নজরুলের জীবনে নারী কাজী সুলতানা শিমি
"বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"
নজরুলের এই বিখ্যাত উক্তিটি প্রায়শ আজ বিভিন্ন সময়ে উল্লেখিত হয়ে থাকে। তার জীবনে আসলে নারীদের প্রভাব কেমন ছিল তা নিয়ে আজ কিছু কথা লিখবো। নজরুলকে সাম্যবাদের কবি বলার পেছনেও মূলত নারীদের অবদান ছিল অনেক। তার রচনায় হিন্দু মুসলিমে কোন ভেদাভেদ ছিলনা। এ ক্ষেত্রে তার স্ত্রী প্রমীলারও বিশেষ ভূমিকা ছিল। জীবনের নানা চড়াই-উৎরায়ের মাঝে নজরুল ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন সময়টায় মুসলিম সাহিত্য অফিসে পরিচিত হন পুস্তক প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে। তার সঙ্গেই প্রথম নজরুল কুমিল্লায় আসেন বিরজা সুন্দরী দেবীর বাড়ীতে। তিনি সেখানে প্রমীলার সাথে পরিচিত হন এবং তার প্রেমে পড়েন। এই পরিচয়ের থেকেই পরে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন তারা। ১৯২৪ সালের ২৫শে এপ্রিল কলকাতায় নজরুল ও প্রমীলার বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রমীলা ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দু এবং ব্রাহ্মণ সমাজ-ভুক্ত। এনিয়ে সেসময়ে তাকে অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল। তার মা গিরিবালা দেবী ছাড়া কেউ এ বিয়ে মেনে নেয়নি। নজরুলও আত্মীয় স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। হুগলীর মাসুমা রহমান বিয়ের প্রধান দায়িত্ব নেন। এরপর হুগলীতেই নজরুল তার সংসার শুরু করেন। তার চার সন্তানের মধ্যে প্রথম পুত্রের নাম রাখেন কৃষ্ণমোহাম্মদ। প্রমীলার প্রতি ছিল নজরুলের অগাধ প্রেম ও নির্ভরতা; তার বিভিন্ন রচনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৪২ সাল থেকে নজরুল অসুস্থ ও নির্বাক হয়ে পড়লে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২০ বছর প্রমীলা পাশে থেকে নিরলস ভাবে তার সেবা করে যান।
নজরুলের সাহিত্য রচনার প্রথম দিকে ইন্দুবালা ছিলেন নজরুলের গানের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। নজরুলের গানের প্রতি ইন্দুবালার ভীষণ আসক্তি ছিল। সে কারণে নজরুল ও তাকে একজন খুব কাছের মানুষ ভাবতেন। ইন্দুবালা তার কাজীদা’র কাছে শেখা প্রথম যে দুটি গানের রেকর্ড করেছিলেন তা ছিল–রুম ঝুম রুম ঝুম এবং চেওনা সুনয়না আর চেওনা এ নয়ন পানে’। ইন্দুবালা ও নজরুলের মধ্যে এতোটাই আন্তরিকতা ছিল যে নজরুল অনেক সময় ইন্দুবালাকে টাকা দিয়ে বলতেন, যাও ইন্দু তেলেভাজা নিয়ে এসো। অফিসের সামনে তেলে ভাজার একটা দোকান ছিল সেখান থেকে ইন্দুবালা নজরুলের জন্য তেলে ভাজা কিছু একটা নিয়ে আসতেন। খাওয়ার পর নজরুল আবার আবদার করে বলতেন ইন্দু এবার একটা পান দাও। একদিন রিহার্সাল রুমে কবি একা। ইন্দুবালা আসতেই তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ইন্দু এসো এসো একটা নতুন গান লিখেছি। সুর ও ঠিক করেছি। সে গানটি তিনি ইন্দুবালাকে গাইতে বললেন - অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে, এই গানটি।
আঙ্গুরবালাও ছিলেন নজরুলের গানের আরেক ভক্ত শিল্পী। তিনি নজরুলের প্রথম যে দুটি গানের রেকর্ড করেছিলেন তা হল ‘ভুলি কেমনে আজো যে মনে এবং এতো জল ও কাজল চোখে পাষাণী আনলে বলো কে’। আঙ্গুরবালা দেবীর মতে নজরুল গানের শব্দ বিকৃতি খুবই অপছন্দ করতেন। যেমন তিনি যদি লেখেন "বিন্ধিল" কিন্তু যিনি গাইছেন তিনি যদি প্রমিত উচ্চারণে বলেন "বিঁধিল" এটা তার মোটেই ভালোলাগতো না। তবে আঙ্গুরবালার প্রতি তার একটা বিশেষ মমতা ছিল। ভালো গাইলে তিনি প্রশংসা করে বলতেন, তোমার কণ্ঠে আমার গান প্রাণ পেলো। আবার কখনো মজা করে বলতেন, আমি তো কাঠামোটা তুলে দিলাম, এবার তুমি আঙ্গুরের রস মিশিয়ে এটাকে মিষ্টি করো।
