bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













ঢাকার পঞ্জিকা - ১
কাজী সুলতানা শিমি


শিক্ষকতা দিয়ে কর্ম জীবন শুরু করেছিলাম। দুই যুগ পর শিক্ষকতা করতে এবার দেশে যাচ্ছি। দেশ মানে বাংলাদেশ, আমার জন্মভূমি। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে সোশাল সাইন্স ফ্যাকাল্টিতে ‘এথিক্স এবং লজিক’ বিষয়ে পড়ানোর অফার পেয়ে সুযোগটা কাজে লাগাতে ইচ্ছে করলো। বিশ/বাইশ বয়স থেকে রোকেয়া হলে একা একাই থেকেছি, চলতে শিখেছি। ঢাবি’র ক্যাম্পাস জীবন থেকেই নানা মানুষের সাথে সামঞ্জস্য করে চলতে হয়েছে। এরপর দুই যুগ অভিবাসী জীবনের বাঁকে বাঁকে যেভাবে বাংলাদেশকে দেখছি বা শুনছি তার সাথে বাস্তবতা সহজ নাকি সমস্যার কাজ করতে গিয়ে সেটাও মিলিয়ে দেখা হবে ভেবেই এই সিদ্ধান্ত।

বৃহস্পতিবার, ৩০শে মে সিডনি থেকে ঢাকার পথে। ক্যথে প্যাসিফিক এয়ার ওয়েজ হংকং হয়ে ঢাকায় পৌঁছুবে পরদিন অর্থাৎ শুক্রবার। রাত একটায় ল্যান্ডিং তাই এবার এয়ারপোর্টে কেউ আসুক তা চাইনি। তাছাড়া এবার যেহেতু বেড়াতে যাচ্ছিনা তাই তেমন কাউকেই জানাইনি। সিডনি থেকেই হোটেল বুকিং দিয়েছি। ট্যাক্সি কিংবা উবার নিয়ে সোজা হোটেলে গিয়ে লম্বা ঘুম শেষে পরিজনদের সাথে সাক্ষাতের পর্ব শুরু হবে এটাই প্ল্যান। হংকং এয়ারপোর্টে পাঁচ ঘণ্টা ট্রানজিট শেষে ঢাকা পৌঁছলাম সময়মতই রাত একটায়। চার নাম্বার বেল্ট থেকে লাগেজ কালেক্ট করে বিদেশী পাসপোর্ট ধারী লাইনে দাঁড়ালাম। শুধুমাত্র বিদেশী পাসপোর্ট লেখা থাকলেও সেখানে সব ধরণের পাসপোর্ট নিয়েই লোকজন লাইনে দাঁড়ানো। উপরের লেখা কেউ পড়েছে বলে মনে হচ্ছেনা।

অন্য লাইনের অফিসার আমাদের ডাকলেন। এবং বেশ তাড়াতাড়ি করেই ইমিগ্রেশন পর্ব শেষ করে আমাদের যেতে দিলেন। লাগেজ স্ক্যান করার মেশিনের সামনে যেতে না যেতেই কর্তব্যরত অফিসার কোন দেশ থেকে এসেছি জিজ্ঞেস করে আমাদের লাগেজ স্ক্যান না করেই বের হতে দিলেন। অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছি এটা শোনার পর বিলম্ব বা সমস্যা ছাড়াই ঢাকার এয়ারপোর্ট থেকে সহজ ও কোন রকম বিড়ম্বনা ছাড়াই বের হয়ে এলাম। এরপর ট্যাক্সির জন্য ‘এয়ারপোর্ট রেন্ট-এ-কার’ সাইন বোর্ড দেখে এগিয়ে গিয়ে হোটেলের বুকিং ও ঠিকানা দেখাতেই বললো এক হাজার টাকায় পৌঁছে দেবে। কোনরকম দরদাম না করে রাজী হয়ে গেলাম কেননা ট্রান্সপোর্ট ও হোটেলের দূরত্ব কেমন বা পথঘাটের কি দশা তা জানিনা তাই।

