ঢাকার পঞ্জিকা - ৪ কাজী সুলতানা শিমি
ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক প্রকল্পটি যে ‘দেশের ভিতরে দেশ’-এ রকম একটা পরিবেশ তৈরি করে রেখেছে সেটা নিজে না থাকলে দেখা বা জানা হতোনা। তুলনামূলক নিরাপদ ও নিরাপত্তা বেষ্টনীতে সবদিক ঘেরা। বিদেশী মোটরওয়ের আদলে তৈরি তিন’শ ফিট বসুন্ধরা মেইন গেট দিয়ে ঢুকার সময় রূপায়ন টাওয়ারের তেরো তলার উপর রেস্তোরার বাতায়ন থেকে বাইরের দৃশ্য দেখলে মন আত্মবিশ্বাসে ভরে উঠে। তুমুল ভালো লাগায় বুকের ভিতর তিরতিরে হাওয়া বয়। অজান্তেই হাজার তারের বীণা বাজে! এতো মনোরম আমার দেশ!
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ৩০শে জুন রবিবার কুমিল্লার চান্দিনা থেকে সরাসরি ঢাকায় বসুন্ধরা বাসায় উঠলাম আম্মাকে নিয়ে। বাসাটা এফ ব্লকের এগারো নাম্বার রোডে। কুড়িল-কুড়াতলী’ ফ্লাইওভার থেকে বেড়িয়ে তিন’শ ফিট বসুন্ধরা মেইন গেট দিয়ে আসতে হবে। আগাখান একাডেমী’র পাশ দিয়ে কিছুদূর এগুনোর পর রূপায়ণ রিয়েল এস্টেট শপিং সেন্টার ও স্বপ্ন গ্রোসারী চেইন শপ পার হলেই সাদেক রোড দিয়ে ঢুকতে হবে। ঢাকায় এই আবাসিক এলাকাটিকে এখনো নিরাপদ এলাকা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে বসুন্ধরা ওয়েলফেয়ার সোসাইটির’ অনুমোদন ছাড়া বাইরের কোন রিক্সা বা ভ্যান প্রবেশ নিষেধ। পুরো এরিয়াতে দীর্ঘ ওয়াল এবং প্রতিটি গেইটে চব্বিশ ঘণ্টা প্রহরী বসা পাহারায়।
বসুন্ধরা এরিয়া বাউন্ডারির ভেতরে প্রতিটি রিক্সায় এবং চালকের পরিহিত আলাদা কটিতে রিক্সার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার ও বসুন্ধরা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি’-লেখা থাকে। এরা শুধু এলাকার ভিতরেই রিক্সা চালাতে পারবে এরিয়ার বাইরে যেতে পারবেনা। রিক্সাগুলোতে বিশেষ নাম্বার দেয়া এবং তাদের পরিচিতি ম্যানেজমেন্ট কতৃর্ক রেজিস্ট্রেশন করা। রিক্সা ভাড়া নির্ধারণ করা আছ তিরিশ টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা, ব্লক অনুযায়ী। তবে কেউ বেশী দিতে চাইলে সেটা যাত্রীর ইচ্ছা। অল্পসল্প বাজার করার জন্য কোন খুচরা মুদির দোকান নেই। ভ্যানে চেঁচামেচি করে কিছু বিক্রি করার অনুমতি নেই। কেনাকাটার প্রয়োজন হলে এরিয়ার বাইরে যেতে হবে তাও আবার এরিয়ার বাইরে হলে রিক্সা পাল্টাতে হবে। বাইরে যেতে না চাইলে এরিয়ার ভিতরে যে দু’একটা গ্রোসারী চেইন বা শপিং সেন্টার আছে বসুন্ধরা অনুমোদিত, শুধু সেগুলো থেকেই কেনাকাটা করা যাবে। সিডনির আলডী’ কিংবা ফুডওয়ার্ক’ এর মতো ‘স্বপ্ন’ নামে গ্রোসারী চেইন বাংলাদেশের সব জায়গায় এমনকি মফস্বল শহরেও