bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












সুন্দর ফন্টের জন্য SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন...


জিমি ও তার লাল গাড়ী
কাজী সুলতানা শিমি

মেঘে মেঘে অনেক বেলা। বৈরী বাতাস আর ধ্রুপদী বসন্ত পেরিয়ে কয়েক যুগ ওরা একসাথে। চাট্টি খানি কথা না। জিমি ও পিয়েরা। এইতো, আমার সামনের প্রতিবেশী। ইতালিয়ান। একটি লাল গাড়ী ওদের সার্বক্ষণিক গন্তব্যর বাহক। যতো বারই আমাদের দেখে, আঙ্গিনা ডিঙ্গায়- আলপিনও, আলপিনও বলে নেমে আসে। ইতালিয়ান ভাষায় আলপিনও মানে সৈনিক। আমার ছেলেটাকে সে আলপিনও ডাকে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জিমি ছিল ইতালিয়ান সৈনিক। গল্পটা তার কাছেই শোণা। যুদ্ধ শেষ, এখন বাড়ি ফেরার পালা। ইতালি তখন বিধ্বস্ত। যুদ্ধ শেষে যা হয়। প্রেয়সী পিয়েরা তার অপেক্ষায়। ঘর বাধবে ওরা, স্বপ্নের বীজ বোনা। পিয়েরা আর জিমি এক সুতোয় বাধা ঘুড়ী। মৃন্ময়ী সমীরণে আজ বর্ণিল স্বপ্নের ওড়া-উড়ী।

যুদ্ধ আর ধ্বংস সারা ইতালি এলোমেলো। জিমি আর পিয়েরা জাহাজে উঠে পরে অজানার উদ্দেশে। অগুনতি অপেক্ষার প্রহর আর বিনিদ্র রজনী পারি দিয়ে অবশেষে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি। ঠিক হোল ওরা এখানেই গড়বে নূতন ঠিকানা। নানা বিপত্তির পর অবশেষে স্থায়ী আবাস হলো গিলফোর্ড। প্রথমে এক টুকরো জমি আর একটি গোয়ালঘর শুধু। এছাড়া কিছুই নেই। তাতে কি, এটাই যথেষ্ট। ভালবাসা থাকলে বধ্য-ভূমিই হয় রাজপ্রাসাদ, ঝি ঝি পোকার শব্দ তখন নূপুরের ধ্বনি।

জিমি রাজ মিস্ত্রির কাজ পায়। আর পিয়েরা সারাদিন শুধু প্রহর গুনে জিমির ফিরে আসার। টুকটাক এটা সেটা ঘরকন্নার কাজ তো লেগেই থাকে সারা দিন ভর। বাইরে কাজ করার সময় কোথায়। জিমির একার আয় থেকেই তিল তিল জমিয়ে একদিন একটা পাকা ঘর তোলার স্বপ্ন দেখে এবার। আশায় বুক বাঁধে, হয়তো হবে। সেই থেকে শুরু। রাজ মিস্ত্রির কাজ শেষে বাড়তি ইট-কাঠ, টালি, সিমেন্ট যা পায় পিছনের উঠানে জমাতে থাকে। এরপর একদিন মিয়া-বিবি মিলেই বাড়ীর মূল ভিত তুলে। তখনো নগর পরিকল্পনা বা নকশা অনুমতি কিছুই ছিলোনা। প্রয়োজন ছিল শুধু মানুষ। মানুষ বাড়াবার কত আয়োজন, কতো আকুতি।

দিন যায়, নূতন বসন্ত আসে কিন্তু ওদের বাড়ি আর হয়ে উঠেনা। এরই মাঝে কোলে আসে মারিয়া। ফুটফুটে প্রজাপতি। উড়ে বেড়ায় উঠান-ময়। বাগানের চারা গুলো দলে যায় তার তুলতুলে পায়ের চাপে। গোয়াল ঘড়েই তার বেড়ে উঠা। অপেক্ষার পালা শেষ হয়না পিয়েরার, কবে শেষ হবে তার পাকা বাড়ী। মারিয়া তো বড় হয়ে যাচ্ছে। বুঝি এ জীবনে মারিয়াকে একটু ভাল ভাবে রাখা গেলনা। দীর্ঘশ্বাস জিমির বুকেও। শূন্যতা বাসা বাধে দিগন্ত জুড়ে। ছেলেদের কষ্ট বড় বেদনার, অব্যক্ত, জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার ভিতরে ভিতরে, বলা হয়না কিছুই।

