bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













প্রেরণার নজরুল
কাজী সুলতানা শিমি


কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার বা লেখার নেই। তাকে নিয়ে এতো গবেষণা ও লেখালেখি হয়েছে যে বাড়তি আর কিছু বলার কোন প্রয়োজন হয়না। তবু কিছু কথা আমার অনেক দিন থেকেই খুব লিখতে ইচ্ছে করছিল - সেটা হলো তাঁর আটপৌরে সাদাসিধে জীবন কীভাবে তাকে একজন কিম্বদন্তী করে তুলেছিল!
আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামের অতি সাধারণ ছেলেটি কিভাবে বাংলা সাহিত্য ও জাতীয়তাবাদে একটি মহীরুহ হয়ে উঠেছিলো তা নিয়েই আমার কৌতূহল। অভিজাত পরিবার বা আর্থিক সচ্ছলতা ছাড়া সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম দিয়ে কি করে প্রতিকূল পরিবেশে নিজের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে হয় কাজী নজরুল তার উজ্জ্বল উদাহরণ। আজ তাঁর সাহিত্য বা রচনা নিয়ে নয় ব্যক্তি জীবনের সংগ্রামী সময় নিয়ে কিছু কথা।

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের জাতীয় কবি। তাঁর রচিত “চল্‌ চল্‌ চল্‌, ঊর্ধ্বগগনে বাজে মাদল” বাংলাদেশের রণসঙ্গীত। বাংলা-সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদে নজরুলের অবদান অনস্বীকার্য। আর সেকারণেই তাঁর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী বিশেষভাবে আমাদের কাছে স্মরণীয়। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে নজরুলের নানা অবদানের কারণে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায় ২০০৫ সালে “জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়” নামক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কবির স্মৃতিতে স্থাপিত হয়েছে নজরুল একাডেমী এবং বাংলাদেশ নজরুল সেনা । এছাড়া সরকারীভাবে স্থাপিত হয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নজরুল ইন্সটিটিউট- ঢাকা শহরের একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ।

কাজী নজরুল ইসলাম উচ্চতর প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা অর্জন ব্যতীত অত্যন্ত বৈরী পরিবেশে বেড়ে উঠেও কেমন করে তিনি বিশাল এক সামাজিক বিপ্লবের ধারক হয়েছিলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। এ প্রসঙ্গে তাঁর জন্ম ও তাঁর বড় হয়ে উঠার পরিবেশ সম্পর্কে একটু কিছু বলার ইচ্ছে হচ্ছে। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪মে, বাংলা জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে তাঁর জন্ম। দাদা কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তাঁর বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। শৈশবে কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল “দুখু মিয়া”। ছোটবেলায় নজরুল গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করেন। তখন থেকেই তিনি কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন শুরু করেন। যখন তাঁর বয়স মাত্র নয় বছর, ১৯০৮ সালে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়।

পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তাঁর লেখাপড়া বাঁধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে তাকে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয়। পাশাপাশি তিনি হাজী পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে কাজ শুরু করেন। এসব কারণে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তাঁর সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রতিফলিত হয়।

বাল্য বয়সেই তিনি লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো অর্থাৎ বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল দলে যোগ দেন। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। আর্থিক সমস্যা তাকে বেশী দিন পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। এরপর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন।

এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তাঁর বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। আসানসোলের চা-রুটির দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ'র সাথে তাঁর পরিচয় হয়। কাজ শেষে পরিশ্রান্ত অবস্থায়ও অবসর সময়ে নজরুল পুথি, বই ও নানা ধর্ম গ্রন্থ পাঠ সহ যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তাঁর প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। এভাবে ভেঙ্গে ভেঙ্গে তিনি মাধ্যমিক স্কুল পর্যন্ত পড়ালেখা সম্পন্ন করেন। এ পর্যন্তই ছিল তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা।

১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়। এর পর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ই আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দু'বার প্রকাশিত হতো। স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন-

“কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনে এই দুর্গ শিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।”

পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে সব সময় এই বাণীটি লেখা থাকতো। এতে করেই প্রমাণিত হয় রবীন্দ্রনাথের প্রতি নজরুলের এক অশেষ ভক্তি ও শ্রদ্ধা ছিল সবসময়।

১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। তাঁর সাথে তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন এখানে পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে। আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনে নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমীলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তাঁর প্রেমে পড়েন ও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

নজরুল সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন। তিনি তাঁর কর্ম ও অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির প্রয়াসে বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য পড়ার পাশাপাশি হিন্দু ধর্মগ্রন্থও অধ্যয়ন করেন। তিনি হিন্দু এবং মুসলিম রীতি মিলিয়ে তাঁর চার সন্তানের নামকরণ করেন। যেমনঃ কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ বুলবুল, কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৭৪ সালে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটার বাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করেন।

নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করছিলেন। এমন সময় অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবী চিকিৎসার জন্য লন্ডন যান। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর কবিকে পরীক্ষা করানো হয়। এর ফলাফল থেকে জানা যায় যে, তিনি পিক্‌স ডিজিজ নামক একটি নিউরন ঘটিত সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিস্কের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সংকুচিত হয়ে যায়।

১৯৭২ খ্রিস্টাব্দের ২৪মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাকি জীবন তাঁর বাংলাদেশেই কাটে। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তাঁর বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। একুশে পদক বাংলাদেশের সবচেয়ে সম্মানসূচক পদক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তাঁর একটি গানে লিখেছেন,

“মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই-
যেন গোরের থেকেও মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই”

কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তাঁর সমাধি রচিত হয়।

বাংলাদেশে তাঁর মৃত্যু উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয়। আর ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। কোন প্রকার প্রাতিষ্ঠানিক বা একাডেমীক পড়ালেখা ব্যতীত, আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা অভিজাত পারিবারের ছত্রছায়া ছাড়াও কাজী নজরুল যেভাবে বাংলা সাহিত্যে অনন্য অবদান রেখেছেন সেটা যুগ যুগ ধরে মানুষকে বিস্মিত করবে। ভাবতে অবাক লাগে জীবনভর শুধু সংগ্রাম আর বৈরিতার মধ্যে থেকেও কাজী নজরুল বরাবরই একজন সফল মানুষ। তাঁর এই সফলতা আর উদ্যম অনুপ্রাণিত করুক ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে, সব সময়।




কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 28-Aug-2015

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far