শাখা খুলেছে। সেখানে অপেক্ষাকৃত ভালো কোয়ালিটি কিন্তু দাম বেশী দিয়ে ঝামেলা ছাড়া বাজার করা যায়। মেইন গেট-এ একটা স্বপ্ন’ গ্রোসারি শপ আছ। আমি যে বাসাটা নিয়েছি সেটা দোতলায়, তিন বেডরুম। কম্বাইন্ড ড্রয়িং-ডাইনিং ছাড়াও আলাদা ছোট্ট একটা রান্না ঘর এবং দুইটা ওয়াশরুম আছে। পরিচ্ছন্ন এবং সামনে বেশ খোলামেলা। মেইন বেডরুম লাগোয়া বারান্দা ছাড়াও বাইরে বাড়তি বড়ো আরেকটা খোলা বারান্দা আছে। আম্মা ও আমি মাত্র দু’জন থাকার জন্য যথেষ্ট। এই এলাকাটি বাইরের দেশের আবাসিক এলাকাগুলো অনুকরণ করে এরিয়া নকশা করার চেষ্টা করেছে। ফলে প্রতিটি বাড়ির সামনে গাড়ী চলাচলের পর্যাপ্ত জায়গা রেখেছে। গেটে রয়েছে বিরতি বিহীন পালাক্রমিক দারোয়ানের পাহারা। প্রথমে মেইন গেট পরে বিল্ডিং গেট পেরিয়ে সহসা চুরি কিংবা অন্য কোন ঝামেলা হয়না বলে অনেকেই জানিয়েছে। সব’চে স্বস্তির ব্যাপার হলো রাতে মশারী টানাতে হয়না। প্রতি সন্ধ্যায় এলাকা জুড়ে মশার ঔষধ স্প্রে করা হয়। অনেক বছর মশারী না টানানোর কারণে মশারী দেখলে আমার কেমন জানি দম বন্ধ লাগে এবং ঘুমাতে পারিনা।
এই বাসা থেকে এআইউবি ক্যাম্পাস রিক্সা দিয়েই যাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হলো বসুন্ধরা গেট পার হয়ে আরেকটা রিক্সা বদল করতে হয়। ক্যাম্পাসটি কুড়িল-কুড়াতলী’ সীমানায় হওয়ায় এই বিড়ম্বনা। তবুও নিরাপদ ও নিরাপত্তার জন্য বসুন্ধরা সীমানায় বাসাটা নেয়া। যাইহোক সীমানার মেইন গেটের মধ্যে একদিকে যমুনা ফিউচার পার্ক গেট, অন্যদিকে এভারকেয়ার(পূর্বের এপ্যেলো) হাসপাতাল গেট, এছাড়া আছে তিন’শ ফিট মেইন গেট। এই গেটগুলো পর্যন্ত গিয়ে রিকশা বদলাতে হবে। উবার কিংবা সিএঞ্জি হলে বদলাতে হবেনা। রিক্সা করে যাওয়া যায় কাছাকাছি বড়ো শপিং মল হচ্ছে ‘যমুনা ফিউচার পার্ক শপিং সেন্টার’। এটাই সম্ভবতঃ এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশে সব’চে বড়ো শপিং মল। ভেতরটাও একদম বাইরের দেশের মতো। সেখানে ‘হোলসেল’-নামে একটা গ্রোসারী শপ আছে যেটা অনেকটা অস্ট্রেলিয়ার উলওয়ার্থের’ মতো। জিনিসপত্রের কোয়ালিটি ও ডেকোরেশনের নমুনা ওয়েস্টার্ন স্ট্যন্ডার্ড। যমুনা ফিউচার পার্ক শপিং সেন্টারের ভেতরে গেলে মনে হবেনা বাংলাদেশে আছি। শুধু বাংলা কথা ও পোশাক-আশাক ছাড়া।