অবশেষে প্রতীক্ষার পালা শেষ হয় একদিন। জিমি আর পিয়েরা মিলেই ছাদের টালি বসায়। রঙ এর ছোঁয়ায়, কাঠের দেয়াল আর টালির ছাদের সেই বাড়িই হয়ে যায় পিয়েরার প্রাসাদ। টগবগে কিশোরী। আনন্দ মারিয়ার চোখেমুখে, আহা যেন প্রাসাদের রাজকুমারী। আর জিমি, আত্মতৃপ্তির মহানায়ক আজ। চারিদিকে বিজয়ের হাতছানি, যেন আবারো যুদ্ধে জেতা সৈনিক। এভাবেই কেটে যায় অনেকগুলো বছর। বিরান প্রান্তর হয়ে উঠে লোকালয়, শূন্য ভূমি আবাসে আবাসে ভরে যায়, শুরু হয় মানুষের বিস্তৃত আনাগোনা। এরই মাঝে মারিয়া কিশোরী থেকে তরুণী, তরুণী থেকে আরও বয়স্বী হয়ে উঠে। একসময় সে তার নিজের ঠিকানা খুঁজে নেয়, একান্ত ঠিকানা। কিন্তু কি জানি কি হয়, বিয়ে করেনা। জিমি ও পিয়েরা অনেক পীড়াপীড়ি করে, রাজী হয়না কিছুতেই। অবশেষে ওরা ক্লান্ত। থাক, জোড় করে অনেক কিছুই হয়ত করানো যায়, কিন্তু বিয়ে অন্তত করানো যায় না। বিয়ে ব্যাপারটা এমনি-যা একান্ত অন্তর্গত, নিজস্ব। নিরন্তর কষ্ট পুষে রাখে বুকের ভিতর, যে কষ্ট বুঝেনা কেউ শুধু কষ্ট-পোষা’ যুগল ছাড়া।

সময়ের আবর্তে একদিন হয়ে গেলাম জিমি আর পিয়েরা'র প্রতিবেশী। মারিয়ার কোন ছেলেপুলে নেই। তাই আমার ছেলেটাকে আলপিনও বলে ডাকে। মনে করে নিজের নাতিপুতি। দুধের স্বাদ ঘোলে মিটানো আরকি। কিন্তু তা কি আর হয়, নিজের সত্তা পরের মাঝে খুঁজে পাওয়া কি এতই সহজ। তারপরও সান্ত্বনা। সান্ত্বনা খুঁজেই তো বেচে থাকে মানুষ। আমার ছেলেমেয়েও দাদা-দাদি মনে করে যাবতীয় অত্যাচার করে আসে যখন তখন। বিদেশ বিভূঁইয়ে এয়েই বা কম কীসে।

আমিও বিকেলটা কাটিয়ে আসি, মাঝে মাঝে। ওদের বিষাদ আনন্দের গল্প শুনি। মনে হয় মানুষ আসলে সবাই এক, শুধু চিত্রপট বিচিত্র। ওরা ইতালিয়ান আমি বাংলাদেশী। শুধু বর্ণ আর ভাষার তারতম্য, ভিতরে সবাই অবিচ্ছেদ্য দ্যোতনায় বাঁধা বিউগল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়। চৈতন্য ফিরে আসে, জিমির বোনা বাগান থেকে কিছু সবজি তুলে ফিরে আসি নিজের নীড়ে। বহু সন্ধ্যা বিকেল কাটিয়েছি এভাবে গল্প শুনে শুনে। আমার ব্যস্ততা বাড়ে, যাওয়া আসা কিছুটা শিথিল হয়ে আসে। এরমাঝে একদিন পিয়েরা অসুস্থ হয়ে যায়, অনেকটা কমা’য় চলে যাওয়ার মত। তাকে নার্সিং হোমে রেখে আসতে হয়। এখন জিমির একমাত্র কাজ পিয়েরাকে নার্সিং হোমে দেখতে যাওয়া। তার লাল গাড়িটাই এখন একমাত্র নিঃসঙ্গতার সঙ্গী। এর ফাঁকেও সে আমার ছেলে-মেয়েকে একবেলা দেখে যায়, চিপস চকলেট এটা সেটা হাতে দিয়ে যায়। তার রুটিনে কোন অনিয়ম নেই।

