যাপিত জীবনের শূন্যতা কাজী সুলতানা শিমি
জুম অপশন থাকার পরও প্রতি মঙ্গলবার একদিন ক্যাম্পাসে যাই। ইচ্ছে করেই যাই। মানুষ দেখি। আর মানুষের সাথে কথা হবে তার প্রস্তুতি নিই। তাই। এজন্য এনুয়্যাল লিভ থেকে সপ্তাহে একদিন ছুটি বন্দোবস্ত করেছি বছর জুড়ে। বাসা থেকে দশ/পনের মিনিটের হাঁটা পথ গিল্ডফোর্ড ষ্টেশন। অনেকে ষ্টেশনে গাড়ী রেখে যায়। তা আমি করিনা। হাঁটতে হাঁটতে গেলে একসাথে দুটোই হয়। রথ দেখা কলা বেচা আরকি। এক্সারসাইজটা হলো, চোখটাও নিস্তার পেলো যান্ত্রিক স্ক্রিন থেকে। যদিও এটাই এখন সংস্কৃতি বা ফ্যাশন! গিল্ডফোর্ড ষ্টেশন থেকে সেন্ট্রালে যাবো। ষ্টেশনে পৌঁছে ওপালকার্ড বের করলাম। ষ্টেশনের ঘড়িতে সকাল আটটা। আর দু’মিনিটের মধ্যেই ট্রেন এসে যাবে। হাল্কা শীতের সকাল। ষ্টেশনের বাকি যাত্রীরা ভারী কাপড় পরলেও কারো মুখে মাস্ক নেই। তবু মাস্ক বের করলাম আমি। এই সময়টায় বাধ্যতামূলক না হলেও পাবলিক স্পেসে মাস্ক পরতে জোর অনুরোধ করা হচ্ছে। এজন্য পাবলিক এনাউন্স করা হচ্ছে বার বার। সবুজ বৃত্তের উপর সাদা টিক চিহ্ন দেয়া জায়গায় দাড়াতে মার্ক করে দেয়া হয়েছে। দেড় মিটার দূরত্বে থাকার সাংকেতিক ছবিও দেয়া জায়গায় জায়গায়। ট্রেনের সিটে সবুজ-বৃত্তের সাদা দাগে দূরত্ব নিয়ে বসতে হবে। গাদাগাদি ভিড় এড়াতে বেশী ট্রেন, কম যাত্রী নিয়মে যাতায়াত ব্যবস্থা চালু হয়েছে। পৃথিবীটা চোখের সামনে কেমন বদলে গেলো! কাছাকাছি থাকা যাবেনা। আলিঙ্গন, কোলাকুলি কিংবা হ্যান্ডশেক করা যাবেনা। পরস্পর দূরত্ব বজায় রাখতে সতর্কতা সবখানে। মানুষ এড়িয়ে চলা। আরও কতো কি! এতকাল যা করেছি, দেখেছি, এখন সব উল্টা নিয়ম। এ যেন নতুন পৃথিবীর নতুন নিয়ম। এ নিয়মই বুঝি স্থায়ী হতে যাচ্ছে। কে জানে! গত ক’দিন রমজানের জন্য ভোররাতে সেহরিতে উঠার পর বাকি ঘুমটুকু হয়ে উঠেনি। অবশ্য এমনিতেও ভোরে উঠা অভ্যাস। সেহরি শেষে টিভিতে ভোর পাঁচটার নিউজ দেখছিলাম সেদিন। ইন্ডিয়াতে প্রতি চার মিনিটে একজন করে মানুষ মারা যাচ্ছে করোনায়। শ্মশানে লাশের সারি। ধোঁয়া আর আগুনে চারপাশ বিবশ। মানুষের হাহাকার। বেঁচে থাকা মানুষের সারি দেখেছি অহরহ। কিন্তু লাশের সারি দেখিনি কখনো। আহারে মানুষ! মরার পরেও সারিবদ্ধ অপেক্ষা। নিথর দেহ পুড়বার অপেক্ষা। কি এক পৃথিবী! কি এক জীবন!