ক্যাম্পাসের স্টাফ, একাডেমীক এবং কর্মচারী ছাড়া অন্যকারো সাথে তেমন কথা হয়না। আগেই ভেবে রেখেছি কাজটাকে প্রাধান্য দেয়া ছাড়া অন্য কিছুতে সময় দিবোনা এবার। তাই ঢাকার পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের জানাইনি, আমি যে ঢাকায়। কেননা দেখা করার জন্য সময় বের করা কঠিন। সেকারণে প্রয়োজনীয় গ্রোসারী, মাছ-মাংস, আর কাঁচাবাজারের জন্য ছাড়া তেমন একটা বের হওয়া হয়না বাড়ি থেকে। তাছাড়া ৩০শে জুন বাসায় উঠার পর থেকে কেবল গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি সারা সপ্তাহ। একটু বৃষ্টি হলেই ক্যাম্পাসের অবস্থা ভয়াবহ হয়ে পরে। বসুন্ধরা এরিয়া পার হলেই বাকি পথ টুকু কাঁদা পানিতে একাকার। ড্রেনের ময়লা পানি মাড়িয়ে হেঁটে যেতে হয় ক্যাম্পাসের ভিতর। ড্রেনের ময়লা পানি দিয়ে হেঁটে আসার কারণে পুরো সময় পা চুলকাতে থাকে। সাবান বা অন্য কোনকিছুতেও এই যন্ত্রণা কমে না। এরমধ্যে মঙ্গল ও বুধবার বৃষ্টির কারণে ক্লাস অনলাইনে নেবার নোটিশ দিয়েছে। বাসায় ইন্টারনেট কানেকশন নেয়াতে সেটা এখন আর অসুবিধা হচ্ছেনা। তিনমাসের কানেকশন বাবদ সাতাইশ’শ আর রাউটার ধার দিয়েছে বাড়ি ওয়ালা। তাই রাউটার আর কিনতে হয়নি। এর আগে গ্যাসের কানেকশন নিতে চার্জ নিয়েছে পাঁচশো আর সিলিন্ডার বাবদ নিয়েছে দেড়হাজার, সর্বমোট দুইহাজার টাকা। আর চুলা কিনেছি নিজে। এই এলাকায় ন্যাচারাল গ্যাসের সাপ্লাই ক্ষীণ তাই সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবস্থা করা।
এখনো পর্যন্ত নতুন পরিচিত প্রত্যেকেই নিজ থেকেই সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এসেছে। সিডনিতে কিন্তু এমনটা দেখিনা এখন। সেখানে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোষ্ট ছাড়া প্রয়োজনে পরিচিত জনদের কাছে বাস্তবে তেমন কোন সাড়া পাওয়া যায়না। ঢাকাতে অন্যরকম দেখছি। স্বজন-পরিজন না হয়েও কেবল চেনাজানা হয়েছে এমন অনেকেই স্ব-ইচ্ছায় এগিয়ে এসেছে খোঁজখবর নিতে। কিছু লাগবে কিনা জানতে। অফিস টাইম ছাড়াও প্রায় বিকেলেই এআইউবি কলিগরা আমাকে ফোন বা ম্যাসেজ পাঠায় কিছু লাগলে যেনো তাদের জানাই। আমার মতো আরো এআইউবি কলিগরা এফ ব্লকে থাকেন, হেঁটেই আসা-যাওয়া করা যায়। তাই সময় পেলেই শপিং বা কফি খেতে বেরিয়ে পরার আয়োজন করে ফেলেন কেউ কেউ। সাথে আরো যারা একই সময়ে ফ্রি থাকে তারাও জয়েন করে। এখানকার কফিশপ গুলো উঁচু তলার উপর সুন্দর ডেকোরেট করা ও পরিচ্ছন্ন। হঠাৎ করে দেশের বাইরে মনে হয়। তবে বাংলাদেশে আয়ের তুলনায় দাম বেশ চড়া। একদিন কলিগরা সবাই মিলে ঠিক করলো বসুন্ধরা সিনে কমপ্লেস’-এ তুফান বাংলা ছবিটা দেখবো। সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ গুলোর এইসব আন্তরিকতা ও সহচর্যে ঢাকার প্রতি ভালোলাগা ক্রমশঃ দৃঢ় হচ্ছে। মানুষে মানুষের মানবিক আন্তরিকতা যেনো নতুন করে অনুভব করছি।
কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি (ঢাকা থেকে)
|