একদিন, এক কুয়াশা ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমি বারান্দায় যাই। আমার দোতলা বারান্দা থেকে জিমির নিকনো উঠান চোখে পরে। বাহারি ফুলের সমাহার, চকচকে ঘাসের গালিচা। তকতকে সবকিছু। আজ দেখি একটা এ্যাম্বুলেন্স পার্ক করা। আমি দোতলার রেলিং ধরে এ্যাম্বুলেন্সটা দেখছি। দেখি প্যারামেডিক্স সামনের দরজার কড়া নাড়ছে। অনেকক্ষণ ধরেই নাড়ছে। কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাচ্ছেনা। সাড়া শব্দ না পেয়ে সে বা-দিক দিয়ে ছোট গেট টপকিয়ে পিছনের দরজায় গেলো। সেখানে ও জোড়ে জোড়ে নাড়ছে। দরজাটা জিমির বেডরুম লাগোয়া। জিমি ঘড়ে থাকলে এতো জোড়ে শব্দ, না শোনার কথা না। জিমির কিছু হলনা তো! আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। প্যারামেডিক্স অনেক জোড়ে কড়া নাড়ছে, বলতে গেলে প্রায় ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম। এবার আমি শঙ্কিত বোধ করলাম। দৌড়ে এসে বাচ্চাদের বাবাকে বললাম, অ্যাই দেখত জিমির কি হয়েছে। ঝটপট উঠে বসল সে, চোখে তখনো ঘুম। বলল, কি বলছ এসব। আমি বললাম, যাও তো দেখে আসো আগে কি হয়েছে। এরই মধ্যে পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেড, আশে-পাশের লোকজন, ভিড়-জটলা সব মিলে হুলুস্থুল অবস্থা। আমার বাচ্চারাও তাদের বাবার সাথে জিমির বাসার সামনে। পুলিশ দরজা ভাঙছে। আমার অনুমান সত্যি হলো, জিমি নেই।

পুলিশ মারিয়াকে খবর দিয়েছে। মারিয়া এসেছে। সে কাঁদতে কাঁদতে পড়ে যাচ্ছে, তাকে ধরে রাখা হয়েছে। চারিদিকে এত জটলা তবু ও আমার ভিতরে এক হিম শীতল অনুভূতি শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। বিবশ করে দিলো সমস্ত শরীর। আমি দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লাম। আমি কি দেখছি, দৃশ্যটা আমার কাছে অবাস্তব মনে হোল। জিমি নেই। শুধু তার নিথর শরীর। দৃশ্যত অসাড় শরীর মানুষকে মৃত বানিয়ে দেয়। শুধু শরীর আর দেহ-ই কি আসল মানুষ। তার যাবতীয় অতীত উপস্থিতি কি কিছুই না। না আমি কিছু দেখতে চাইনা। তার নিথর শরীর দেখে আমি ওকে মৃত মনে করতে চাইনা। কল্পনায় আমি তার লাল গাড়ী দেখি, জানালার কাঁচ নামিয়ে বিস্তৃত হাসিতে হাত নাড়ছে। জিমি সে ভাবেই বেঁচে থাক তার অতীত অস্তিত্ব নিয়ে। আমি বারান্দা থেকে সরে আসলাম। একা একা চলে যাওয়া, সব কিছু ফেলে - এ কেমন বিদায়!

তার কিছুদিন পরই খবর আসে পিয়েরা ও মারা গেছে। নার্সিং হোমে, মারিয়ার সামনেই। নার্সিং হোমে এতদিন হয়ত জিমির জন্যই বেঁচে ছিল। জিমি আর পিয়েরা, একি তবে অবিদিত সুতোর টান। হবে হয়তো। প্রেম এক অসংজ্ঞায়িত নিয়তির নাম, কোন বিবরণেই যার হয়না প্রকাশ। আমি ওদের যুগল-ছবি দেখি, দিব্য-দৃষ্টিতে। বুঝিবা এখনি এসে আলপিনও আলপিনও বলে ডাকবে। কিন্তু ওরা আসেনা। শুধু শূন্য ঘড়, নিকনো উঠান, বাহারি ফুল আর একটি লাল গাড়ী। আমার বিকেলগুলো বড় বেশী নির্লিপ্ত, নির্জীব। ওদের অসাড়, নিথর দেহ দেখিনি, ওরা বেঁচে আছে আমার কল্পনায়! মনের গহীন কোণে এক অশরীরীয় অনুভব- ওরা আসবে, আজ নয় হয়ত অন্য কোন দিন!




কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি - দার্শনিক ও গবেষক






Share on Facebook               Home Page             Published on: 23-May-2015

Coming Events:
বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে মেলার তারিখ ১ দিন পিছিয়ে ২১ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার) করা হয়েছে......




A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far