আবৃত্তিকার মাহিদুল ইসলামের সাথে কিছুক্ষণ কাজী সুলতানা শিমি
বাংলাদেশের প্রথম সারির সম্পূর্ণ পেশাদার আবৃত্তি-শিল্পী হিসেবে মাহিদুল ইসলাম মাহি আবৃত্তি-অঙ্গনে এক পরিচিত নাম। আবৃত্তিকার মাহিদুল ইসলাম এসেছেন অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে, এই প্রথম বাংলাদেশের কোন পেশাদার আবৃত্তিকার শুধুমাত্র আবৃত্তি করার জন্য দেশের বাইরে এসেছেন। পেশাদার অনুষ্ঠানের বাইরে এক সন্ধ্যায় আলাপ হল আবৃত্তির ব্যাপারে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য নিয়ে।
একটি স্বতন্ত্র পেশাদার শিল্পমাধ্যম রূপে আবৃত্তি শিল্পের প্রতিষ্ঠায় তিনি নিরলস, নিঃশঙ্ক স্বপ্নচারী। তাঁর রয়েছে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ, আবৃত্তি উপযোগী কবিতা সংকলন এবং এ্যালবাম; নির্দেশনা দিয়েছেন দর্শক নন্দিত বেশ কয়েকটি শ্রুতি প্রযোজনার। প্রশ্নত্তোর সমন্বিত আলাপচারিতায় তিনি তার এই অস্ট্রেলিয়া আসার উদ্দেশ্য ও নানা পরিকল্পনার কথা জানান। তারই কিছু এখানে তুলে ধরছিঃ
প্রশ্নঃ অন্যান্য শিল্পমাধ্যমের পরিবর্তে আপনি আবৃত্তিকে শিল্পচর্চা হিসেবে বেছে নিয়েছেন কেন? প্রবাসে যেখানে বাংলা ভাষা চর্চাটাই ঠিক মতো হয়না সেখানে কবিতা ও আবৃত্তি চর্চা কতটা উপযোগী হবে বলে আপনি মনে করেন?
মাহিঃ ধন্যবাদ আপনাকে। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় জীবন যাত্রার মান বদলে যাচ্ছে। তারপর ও জীবন বোধ থেকে, ভালোলাগা থাকা থেকে এক ধরনের সংস্কৃতি-প্রীতি জন্ম নেয়। সেখান থেকে কবিতা ও আবৃত্তি-চর্চাকে শিল্পচর্চা হিসাবে বেছে নেয়া খুব একটি কঠিন কাজ কেননা এর কোন পেশাদারিত্ব নেই। জীবন জীবিকায় অর্থনীতির সম্পৃক্ততা অনিবার্য। তাই কবিতা যে একটি অন্যতম শিল্পমাধ্যম তা প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এতে পেশাদারিত্ব অর্জন প্রয়োজন। আর এই পেশাদারিত্ব অর্জনের চেষ্টা নিয়েই আবৃত্তিকে শিল্পচর্চা হিসেবে বেছে নিয়েছি।
প্রবাসে বাংলাভাষা চর্চাটা কম বলেই তো একে প্রসারিত করার চেষ্টা এখন থেকেই করতে হবে তা না হলে আগামী প্রজন্ম তার শেকড় ভুলে যাবে। আর শুদ্ধ বাংলা চর্চার জন্য প্রয়োজন কবিতা ও আবৃত্তি-শিল্পের প্রসার ও পেশাদারিত্ব অর্জন। মেধাবী আবৃত্তিকারীরা টেলিভিশনে সংবাদ পড়ছে, অভিনয়, উপস্থাপনা সহ অন্যান্য শিল্প মাধ্যমকে পেশা হিসাবে গ্রহণ করছে কিংবা যে কোন পেশায় শুদ্ধ উচ্চারণ প্রয়োগ করতে পারছে তাতে করে বাংলা ভাষার সঠিক ও নির্ভুল ব্যাবহার হচ্ছে। তাই কবিতা ও আবৃত্তি চর্চা দেশে বিদেশে সব ক্ষেত্রেই পেশা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানো দরকার।
প্রশ্নঃ অস্ট্রেলিয়ায় যে কয়েকটি অনুষ্ঠানে আপনি আবৃত্তি করেছেন তাতে তরুণদের বা এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের উপস্থিতি কেমন ছিল? বাংলা কবিতা ও আবৃত্তির প্রতি তাদের উৎসাহ কেমন মনে হয়েছে আপনার কাছে?
মাহিঃ আসলে সিডনীর বাইরে নিউক্যাসেল ও ক্যানবেরায় তুলনামূলক ভাবে বাংলাদেশী অনেক কম। তারপরও সবার মাঝে কবিতা ও আবৃত্তি শোনার যে আগ্রহ ও উদ্দীপনা আমি দেখেছি তাতে আমি আশাবাদী। ছোট-বড় সবাই এক ঘণ্টার কবিতার অনুষ্ঠানে আড়াই ঘণ্টা শোনার পর আরও কবিতা তারা শুনতে চেয়েছে। বিষয়টা আমাকে অভিভূত করেছে। তারমানে কবিতার জনপ্রিয়তা সবখানেই আছে। সুতরাং একে পেশাধারী শিল্পমাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ রয়েছে।
প্রশ্নঃ কবিতা ও আবৃত্তিকে পেশাধারী শিল্পমাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার পরিকল্পনা হিসাবে আপনি কি ধরণের পদক্ষেপ নিয়েছেন?
