পারিপার্শ্বিকতা যখন যেমন কাজী সুলতানা শিমি
রমজান উপলক্ষে শুভেচ্ছা বানীতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, “I want to recognise all our essential workers who are taking care of us. They are doing their part and we all need to do ours”- এই যে কেবলই হেলথ ওয়ার্কার কথাটা না বলে বলেছেন এসেনশিয়াল ওয়ার্কার’ এটা অনুপ্রাণিত হবার মতো একটা দিক-নির্দেশনা। জীবনযাত্রা সচল রাখতে আমাদের প্রত্যেকেরই দায়-বোধ আছে। আর তা প্রশংসায় না হোক নিদেনপক্ষে মূল্যায়নেও যদি না আসে তাতে কাজের অনুপ্রেরণা হারিয়ে যায়। ব্যাপারগুলো সাধারণ জনমনেও স্বীকৃত হওয়া প্রয়োজন। মূল্যায়ন না হোক অন্ততঃ খেয়াল রাখা প্রয়োজন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা কোন যুদ্ধই দেখিনি। যুদ্ধকালে মানুষ কেমন করে, কেমন থাকে জানা নেই। ছোটবেলায় পরীক্ষা পাশের জন্য রচনা শিখেছিলাম “যুদ্ধ নয় শান্তি”। জেনেছিলাম তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকি পারমাণবিক বোমার হবেনা, হতে পারে জৈব রাসায়নিক ভাবে। সত্যি নাকি গুজব জানিনা কেউ কেউ কভিড-১৯ বা করোনাকে তার নমুনা হিসেবে তুলনা করছে। জৈব-যুদ্ধ হলে মানুষের আচরণ কেমন হবে কিংবা পরিস্থিতি কেমন হতে পারে তার বাস্তব প্রেক্ষাপট পরীক্ষামূলক ভাবে দেখা হচ্ছে কিনা কেউ কেউ সেটাও ভাবছে। কোন পেটেন্ট স্বীকৃতি পাবার আগে যেমন পরীক্ষা করা হয় এটাও তেমন প্রদর্শন কিনা সে শঙ্কাও হচ্ছে। ঘটনা যেটাই হোক চীরচেনা পৃথিবীর এই নতুন রূপ আমরা মানতে পারছিনা। করোনা ভীতি মানুষকে যতোটা আতঙ্কিত ও শঙ্কিত করেছে এমন কখনো দেখিনি। এই শঙ্কা ও আতঙ্ক মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে ও স্বাভাবিক আচরণে প্রভাব ফেলছে ভীষণ রকম।
বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে নানা রকম ট্রল, গান, গালাগাল, উপদেশ কিংবা আবেগী কথাবার্তায় ভালোই সময় কাটছে অনেকের। মূলকথা ধ্যানে-জ্ঞানে করোনাই একমাত্র বিষয়। শুধুমাত্র তা না করে কেউ যদি দায়িত্ববোধ থেকে এর কিছু ইতিবাচক বা ভালো দিকগুলোও তুলে ধরতেন মানুষ বোধ করি আরেকটু সচেতন হতো। ব্যাপারটা যে নিছক খেলা বা সাধারণ বিষয় নয় এটা বুঝবার জন্য কৌতুক, ব্যঙ্গ কিংবা আতঙ্ক-বার্তাই যথেষ্ট নয়।
এই ভাইরাসে মানুষ যতোটা না মারা যাচ্ছে তারচে সুস্থ হয়ে ফিরছে অনেক বেশী। তবুও মানুষ কেন যেন এই সুস্থ হবার বিষয়টা নিয়ে বেশী আলোচনা করছেনা। এই মুহূর্তে অন্যান্য রোগে যারা মারা যাচ্ছে তাদের কথা আমরা তেমন উল্লেখ করছিনা। পৃথিবীতে কতশত মানুষ মারা গেছে কিংবা যাচ্ছে নানা কারণে অথচ আমরা সেসব ভাবিনা এখন। ভাইরাস মুক্ত পৃথিবীতে আমরা কখনই বাস করিনি কিংবা আগামীতেও করবোনা। অমরত্ব নিয়েও পৃথিবীতে আসেনি মানুষ। আগেও না, এখনো না। কিন্তু এখন এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছে মানুষ, যেন এটাই মৃত্যুর একমাত্র কারণ। ধরুন, আপনি যদি সারাজীবন সিগারেট খেয়ে আপনার ফুসফুসের অবস্থা আগেই দৈন্যদশায় নিয়ে রাখেন কিংবা আপনার যদি আগে থেকেই শ্বাসকষ্ট অর্থাৎ এ্যজমা কিংবা হার্টের সমস্যা থাকে সেক্ষেত্রে করোনায় আক্রান্ত হলে সব দোষ বেচারা করোনার। বাকি সব উপসর্গ যেমন, আপনার সারাজীবনের অবহেলা, ভগ্ন-স্বাস্থ্য কিংবা অন্য অসুস্থতা এখন আর বিবেচনায় আসছেনা! সম্প্রতি মেলবোর্নে চার জন পুলিশ মারা গেলো সড়ক দুর্ঘটনায়। চারজন পুলিশ একসাথে মারা যাবার ঘটনা ইতিহাসে নাকি এই প্রথম। ঘরে থাকার কারণে আরো কতো যে দুর্ঘটনার হাত থেকে আমরা রেহাই পাচ্ছি সেটা একবার ভাবছিনা। এসব বিষয় গুলোও তো আলোচনার অংশ হতে পারে কেবলই শঙ্কা না বাড়িয়ে।
পরিবারের মানুষগুলোর পছন্দ-অপছন্দ, ভালো-থাকা, মন্দ-থাকার কথা এক ছাদের নিচে থেকেও অনেকদিন খেয়াল করা হয়নি। পাশাপাশি থেকেও একে অপরকে জন্মদিন কিংবা বিবাহ বার্ষিকীর শুভাশিস জানাতো ভার্চুয়াল বার্তায়, কেবলই একটা লাঞ্চ কিংবা ডিনারে। এই যে এখন পরিবারের মানুষগুলোর সাথে সময় কাটাচ্ছে এটা কিন্তু কম পাওয়া নয়। এতে কিছুটা শিথিল হয়ে যাওয়া বন্ধনগুলো নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে।
হোম কোয়ারাইন্টান আর সেলফ আইসোলেশন ব্যাপারটাকে জটিল অর্থে না নিয়ে সাধারণ অর্থে বলা যায় নিজেকে নিয়ে ভাবার একটা উপায়। এ থেকে মানুষ ক্রমশঃ বুঝতে পারছে কেবলই ভার্চুয়াল-বোধ থেকে যে সময়গুলো এতদিন কেটেছে, এটাই একমাত্র সম্পর্ক নয়। পরিজন আর বন্ধুদের ফোন কিংবা উৎকণ্ঠাই প্রমাণ করছে সত্যিকারের সম্পর্ক কি আর কারাই বা আপনজন। ঢালাওভাবে গতানুগতিক ফেসবুক রিএ্যক্ট কিংবা কমেন্টে নয় ফোন কিংবা ম্যাসেজে প্রতিনিয়ত খোঁজ নেয়া মানুষগুলোই আসলে আপনার স্বজন। এখন বরং সেই সম্পর্ক গুলোও গুরুত্ব দিতে শিখি।
রাস্তাঘাটে যে নির্জন দৃশ্য দেখছি সেটাকে আমরা দূষণ-মুক্ত পরিবেশ পাবার একটা পদক্ষেপ ভাবতে পারি। কিংবা মনে করতে পারি এটা পৃথিবীর ইমিউন সিস্টেম। পৃথিবী নিজেকে নতুন করে সাজিয়ে নিচ্ছে। নিজেদের অসুখ হলে যেমন স্বজন-পরিজনদের ব্যস্ত রাখি, যন্ত্রণা দিই সেরকমই কিছু একটা হচ্ছে পৃথিবীর। আতঙ্ক আর শঙ্কা আমাদের যৌক্তিক চিন্তা ভাবনার ক্ষমতা নষ্ট করে। আতঙ্ক, শঙ্কা কিছুদিনের জন্য স্থগিত রেখে আমরা বরং আত্ম-উপলব্ধি আর আত্ম-জিজ্ঞাসায় মন দিই। অথবা জীবনকে অন্যভাবে করে যাপন করবার একটা নতুন কৌশল পরখ করি। গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে বৃত্তের বাইরেও যে জগত আছে সেটা উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। সবকিছুই ধারাবাহিক হতে হবে, সবসময়ই ইঁদুর-দৌড়ে ছুটতে হবে এমন তো কথা নেই।
পৃথিবীতে সবাই ক্ষণজন্মা। এ অবসরে বরং নিজের প্রতি খেয়াল করি। পরিছন্ন থাকা, ইমিউন সিস্টেম শক্ত রাখার জন্য সুষম খাবার খাওয়া, খাবারের অপচয় না করা, মিতব্যায়িতা চর্চা আর ব্যায়ামের কথাও ভাবতে পারি। সবচে বড় কথা যশ আর বিত্ত বৈভবের অস্থিরতা আপাততঃ থেমে গেছে। এতদিন ধরে যে খাবার-দাবার, সাজ-সজ্জা, শাড়ী, বাড়ি, গাড়ি ও বিত্ত-বৈভবের প্রতিযোগিতা ছিল বা পোষ্ট করা হতো সেটা একদম নেই। এমনকি একে অপরকে অহেতুক সমালোচনা কিংবা বিরক্ত করার প্রবণতাও অনেকটা কমে গেছে। পৃথিবীতে এতো অশান্তি, এতো লুটপাট, এতো রাজনীতি, খুন, ধর্ষণ আপাততঃ এই মুহূর্তে হচ্ছেনা। যুগে যুগে যে ধর্মকে ব্যাবহার করে মানুষ কেবল হানাহানি করেছে, ধ্যান আর আধ্যাত্মিকতার চর্চায় আজ যার যার ধর্ম অনুশীলন করছে কিন্তু একে অপরকে আঘাত বা নিধন করার চিন্তা করছেনা।
আরেকটা ব্যাপার হল অন্যান্য সবকিছু বন্ধ হলেও সুপারমার্কেট, পুলিশ, পেট্রোল-স্টেশন, ফার্মেসী, কনভিনিয়েন্ট স্টোর, প্রোডাক্ট সাপ্লাই এবং পোস্টঅফিস ছাড়াও অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা কিন্তু ঝুঁকি নিয়েও কাজ করছে। স্বাস্থ্য-কর্মীদের মতো তারাও কোন বিশেষ প্রোটেকশন ছাড়াই সরাসরি জন-সাধারণের সংস্পর্শে আসছে প্রতিনিয়ত। কাজ করলে আসতেই হবে। সেক্ষেত্রে দেড় মিটার দূরত্ব রাখা কোনভাবেই সম্ভব নয়। এখন ঘরে বসে বসে অন্যরা যদি কেবলই আতঙ্ক আর শঙ্কা বাড়াতে থাকেন তাহলে তাদের মানসিক অবস্থাটা কি হতে পারে একবার ভাবুন তো!
কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি
|