ট্রেনে ভিড় নেই। শুধু যে ক’জন মানুষ উঠা যাবে সে পরিমাণ মানুষ উঠেছে। অন্যরা পরের ট্রেনের জন্য রয়ে গেছে। গ্রানভিল ষ্টেশনে অনেকেই নেমে গেলো। আবার উঠলো ও অনেকে। এই উঠানামার দৃশ্য আমি ভীষণ মনোযোগ নিয়ে দেখি। আমার পাশের সীটে বসেছিলো যে মানুষ, অনেকটা সময় কাছাকাছি থেকেছি। অথচ আর কক্ষনো দেখা হবেনা আমাদের। প্রতিটা মুহূর্ত যেমন হারিয়ে যায় এই মানুষগুলো চলে যাবার ব্যাপারটা যেন এমনই। প্রতিটা ষ্টেশনে মানুষের আনাগোনা আর যোগবিয়োগ নিবিষ্ট মনে দেখতে দেখতে সেন্ট্রালে পৌঁছে গেলাম। নামতে হবে আমাকেও।
সেই গতবছর থেকেই দেখছি রেনোভেশানের কাজ চলছে সেন্ট্রাল ষ্টেশনে। তাই একেকদিন দেখি একেকদিক দিয়ে বেরুবার পথ। বিশাল আকৃতির মনিটরে ট্রেন চলাচলের সময়সূচী, প্লাটফর্ম নাম্বার সেইসাথে ট্রেন আসা যাওয়ার ব্যাপার গুলো এনাউন্স হচ্ছে অনবরত। আমি তাড়াহুড়া করিনা। এই ষ্টেশনের প্রতিটা বিষয় দেখতে আমার কেন জানি খুব ভালো লাগে। ঠিক ভালোলাগারও বেশী বলা যায়। আসলে উপভোগ করি। পরিছন্ন। হকারের উৎপাত নেই আবার গমগমে পরিবেশ। দোতালার মেইন-গেট দিয়ে বেরুলে বেশকিছু খাবারের দোকান। হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকলে মাঝে মাঝে এগ-মাফিন আর কফি নিয়ে বসি সেখানে। বিশাল আকারের একটা এনালগ ঘড়ির কাটা টিকটিক করে সময় হারাবার জানান দিয়ে যায়। বেশ খোলামেলাও।
হাতে তেমন সময় নেই। বা’দিকের গেট দিয়ে বেড়িয়ে আবার বা’দিকেই হেঁটে চললাম। বেরুবার সময় দেখলাম টিভি ক্যামেরার লোকজন। লোকজনের আসা-যাওয়া রেকর্ড করছে। আবার কাউকে কাউকে এটা সেটা জিজ্ঞেসও করছে। টিভিতে দেখি জৌলুসময়। বাস্তবে অতি সাধারণ আয়োজন। শুধু রিপোর্টার মেয়েটাই একটু সেজেগুজে আছে। অবশ্য অন্যান্য যাত্রীদের সাজের কাছে তার সাজসজ্জা তেমন আহামরি কিছু না। টিভি পর্দা আর বাস্তবের রেকর্ডিং দুয়ের মাঝে অনেক ফারাক। ষ্টেশন থেকে বেরিয়ে পথচারী পারাপারের দিকে এগুচ্ছিলাম। সুন্দর ঘাসকাটা লনে একজন গৃহহীন মানুষ শুয়ে আছে। তার পোশাক-আশাক ছেঁড়া ও মলিন কিন্তু হাতে দামী মোবাইল। সে মোবাইলের ভিতর ডুবে আছে। আশেপাশে কি ঘটছে সে ব্যাপারে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। গৃহহীন একজন মানুষ মোবাইলে কি করতে পারে ব্যাপারটা ভাবতে ভাবতে রাস্তা পারাপারের ওখানে দাঁড়ালাম। এখন আর পারাপারের জন্য বাটনে চাপতে হয়না। সময় মতো আপনাআপনিই বেজে উঠবে। তখন রাস্তা পার হতে হবে। করোনার কারণে কারো হাতের স্পর্শ যেন না লাগে সেজন্য এই নতুন পরিবর্তন।
সেন্ট্রাল থেকে প্রায় পনের মিনিট হাঁটা পথ নটর ডেম ইউনি ক্যাম্পাস। হাঁটতে হাঁটতে বাস-ষ্টেশন পার হচ্ছিলাম। বাস-ষ্টেশনের বা’দিকে একটা জুসের দোকান। সাধারণতঃ ওখান থেকে একটা ‘টেরোজুস হাফ সুগার নো আইস’ কিনে হাঁটতে থাকি। দোকানের বিক্রেতা তা জানে। একজন লোকই থাকে প্রতিবার। চশমা পড়া মাঝারী উচ্চতার। বেশ ভদ্রগোছের। সম্ভবতঃ তার নিজের দোকান। ইউটিএস পার হয়ে আরও খানিকটা পথ হাঁটতে হয়। পাশাপাশি অনেকেই হাঁটছে। এখন কারো কারো মুখে মাস্ক আছে।
ছিমছাম পরিবেশ। সিডনীর ব্যস্ত রাস্তায় হঠাৎ করে এমন নিরিবিলি পরিবেশ সচরাচর আশা করেনা কেউ। ক্লাসিক্যাল। লাইসিয়াম আদলে সাজানো। মনে হয় প্রাচীন গ্রীক সময়ে আছি। গাছপালার ছায়ায় চার্চের বেদীতে বসলাম। অন্য সবাই এই পথেই আসবে। দুদিকেই গেট। একদিকে ‘এথিক্স এন্ড সোসাইটি ইন্সটিটিউট’ অন্য গেটে ‘সেইন্ট বেনেডিক্ট চার্চ’। ‘ফিলোসফি এন্ড থিওলজি’-স্কুল একটু দূরে। ক্যফেটরিয়া পার হয়ে। ইউটিএস’-এর ঝকঝকে তকতকে অত্যাধুনিক অট্টালিকার ঠিক উল্টো পাশে একেবারে খৃস্টপূর্ব যুগের ঝিমধরা পরিবেশ। এ যেন সিনেমার শুটিং স্পট। কিন্তু বাস্তব। ছুটে চলা যান্ত্রিক মুখোশ থেকে কিছুটা সময় এখানে কাটাতে ইদানীং বেশ লাগে কিন্তু!
