্টারনেট, ফেসবুক কিংবা অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী প্রযুক্তি ও যুগোপযোগী প্রচার মাধ্যম। এটাকে শুধু দায়িত্ব নিয়ে ব্যবহার করে অনেক দুর্ভেদ্য সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমি শুধু বলতে চাই এই বিষয়টাকে নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় হয়েছে। অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার সময় হয়েছে। বুদ্ধিজীবী ও মনীষীদের শুধু চিন্তা নয় পদক্ষেপ নেয়ার সময় হয়েছে। আর এর বাস্তব প্রয়োগের দিকটাকেও জরুরী ভিত্তিতে চর্চা করা দরকার হয়ে পড়েছে।
কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি
|