মাহিঃ আমি যখন প্রথম মফঃস্বল শহর ফকিরহাট থেকে ঢাকায় এসেছি তখন আমার কবিতা পাঠের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছিল না। আমি স্ব-শিক্ষিত কবিতা আবৃত্তিকার। চেষ্টা আর সাধনা থাকলে গতি, স্বরের স্তর ও স্বরের জন্য আবেগ নির্বাচন করে একজন সফল আবৃত্তিকার হওয়া মোটেই কঠিন কিছু নয়। কণ্ঠস্বরের কারুকাজ দিয়ে শ্রোতাদের মনে দাগ কাটা বাস্তবিক ভাবে অতি কঠিন সাধনার কাজ। কীভাবে একটি নিদিষ্ট ছন্দের কবিতাকে শ্রুতি মধুর করা যায় সেটিই আবৃত্তি-শিল্পের সাফল্যের মূল কাজ । আমি বিশ্বের বিভিন্ন শহরে বেশ কিছুদিন করে অবস্থান নিয়ে নামমাত্র মূল্যে কিংবা বিনামূল্যে কর্মশালা, আবৃত্তি-ক্লাস ও আবৃত্তি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই শিল্পকে পেশাদারিত্ব অর্জনের পদক্ষেপ নিয়েছি। তারই অংশ হিসাবে এখানে আসা।
প্রশ্নঃ কবিতা ও আবৃত্তির জন্য আপনার এই যে আন্দোলন তা আপনার পারিবারিক জীবনে যে প্রভাব পড়ছে তা আপনি কি ভাবে মোকাবেলা করছেন?
মাহিঃ চমৎকার প্রশ্ন। সত্যি বলতে কি আমার পরিবারের সম্পূর্ণ সমর্থনের ফলে আজ আমার এতো দূর আসা। আমার ব্যক্তিগত চাকরী ও ব্যবসা বাদ দিয়ে শুধু কবিতা ও আবৃত্তির পিছনে সময় দেয়া পারিবারিক সমর্থন ছাড়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়। সে দিক থেকে আমি সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি। এই যে দু'সাপ্তাহ ধরে অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে কাজ করে যাচ্ছি ঢাকায় কি হচ্ছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছেনা সেটা অনেক বড় ব্যাপার যে কোন সাফল্যর জন্য।
প্রশ্নঃ এই কবিতা ও আবৃত্তিকে পেশাদারিত্ব অর্জনের স্বপ্ন পূরণে প্রবাসী সংগঠনগুলো আপনার আন্দোলনে কিভাবে সমর্থন দিতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
মাহিঃ দূর প্রবাসে থাকার অজুহাতে কবিতা পাঠের প্রতি অনাগ্রহ হলে চলবে না। অস্ট্রেলিয়ায় যে প্রবাসী সংগঠনগুলো আছে তাদের জোরালো সমর্থন ছাড়া কবিতা ও আবৃত্তির পেশাদারিত্ব অর্জন সম্ভব নয়। আমি আশা করবো সংগঠনগুলো যেন পরস্পর সৌহাদ্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখে, কেউ কারো সাথে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত না হয় এবং যে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজনে সম্পূর্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ সহায়তায় একে অপরের জন্য এগিয়ে আসে।
সংক্ষিপ্ত ভাবে এই ছিল তার অস্ট্রেলিয়ার আসার মূল কারণ। অত্যন্ত বন্ধু বৎসল ও সদালাপী মাহিদুল ইসলাম মাহি’র আরও অনেক আলাপচারিতায় কবিতা ও আবৃত্তির জন্য তার বিভিন্ন পরিকল্পনা ও স্বপ্নের কথা বলেন। সেই নব্বইয়ের গণআন্দোলনের সময় থেকে বাংলাদেশের আবৃত্তি অঙ্গনের অন্যতম সাহসী অভিযাত্রী মাহিদুল ইসলাম মাহি। একক ও যৌথ মিলিয়ে তার অর্ধশতেরও বেশি এ্যালবাম বাজারে এসেছে। এরমধ্যে মেঘ বালিকার জন্য রূপকথা, ‘সুবর্ণ সেই আলোর রেখা’, ‘নীরা এবং অন্যান্য’, ‘বাজুক বীণা অগ্নিবীণা’, ‘তুমি সুন্দর আমি ভালবাসি’, ‘বিলুপ্ত হৃদয়ে আরক্ত প্রেম’, ‘ছাড়পত্র’, ‘কিংবদন্তীর কথা বলছি’, ‘তোমার জন্য লিখি তোমাকে লিখিনা’ ইত্যাদি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আবৃতিকে পেশাদারী শিল্পে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন নিয়ে এই প্রথম তিনি অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে কয়েকটি আবৃতি-সন্ধ্যায় আবৃত্তি করেন। তার এই আগমন কবিতা ও আবৃত্তি-শিল্পের প্রসার এবং চর্চা সহ আরো অনেক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ একটা মাইল ফলক।
|