পেশা ও মূল্যবোধঃ প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন কাজী সুলতানা শিমি
জীবনের লক্ষ নিয়ে অনেক বড় বড় স্বপ্নের কথা লিখতাম আমরা ছোট বেলায়। পরীক্ষার খাতায়। কেউবা লিখতাম ডাক্তার হবো। কেউ শিক্ষক, কেউ বা অন্যকিছু। রচনাতে আমার জীবনের লক্ষ লেখার পেছনে মুল বিষয়বস্তু ছিল মানব কল্যাণ। প্রশ্ন হলো বড়ো হয়ে আমরা যখন সত্যিকার পেশাগত জীবনে প্রবেশ করি তখন কতজনের লক্ষ ঠিক থাকে মানব কল্যাণে ব্রত হবার। যদি তাই হতো তাহলে সমাজের এতো বিশৃঙ্খলা কি আদৌ সৃষ্টি হতো! এমন ভাবে গ্রাস করতে পারতো এতো অরাজকতা। এড্রিক বেকারের মতো বাসনা নিয়ে আমরা কতজন আসলে সমাজ ও মানব কল্যাণে এগিয়েছি!
এড্রিক বেকার একজন চিকিৎসক। ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে তার জন্ম। বাবা জন বেকার একজন পরিসংখ্যানবিদ এবং মা বেটি বেকার একজন শিক্ষক। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে বেকার দ্বিতীয়। ছোটবেলা থেকেই বেকারের ইচ্ছা, বড় হয়ে মানুষের সেবা করবেন। চিকিৎসক হলে এই সুযোগ বেশি বলে তিনি ঠিক করেন এ পেশায় আসবেন। ১৯৬৫ সালে তিনি ডুনেডিন শহরের ওটাগো মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। পরে ওয়েলিংটনে ইন্টার্নি শেষে নিউজিল্যান্ড সরকারের শল্য চিকিৎসক হিসেবে চাকরীতে যোগ দেন। এরপর চলে যান যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ভিয়েতনামে।
সেখানে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেন। মাঝে অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডে শিশুস্বাস্থ্যসহ তিনটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর কোর্স করেন। ১৯৭৬ সালে তিনি পাপুয়া নিউগিনি ও জাম্বিয়ায় যান। এর মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যে। বাংলাদেশে যখন মুক্তিযুদ্ধ চলছিল, তখন ভিয়েতনামে একটি চিকিৎসক দলের হয়ে কাজ করছিলেন তিনি। সংবাদমাধ্যমে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের নিপীড়ন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী লড়াই—এসব কথা জানতে পারেন। বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে জানা ও দেখা নির্যাতিত মানুষ ও শরণার্থীদের অসহায় চিত্র তাকে ব্যথিত করে। তিনি মনে মনে সংকল্প করেন, সময়-সুযোগ করে নিজ চোখে বাংলাদেশে দেখে আসবেন।
১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশে আসেন। জড়িয়ে পড়েন এ দেশের মায়ার টানে। ঠিক করলেন এদেশের দুঃস্থ মানুষের সেবা করবেন তিনি। বেকার প্রথমে মেহেরপুর মিশন হাসপাতালে প্রায় দুই বছর কাজ করেন। পরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালে আট মাস কাজ করেন। এভাবে কেটে গেল ৩১টি বছর। এর মধ্যে ২৭ বছর ধরে তিনি বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন মধুপুরের শোলাকুড়ি ইউনিয়নের কাইলাকুড়ি গ্রামে। এখন সেখানে চিকিৎসাকেন্দ্র রয়েছে তাঁর যেখানে প্রতিদিন গড়ে দেড় শতাধিক রোগী বিনামূল্যে চিকিৎসা নিচ্ছে।
বেকারের কথায়, "আমার কোনো বড় হাসপাতালে কাজ করার ইচ্ছা ছিল না। ইচ্ছা ছিল প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ করার। সে চিন্তা থেকেই চলে আসি মধুপুর গড় এলাকায়। সাধারণ মানুষদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মনে হল বাংলা ভাষাটা শিখে নেওয়া দরকার। তাই মধুপুরের জলছত্র খ্রিষ্টান মিশনে এক বছর থেকে বাংলা শিখে নিলাম। যোগ দিলাম স্থানীয় থানারবাইদ গ্রামে, চার্চ অব বাংলাদেশের একটি ক্লিনিকে।’ সেই থেকে পাহাড়ি এলাকায় গরিব ও অসহায় মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন বেকার।১৯৮৩ সালে ওই ক্লিনিকে দুজন খণ্ডকালীন ও তিনজন সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়ে বেকারের যাত্রা শুরু হয়। দিন দিন বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। তখন থানারবাইদের পাশের গ্রাম কাইলাকুড়িতে ১৯৯৬ সালে উপকেন্দ্র খুলে চিকিৎসাসেবা দেওয়া শুরু করেন। ২০০২ সালে কাইলাকুড়িতে একটি পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করেন তিনি।