ট্যাক্সিতে উঠেছি কারণ আমাদের মোবাইলে উবার ইন্সটল করা হয়নি। রেন্ট-এ-কারের যে ট্যাক্সিতে উঠেছি সেটাতে কোন জিপিএস নেই এবং ড্রাইভারের এনালগ ফোনে পথ নির্দেশনার কোন উপায় নেই। দশ মিনিটের পথ সে এক ঘণ্টা যাবত ঘুড়িয়ে নিয়ন-রাতে পথের লোকজনকে জিজ্ঞেস করে করে অবশেষে রাত তিনটায় হোটেলে নামিয়ে দিলো। এবং ভাড়া চাইলো অতিরিক্ত আরো পাঁচশো টাকা। ক্লান্ত সময়ে বিতণ্ডায় না জড়িয়ে অনেকটা বিরক্ত হয়েই হোটেলে উঠলাম। সকালে ব্রেকফাস্ট হোটেলেই সাড়ে সাতটা থেকে শুরু হবে। সেটা রিসেপশন থেকে মনে করিয়ে দিয়ে রুমের কার্ড সহ পোর্টারকে দিয়ে আমাদের লাগেজ গুলো রুমে দিয়ে গেলো। শুক্র ও শনিবার স্বজন পরিজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ শেষ করলাম।

জুনের দুই তারিখ রবিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করবার দিন। ধানমণ্ডি থেকে উবারে কুড়িল এক নাম্বার গেট দিয়ে খানিক ভেতরে যেতে হবে। ফার্মগেট পার হলে ‘এক্সপ্রেস এলিভেটর’ দিয়ে গেলে অতিরিক্ত আশি টাকা যাত্রিকে পথশুল্ক (টোল) দিতে হবে। এরপর ‘কুড়িল কাজী বাড়ি জামে মসজিদ’ গলি দিয়ে বেশ অনেকখানি ভেতরে গেলেই ক্যাম্পাসের সীমানা শুরু। উবার ড্রাইভার আমাদেরকে গলির মুখে নামিয়ে দিয়ে বললো আপনাদের রিক্সা কিংবা হেঁটে যেতে হবে বাকি পথ টুকু। গলিতে গাড়ী নেয়া সম্ভব না। প্রথম দিনেই আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। মনে মনে অনেক উদ্দীপনা ও সাহস নিয়ে এলেও শুরুতেই এমন অব্যবস্থাপনা দেখে দমে গেলাম। জয়েন করে দু’সাপ্তাহ পর ফিরে যাবো এরকম একটা ভাবনা মনে দোল খেতে শুরু করলো। সাথে যে এসেছিলো তাকে বললাম চলো হেঁটে গিয়ে দেখি কতদূর। প্রচণ্ড গরম দেখে তিনি হাঁটতে রাজী নন। অগত্যা রিক্সা নিলাম। ভাঙ্গা রাস্তা ও মানুষের ভিড়ে রিক্সা চালানোও অনেকটা দুষ্কর। তিরিশ টাকা রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে ক্যাম্পাসে নেমে খানিকটা স্বস্তি এলো এজন্য যে ক্যাম্পাসের ভিতরটা বেশ পরিপাটি।

সামার সেমিস্টারের আজ প্রথম ক্লাস। গেটে সিকিউরিটিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঠানো ইমেইল দেখিয়ে বললাম আজ আমার জয়েনিং ডেট। তখন সকাল নয়টা। সিকিউরিটি বল্লো সাড়ে নয়টার আগে কেউ আসবেনা। স্যার আসা পর্যন্ত আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে। পাশেই স্টুডেন্ট ক্যান্টিনে গিয়ে বসলাম। অবশেষে একজন লোক মারফত আমাকে সি’বিল্ডিং এর তৃতীয় তলায় ‘এইচআর’ ডিপার্টমেন্টে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানের রিসেপশানে বসিয়ে আমাকে এক গ্লাস পানি ও এক কাপ চা’ দেয়া হলো। আমি বললাম, এসব কার জন্য? লোকটি বলল, আপনার জন্য। আমি বললাম, আমি তো ‘চা ও পানি’ চাইনি। লোকটি রবোটিক সুরে বললো, না চাইলেও আমরা দেই। বসার জায়গাটি মনোরম। কাঁচের দেয়াল দিয়ে দুরের দৃশ্য দেখা যায়। সাথে ঝকঝকে পরিষ্কার গ্লাসের পানি আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম খচিত সাদা কাপে চায়ের সুন্দর রঙ দেখে আমার মন খানিকটা শান্ত হলো।