নজরুল একবার ধ্রুব চলচ্চিত্রে নারদের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সে ছবিতে আঙ্গুরবালা ধ্রুব’র মা সুনীতির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন এবং গানও গেয়েছিলেন। তাদের এই আন্তরিকতা ছিল বহুদিনের। ১৯৭৪ সালে আঙ্গুরবালা দেবী কবিকে দেখতে এসেছিলেন ঢাকায়। কথা বলতে পারতেন না। কবি শুয়েছিলেন খালি গায়ে। তার বুকের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। আঙ্গুর বালা সেই ঘাম মুছে দিলেন, গান শোনালেন।
নজরুলের সম-সাময়িক প্রতিভাময়ী চলচ্চিত্র তারকা ছিলেন কানন দেবী। মেগাফোন রিহার্সাল রুমে তাদের প্রথম পরিচয় হয়। ঝাঁকড়া চুলের সুদর্শন নজরুল চোখ বুজে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছিলেন। কানন দেবী নজরুলকে দেখে আড়ষ্ট হয়ে যান। নজরুল চোখ খুলে সংকোচিত কানন দেবীকে দেখে সহজ ভাবে বললেন, ডাগর চোখে দেখছ কি মেয়ে! আমি হলাম ঘটক তা জানো? এক দেশে সুর থাকে অন্য দেশে কথা। এই দুই দেশের বর-কনেকে এক করতে হবে। কিন্তু দুটোর জাত-পাত আলাদা হলেই বে-বন্তি। বুঝলে কিছু? বলেই প্রাণখোলা হাসি দিয়ে সহজ করে দিলেন সবকিছু। প্রথম পরিচয়ে এমন সহজ রসিকতায় কানন দেবী ও খুব বন্ধু হয়ে গেলেন তার।
নিউ থিয়েটার্সের বিদ্যাপতি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে নায়িকা ও গায়িকা রূপে খুব খ্যাতি অর্জন করেছিলেন কানন দেবী। বিদ্যাপতির নায়িকা অনুরাধা চরিত্রটি কাহিনীতে সম্পৃক্ত করেন নজরুল ইসলাম। বলতে গেলে নজরুলের জন্যই তিনি বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। তারপর সাপুড়ে ছবিটির যে সাতটি গান ছিল তার ছয়টিই লিখেছিলেন নজরুল। সেখানে কানন দেবী গেয়েছিলেন, ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই এবং কইবে কথা কইবে না বউ’।
এরপর ফিরোজা বেগমের সাথে তার পরিচয়। ফিরোজা বেগমের বয়স তখন মাত্র বারো। ফিরোজা বেগম নজরুলের গানের রেকর্ড শুনে শুনেই গান শিখেছিলেন। গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডিং স্টুডিওতে নজরুলের নির্দেশে চিত্ত রায় একজন শিল্পীকে শেখাচ্ছিলেন মমতাজ, নুরজাহান, একাদশী চাঁদ এই গানগুলো। ফিরোজা বেগম তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানতেন না যে ইনিই নজরুল ইসলাম। যে শিল্পী কে তারা গান শেখাচ্ছিলেন তিনি তা ধরতে পারছিলেন না। তখন ফিরোজা বেগম তা ধরতে পেরে নিজেই গেয়ে শোনালেন। নজরুল ইসলাম অবাক হয়ে বললেন, দেখেছো মেয়েটা একেবারে রেকর্ডের মতো গায়’। সেই থেকে নজরুলের সাথে তার পরিচয়। ফিরোজা বেগমের প্রথম নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড ‘গগন গহনে সন্ধ্যা তারা’। নজরুল ইসলাম ফিরোজা বেগমকে বিশেষ স্নেহের চোখে দেখতেন। তিনি তখন নেহায়েত বালিকা। নজরুলের সুস্থ অবস্থায় আড়াই থেকে তিন বছর সময় তিনি তার সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। নজরুলের মোমের পুতুল ও দুর দ্বীপ বাসিনী ফিরোজা বেগমকে বিশেষ খ্যাতি এনে দেয়। এরপর ফিরোজা বেগম ও নজরুল সঙ্গীতের প্রচার ও প্রসারে ব্যাপক অবদান রাখেন।
কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি
|