দোতালায় আমাদের আলোচনা হবে। স্টিফেন এগিয়ে আসছে আমাকে দেখে। একই বিষয়ে রিসার্চ আমাদের। রিসার্চের বিষয়, জীবনে ও সমাজে নীতি-বোধ হারিয়ে গেছে তা পুনরুদ্ধার করার উপায়। স্টিফেন একজন প্রিস্ট। একজন প্রিস্টের জীবনবোধ থেকে তার নীতিবোধের ধারণা নিয়ে আলাপচারিতা থেকে অনেক কিছু জানতে পারি। উদার ভাবনা-চিন্তার দিক থেকে মানুষ এখনো খুব পিছিয়ে আছে। একজন প্রিস্ট এর পিএইচডি করার ইচ্ছা দেখে খুব আপ্লুত হলাম। নটরডেম ইউনিভার্সিটি মুলতঃ ক্যাথলিক হলেও সবার জন্য উন্মুক্ত। যে বিশ্বাসেরই হোকনা কেন সকলকে স্বাগতম এখানে। আমাদের দেশের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে এ ব্যাপারটা আছে কিনা আমার জানা নেই। এই উদার ও উন্মুক্ত মানসিকতা তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয় গুলোই বা কতোটুকু ভূমিকা রাখছে সেটাও এখন কিছুটা ধোঁয়াটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে কমপেয়ারিটিভ রিলিজিয়ন নামে একটা বিভাগ খুলেছিল। ফিলোসফি বিভাগের কিছু উদ্যমীর উৎসাহে। এই বিভাগ পরবর্তীতে কি কাজ করেছে তা আর জানতে পারিনি। পরবাসী হবার কারণে।
হিলারিকে এগিয়ে আসতে দেখছি। সে-ই ব্লু-মাউন্টেন থেকে সকাল সাতটার ট্রেন ধরে সে ক্যাম্পাসে আসে। তার জন্য নিশ্চয়ই খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়। বয়েস প্রায় সত্তরের কাছাকাছি। একজন সিনিয়র সাইকোলজিস্ট। তার নিজের প্র্যাকটিসের সেই বস। সত্তরের কাছাকাছি একজন সিনিয়র সাইকোলজিস্ট এই সময়ে পিএইচডি করার আগ্রহ দেখে আমি হারিয়ে ফেলা উদ্যম ফিরে পাই। তাও আবার ফিলসফিতে! এই ভদ্রমহিলার সারাক্ষণ প্রশ্ন করার প্রবণতা আমাকে মুগ্ধ করে। আমি বেশীর ভাগ সময় তার পাশেই বসি এবং তার কৌতূহল দেখে মোহিত হই।
আজকের আলোচনার বিষয় ছিলো এরিস্টটলের নীতিবিদ্যা ও পদার্থবিদ্যা। গতানুগতিক আড্ডায় এই ব্যাপারগুলো যদি আলোচিত হতো চিন্তা ও মননের উৎকর্ষতা বহুগুণ প্রসারিত হতো বলে মনে হয়। আজকাল আমন্ত্রণ, নিমন্ত্রণ কিংবা মজলিশে গঠনমূলক আলোচনা খুব একটা দেখিনা। তৃষ্ণার্ত বোধ করি এই শূন্যতার!
কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি
|