ঢাকার পঞ্জিকা - ৩ কাজী সুলতানা শিমি
চব্বিশ বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরী করতে দেশে এসেছি বিষয়টা নিয়ে ক্যাম্পাসের প্রায় সবারই একটা কৌতূহল। তাও আবার সংসার ছেলেমেয়ে সিডনী রেখে, একা। কারো সাথে কথা বা পরিচয় হলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে আপনি আসলে কেন এসেছেন! বেশীর ভাগই যেখানে এখন দেশ চলে যাবার সুযোগ খুঁজে কিংবা চেষ্টা করে। সেখানে আপনি উল্টা ফিরে এসেছেন! আমিও রসিকতা করে বলি, সবাই কেন চলে যেতে চায় সেটা স্বচক্ষে দেখার জন্য এসেছি। আসলে চাকরী নিয়ে দেশে আসার আরো একটা বিশেষ কারণ ছিলো আম্মাকে কিছুদিন সময় দেয়া। এ বছর অর্থাৎ ২০২৪, এপ্রিলে আম্মার ক্যান্সার সার্জারি হয়েছে। এমনি এমনি শুধুই দেখতে আসার চেয়ে চাকরী নিয়ে আসলে বেশীদিন থাকা যাবে। এতে আম্মার যেমন ভালো লাগবে আমারও কর্তব্য বোধ কিছুটা পালন হবে। এ সময়ে আম্মার সাথে থাকার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর কাজটা করার কারণে সময়টা সম্পূর্ণই অর্থবহ লাগছে। নতুবা ফেরার অস্থিরতা শুরু হতো হয়তো। বাসা নিয়েছি বসুন্ধরা, মুলতঃ আম্মাকে নিয়ে ক্যাম্পাসের কাছাকাছি থাকার জন্য। নতুবা ঢাকার নিজেদের বাড়ীর ভাড়াটিয়া উঠিয়ে সেখানেই থাকা যেতো। যাইহোক, সারাজীবন তো নিজের সংসার নিয়েই মগ্ন থাকলাম, কিছুদিন না হয় আম্মাকে সময় দিলাম।
চট্টগ্রামে সার্জারি শেষে আম্মা এখনো সেখানেই আছে। মেঝ বোন রিমির দায়িত্বে। সেজন্যই কোরবানি ঈদ করতে চট্টগ্রামে এলাম। বিমানে আসতে সময় লাগলো মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিট! এদিকে ঈদের জন্য বাস ও ট্রেনে চলছে ভয়াবহ জ্যামের জার্নি। বেশীরভাগ সময় ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে আমাদের দেশে আসা হয়। এবারই এসেছি জুনের গরমে। তাই গরমের নানা রকম ফল যেমন আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল সহ নানা রকম ফলের সমারোহ বাজারে ও পথে পথে খুচরো বিক্রেতাদের কাছে। তবে চট্টগ্রামে ঢাকার তুলনায় গরম ও জ্যাম কম।
এদিকে এথিক্স ও লজিক ছাড়াও আরো একটা কোর্স আমাকে পড়াতে হচ্ছে সেটা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’। বাংলাদেশ বিষয়ে গভীর জ্ঞান ছাড়া এ বিষয়টা পড়ানো ঠিক হবে কিনা ইতস্তত করাতে ফ্যাকাল্টি ডীন বললেন, আমার বিশ্বাস আপনি পারবেন। চব্বিশ বছর পর যে দেশে এসেছে কাজ করার জন্য, পাশাপাশি জাতীয় পত্রিকাতে লেখালেখি চলমান তার দেশ সম্পর্কে জ্ঞান নেই এ আমি মনে করিনা। তাছাড়া পড়ানোর তাগিদে আপনার নিজেরও পড়ার এবং জানার ইচ্ছা হবে সেটা আপনার জন্যই ভালো। সব শিক্ষার্থীদের জন্যই ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ কোর্স আবশ্যিক হওয়ায় এ বিষয়ে অনেক ছাত্রছাত্রী। সেজন্য শিক্ষক স্বল্পতা রয়েছে। কোর্স আউটলাইন দেখে মনে হলো ক্লাস নেয়া খুব একটা কঠিন হবেনা। অবসরে আমি পড়তে পছন্দ করি। চিন্তা করলাম অন্যকিছু না পড়ে এখন আপাততঃ নাহয় বাংলাদেশকেই আরো ভালো করে পড়ি! দেখলাম এই সেমিস্টারের মিডটার্মের কোর্সে বরাদ্দ রয়েছে- বৃটিশ কলোনি, পাকিস্তানী পিরিয়ড, মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু, গণতন্ত্র, বাংলাদেশের ঐতিহ্য সহ আরো কিছু প্রয়োজনীয় বিষয়। অবশেষে ফ্যাকাল্টি ডীনের সমর্থন ও আশ্বাসে আমি ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ কোর্স পড়াতে সম্মত হলাম। নতুন করে জানা, পড়া ও পুরানো জ্ঞান যাচাই হচ্ছে, মন্দ নয়।
‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’-কোর্স ম্যটেরিয়াল গুলো ঈদের ছুটির সময়টা পড়ে নিবো এই উদ্দেশ্যে ল্যাপটপ ও যাবতীয় রেফারেন্স গুলো চট্টগ্রাম নিয়ে এলাম। কিন্তু জুনের ১৪,১৫,১৬,১৭ অর্থাৎ শুক্র, শনি, রবি, সোম, এই চারদিনে ল্যাপটপ খোলারই সময় বের করতে পারিনি আর রেফারেন্স দেখা তো দুরের কথা। আম্মার সাথে রাজ্যের গল্পসল্প জমে আছে। শুক্রবার বোনের সাথে শপিং-এ গেলাম, শনিবার সিনেমা হলে সিনেমা দেখলাম ‘কাজল রেখা’ আর রাতে গেলাম ছোট খালার বাসায় নিমন্ত্রণ খেতে। রবিবার ‘হোয়াইট রেবিট’ রেস্টুরেন্টে খাওয়ালাম আর টুকটাক ঈদের বাজার শেষে দিন ফুরিয়ে গেলো। আর সোমবার তো ঈদের দিন। গরু-খাসি কাটাকাটি শেষে খাওয়া-দাওয়া আর আড্ডা গল্পেই সময় চলে গেলো। সেইসাথে দেশীয় ফল আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, লুকলুকি, লটকন সহ হরেকরকম স্মৃতি জাগানিয়া ফলের সুবাসে সোনালী অতীতে ফিরলাম মনে হলো। আম্রপালি, ল্যাংড়া, হাড়ীভাঙ্গা, হিমসাগর এসব যে আমের প্রকারভেদ জানিই না শুধু ফজলী ছাড়া! এবার আমার ঈদের রান্না কিংবা কোন কাজ-কর্মের দায়-দায়িত্ব নেই। তাই ঈদের আগের রাতে বহুবছর পর হাতে মেহদী লাগালাম কিশোরী বেলার মতো। ঈদের পরদিন মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় গাড়ী ভাড়া করে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লার চান্দিনা বাপের বাড়ি চলে এলাম। আম্মাকে সাথে নিয়ে। চট্টগ্রাম থেকে সময় লাগলো মাত্র দুই ঘণ্টা। ঈদের পরদিন হওয়ায় রাস্তা একদম ফাঁকা। মনে হচ্ছে যেন কভিডের সময়কাল। জনমানুষ শূন্য, দোকানপাটও সব বন্ধ। এমনকি থেমে চা’ খাবারও উপায় নেই। সকাল আটটায় বাড়ি পৌঁছে গেলাম। এই বাড়ীতে সবসময়ের জন্য কেউ আর থাকেনা। আম্মা তার ছেলেমেয়েদের কাছে পালা করে আমেরিকা, কানাডা আর অস্ট্রেলিয়া বেড়াতে গিয়ে বছর কাটিয়ে ফেলেন। অথচ এক সময় কি হৈচৈ আর মানুষের আনাগোনায় গমগম করতো সারাক্ষণ। বাড়ির চার ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া সব ঈদের বন্ধে নিজেদের বাড়িতে। কোথাও কেউ নেই। আম্মা দেশে থাকলে তিন তলার থাকেন। এখন আমি আর আম্মা শুধু দুজনই থাকবো।
১৮ই জুন মঙ্গলবার রাত দুইটা অর্থাৎ বুধবার শুরুতে মুস্তাফিজের সিডনী ফেরার ফ্লাইট। মুস্তাফিজ আমাকে ও আম্মাকে চান্দিনা নামিয়ে দিয়ে ঢাকায় ফিরে গেলো। ২২শে জুন ইউনিভার্সিটি খুলবে। তাই সে পর্যন্ত চান্দিনায় থাকবো। এই উপজেলার উন্নয়ন বলতে কেবল কিছু দোকানপাট বেড়েছে। রাস্তাঘাট আগের চেয়েও ভাঙ্গা ও অপরিচ্ছন্ন। এই বাড়ি থেকে ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের গাড়ী চলাচল দেখা যেতো। এখন শুধু অপরিকল্পিত দালানকোঠা ছাড়া কিছুই দেখা যায়না। বাড়ীর চারপাশে নারকেল গাছে প্রচুর নারকেল ধরেছে। কাঁঠাল, আম, পেঁপে সহ আরো কিছু ফল ও সবজি লাগানো দেয়ালের চারদিকে। বাড়ীতে অন্য কেউ নেই এখন। বকি সব ফ্ল্যাটের ভাড়া থাকা মানুষজন ঈদের ছুটিতে নিজ নিজ বাড়ি যাওয়ায় এখনো কেউ ফেরেনি। বিয়ের আগে আমি যে রুমটাতে থাকতাম সে রুমে আমার বিয়ের একটা ছবি দেয়ালে টানানো রয়েছে। আমার ব্যাবহার করা মগটা এখনো সেভাবেই আছে এমনকি রোকেয়া হলে ব্যবহৃত জিনিষগুলোও! আমার খাটে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। সংসার, ছেলেমেয়ে, জাগতিক জটিলতায় অষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো এই আমি একা, এই মুহূর্তে পুরানো আবাসে বর্তমান। পঁচিশ বছরেরও বেশি সময় জীবন থেকে মিলিয়ে গেছে একটুও মনে হচ্ছেনা! মনে হচ্ছে রোকেয়া হল থেকে ছুটিতে বাড়ি আসলাম।
কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি (ঢাকা থেকে)
|