বেকার জানান, তিনি দু-এক বছর পরপর নিজ দেশে গিয়ে স্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছ থেকে এই চিকিৎসাকেন্দ্র চালানোর টাকা জোগাড় করেন। এখানে তিনিই একমাত্র চিকিৎসক হিসেবে রোগী দেখেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন স্থানীয় ৮৭ জন তরুণ-তরুণী। সেবা দেওয়ার ব্যাপারে তিনি তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে নিয়েছেন। চিকিৎসাকেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে দেড় শতাধিক রোগী আসে। সেখানে জ্বর, ডায়াবেটিস, পেটের পীড়া ও পুষ্টিহীনতায় ভোগা রোগীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধ দেওয়া হয়। হাত-পা ভাঙাসহ অন্যান্য জটিল রোগীদের জন্য আবাসিক চিকিৎসাব্যবস্থা রয়েছে। এসব রোগীর ক্ষেত্রে রোগীর জন্য ১০০ টাকা ও রোগীর সহযোগীর জন্য ২০০ টাকা এককালীন নেওয়া হয়। বাকি সব ব্যয় চিকিৎসাকেন্দ্র বহন করে।
অত্যন্ত সাধারণভাবে জীবন যাপন করতেন বেকার। ডঃ বেকারের মধ্যে কোনো চাওয়া-পাওয়া ছিলোনা। তিনি ছোট একটি মাটির ঘরে থাকতেন, মেঝেতে ঘুমাতেন, খাবারদাবার ছিল অতি সাধারণ। নিঃস্বার্থভাবে তিনি মানুষের সেবা করে গেছেন। তাঁর কল্যাণেই বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ ঘরের কাছে ভালো চিকিৎসা পাচ্ছে। বেকার বলেন, এ দেশের মানুষ খুব আন্তরিক। কিন্তু অধিকাংশ দরিদ্র মানুষই চিকিৎসাসেবা পায় না। এসব মানুষের সেবা করতেই আমি এ দেশে থেকে যাই। নিউজিল্যান্ড গেলে তার মা তাকে জিজ্ঞাসা করতেন, ‘তুমি কবে আবার তোমার দেশে ফিরে আসবে?’ বেকার বলেছিলো, "প্রতিবছর ওদেশের অনেক ছেলেমেয়ে চিকিৎসক হচ্ছে। তাদের মধ্যে কেউ না কেউ একদিন চলে আসবে আমাদের হাসপাতালে। গ্রামের অসহায় দরিদ্র মানুষের সেবা করবে। সে রকম কাউকে পেলেই আমি ফিরে আসবো।
কিন্তু ডঃ বেকারের আর নিউজিল্যান্ড ফিরে যাওয়া হয়নি। তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে। আজ বাংলাদেশী অনেক ডাক্তারই আছেন যারা নিউজিল্যান্ড হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় এসে চিকিৎসক হয়েছেন। কঠিন কঠিন পরীক্ষায় পাশ করেছেন, বড় বড় মানুষের সান্নিধ্যে এসেছেন, নিজেদের ব্যক্তিগত প্রোফাইল সমৃদ্ধ করেছেন কিংবা বিশাল প্রতিপত্তি গড়েছেন। কিন্তু এই রকম একজন ডঃ বেকার আমাদের আজ খুব প্রয়োজন। যিনি যশ, প্রতিপত্তি আর ভূমি কেনার স্বপ্নদ্রষ্টা না হয়ে হতে পারেন মানবতার স্বপ্নদ্রষ্টা। আমরা কি পেতে পারিনা আমাদের দেশের ডাক্তারদের মাঝে সেই স্পৃহা ও সদিচ্ছা। কেননা চিকিৎসকরা যা পারেন আমরা সাধারণ মানুষরা তা পারিনা। দোষ আসলে পেশার নয়, পরিবর্তন হয়ে গেছে মানসিকতার। আমরা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছি। সমষ্টিগত গত সাফল্যর প্রতি আমাদের আর কোন আগ্রহ নেই। দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা শুধু মুখে মুখে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কাগজে কলমে। আজ প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন। এই ক্ষয়ে যাওয়া মানসিকতা ফিরে আসবে কি কোনদিন? সেই ছোটবেলায় লিখে যাওয়া রচনা’র প্রতিপাদ্য প্রতিফলিত হোক আমাদের চিন্তায়, মননে ও বাস্তবতায়। একটু সদিচ্ছা দিয়ে পরিবর্তন করা যায় সমাজ এবং বিশ্বের যতো অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা। হয়তো পরিবর্তন আসবে। সেদিন সুদূরে নয়...
কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি
|