বেশ কিছুক্ষণ পর কাঁচের দেয়াল বেষ্টিত রুমে ঢোকার পর অনিমেষ’ নামে একজন ভদ্রলোক আমাকে স্বাগতম জানালেন। আমার যাবতীয় কাগজপত্রের কপি নিয়ে বললেন, আপনার যদি ডাচ-বাংলা ব্যাঙ্কে একাউন্ট না থাকে তাহলে একাউন্ট খুলতে হবে নতুন করে। কেননা সবার সেলারি পেমেন্ট করা হয় আমাদের অনুমোদিত ব্যাংকে। তবে সমস্যা নেই আমরা আপনাকে একাউন্ট খুলে দেব। তারপর বেশ কিছু ফর্ম ও আনুষঙ্গিক কাগজপত্র দিয়ে বললেন, বাসায় গিয়ে পড়ে ফিলাপ করে পরদিন নিয়ে আসলেই হবে। ক্যাম্পাসের কোন ম্যাপ কিংবা ফ্যাকাল্টি ডিরেকশন না থাকায় কর্মচারীরা বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে নিজেরা এসে নিয়ে যায়। ফিঙ্গার প্রিন্ট, আই স্ক্যান, ফেইস রিকগনিশন করার পর অবশেষে সোশ্যাল সাইন্স ডিপার্টমেন্টে নিয়ে গেলো। পাশাপাশি আইটি ডিপার্টমেন্ট থেকে আমার জন্য একটা ল্যাপটপ ইস্যু করা হলো। সেখানে ডিপার্টমেন্ট হেড ড.বুদ্ধদেব বিশ্বাস পরিচয় হতে না হতেই বললেন, আপনার তো আজই ক্লাস নেয়ার কথা! সকাল আট’টায় আপনার ক্লাস আমি প্রক্সি দিয়েছি। তখন কি বলা দরকার ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না।

তারপর এতদিন যিনি লজিক পড়াতেন, সায়রা মতিন-এর সাথে পরিচয় হলো। তিনি মুলতঃ সোসিয়লজি টিচার, এথিকস এবং লজিকের কেউ ছিলোনা বলে তিনি ক্লাস চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে কি কি পড়াতে হবে এবং কোর্স আউটলাইন নিয়ে কিছুটা ধারণা দিলেন। সিডনি থেকেই উনার সাথে ফোনে যোগাযোগ হলেও সামনাসামনি প্রথম কথা। সায়রা মতিন আমাকে বেশ আশ্বস্ত করলেন নানা বিষয়ে। এরপর নিজেই ফ্যাকাল্টি ডীন ড. তাজুল ইসলামের সাথে দেখা করতে উনার রুমে গেলাম। যিনি অনলাইনে আমার ইন্টারভিউ নিয়েছিলেন। বয়সে সবচে প্রবীণ কিন্তু সবচেয়ে আন্তরিক, উনার ব্যাবহার দেখে সহজেই তা অনুমেয়। যাওয়া মাত্র রুমে উপস্থিত অন্যান্য টিচারদের সাথে আমায় পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেইসাথে ক্যাম্পাসের কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিলেন। তিনি জানালেন আমার পাঁচদিনই ক্যাম্পাসে আসতে হবে যদিও ক্লাস নিতে হবে চারদিনে ছয়টা। এবং কাল অর্থাৎ সোমবার সকাল থেকেই ক্লাস। সাথে এও বললেন আপনাকে কিন্তু পার্মানেন্ট থাকবেন হিসেবে আমরা নিয়োগ দিয়েছি। আপনার মানসিক প্রস্তুতি আছে তো? আমি বললাম, আগে আমার টিচিং পারফর্মেন্স ও স্টুডেন্ট রিভিউ দেখেন এক সেমিস্টার তারপর না হয় চিন্তা করবেন। তিনি সবার উপস্থিতিতে আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, যেদিন আমি আপনার ইন্টারভিউ নিয়েছি সেদিনই বুঝছি আপনি জানেন বেশী কিন্তু জানান কম। এবং এও জানি আপনি খুব ভালো পড়াবেন। বেশীরভাগ মানুষ জানে কম কিন্তু শো’অফ করে বেশী। আপনার মাঝে শো’অফ বিষয়টা যে নেই, তা আপনার কথা শুনেই আঁচ করা যায়। এমন স্নেহময় অপার প্রশংসা কবে শুনেছি মনে পড়েনা! এই কৃতজ্ঞতার প্রতিদানে মন ও মেধা নিবেদিত করে সেমিস্টারটা শেষ করবো বলে মনঃস্থির করলাম।




কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি (ঢাকা থেকে)





Share on Facebook               Home Page             Published on: 24-Jun-2024

Coming Events: