কোভিড ভ্যাক্সিনের কথা কাজী সুলতানা শিমি
প্রায় দু’বছর হতে চলছে আমাদের চেনা পৃথিবীটাকে অচেনা ভাবে দেখছি। সিডনিতে লকডাউন চলছে গত জুন থেকে। লকডাউন ছাড়াও এমনিতেই সকাল এগারোটায় টিভিতে প্রতিদিনের ব্রিফিং দেখার জন্য ব্রেকে যাই। ভ্যাক্সিন নিয়ে মিডিয়াগুলোতে এমনভাবে ক্যাম্পেইন করছে যেন ডাক্তারের কাছে যাওয়া মাত্রই ভ্যাক্সিন দেয়া যাবে। বাস্তবে মোটেও তা নয় কিন্তু! লকডাউনের আগ পর্যন্ত ভ্যাক্সিন দেয়ার পরিমাণ ছিল মাত্র শতকরা তিন ভাগ। ২০২১ এর জানুয়ারি থেকে জুন, ছয়মাস সময় পাওয়া সত্ত্বেও ভ্যাক্সিন দেয়ার ব্যাপারে কোনরকম জোর পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। ফলে জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত লকডাউন আশা করা অস্বাভাবিক কিছু কি! কোভিড ভ্যাক্সিনের ব্যাপারে অভিজ্ঞতাটা মনে রাখার জন্য এইসব ভূমিকা। আমার প্রথম ডোজ ভ্যাক্সিন দেবার সময় ছিল সন্ধ্যা ছয়টায়, দিয়েছে রাত সোয়া নয়টায়। তিন সপ্তাহ পর ২য় ডোজ দেয়ার সময় ছিল সকাল সাড়ে দশটায়, দিয়েছে সোয়া এগারোটায়। তাও আবার দুইমাস আগে বুকিং দেয়া ছিল বলে। সচরাচর ডাক্তার, জিপি, কিংবা হসপিটাল যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা আমার স্বভাব। নেহায়েত অসুবিধায় না পড়লে সেদিকে পা বাড়াই না। অনেকেই সামান্য কারণেই ডাক্তারের কাছে যেতে পছন্দ করেন সেজন্য এটা বলা। যাই হোক, অস্ট্রেলিয়ায় ভ্যাক্সিন দেয়া শুরু হতেই জিপি সেন্টারে জানতে চাইলাম কবে ও কিভাবে ভ্যাক্সিন দিতে পারবো। জিপি জানালো এতো তাড়াহুড়ার কিছু নেই। যখন জিপি সেন্টারগুলোতে ভ্যাক্সিন সরবরাহ স্বাভাবিক হবে তখন এক সময় এসে দিয়ে গেলেই হবে। অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন সরবরাহ পর্যাপ্ত হবে এবং ভ্যাক্সিন দিতে যাবো। এরই মধ্যে পরিচিত অনেকেই ভ্যাক্সিন দিয়ে ফেসবুকে ছবি দেয়া শুরু করায় আমি আবারো খোজ নিলাম। এবারো একই উত্তর। নিয়মিত মিডিয়াগুলো ফলো করতে লাগলাম পরিস্থিতি ও ভ্যাক্সিন জাতীয় কৌতূহলের উত্তর পাবার জন্য। নানারকম মিশ্র খবরে অস্থিরতার সাথে কিছুটা অসহিঞ্চুতা ও তৈরি হল। এরিমধ্যে শুনি দেশে আমার পরিবার-পরিজনেরাও ভ্যাক্সিন নিয়ে একটি সুন্দর সার্টিফিকেট ও নাকি পেয়ে গেছে। আমি পড়লাম আরও চিন্তায়। এদিকে এ্যাস্ট্রাজেনেকা ও ফাইজার নিয়ে চলছে অস্ট্রেলিয়ায় মহাবিতর্ক। অথরাইজ ইমার্জেন্সি ওয়ার্কার হিসেবে বিশেষ অধিকার পাওয়া যেতে পারে এ নিয়েও ক্ষীণ আশায় আছি। কিন্তু কোন লক্ষণ নেই। আশার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বাংলা-সিডনির সম্পাদক আনিসুর রহমানের ফেসবুক পেজ থেকে ভ্যাক্সিন বুকিং এর একটি লিঙ্ক পেয়ে অগত্যা একটি বুকিং দিয়ে রাখলাম। পাশাপাশি অন্য কোথাও আরো তাড়াতাড়ি বুকিং পাবার লক্ষ্যে চেষ্টা চালিয়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু আশায় গুড়েবালি। দুঃখজনক ভাবে কোথাও বুকিং পাওয়া গেলনা।
ভ্যাক্সিনেশন সেন্টার সিডনি অলিম্পিক পার্ক। গিলফোর্ড থেকে খুব একটা দুরে না হলেও বেশ আগেই বের হলাম। অগাস্ট মাস। খুব শীত পড়েছে। তার উপর কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। পি-৩ পার্কিং থেকে বেশ অনেকখানি হাঁটাপথ। ভ্যাক্সিন সেন্টারের কাছাকাছি গাড়ী রাখার উপায় নেই। বিশাল লম্বা লাইনে দাঁড়াতেই ভ্যাক্সিন ভলান্টিয়ারদের একজন এসে জানতে চাইলো কটায় এপয়েন্টমেন্ট। আমি ছটায় বলাতে বলল ঘণ্টা খানেক পরে আসতে। কেননা চারটায় এপয়েন্টমেন্ট নেয়া লোকজন এখনো লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। ক’টায় ভেতরে যেতে পারবো তার কোন নিশ্চয়তা দিতে পারলোনা। এদিকে বাইরে বসার কোন জায়গাও নেই। কি করবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। Parkview Drive এর কর্নারে একটা এপার্টমেন্টের লিফট স্পেসের ভেতরে একটু দাঁড়াবার জায়গা পেয়েছিলাম। বসার যায়গা, দোকানপাট, এমন কি পোর্টেবল টয়লেট বা ইমার্জেন্সি কোন ব্যবস্থা নেই। এদিকে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মনে হলো দাঁড়িয়ে থেকে বিরক্ত হবার চেয়ে গাড়িতে ফিরে যাওয়া ভালো। অগত্যা ভ্যাক্সিন সেন্টারের কাছাকাছি পার্কিং স্পট খুঁজে গাড়িতেই দিলাম ঘুম। ঘুম থেকে উঠে দেখি তখন রাত আটটা বাজে। ভাবলাম এবার লাইনে দাঁড়ানো দরকার। রাত আটটায় লাইনে দাঁড়িয়ে সাড়ে আটটায় ভেতরে যাবার ডাক পড়লো। প্রথমে মোবাইলে পাঠানো ভ্যাক্সিন কনফার্মেশন ম্যাসেজটা দেখলো। আবারো কনফার্ম করে তিন নাম্বার ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করার একটা স্টিকার লাগিয়ে দিলো। তিন নাম্বার ওয়েটিং রুমে আসার পর মনে হলো আমি এখন সিডনিতে আছি। ঝকঝকে তকতকে সবকিছু। ভেতরটা এতো পরিচ্ছন্ন যে, দেয়াল ও ফ্লোরের টাইলসে আমার নিজের চেহারা দেখতে পাচ্ছি।
রাত নয়টায় স্ক্রিনে আমাদের নাম্বার দেখালো। অবশেষে নার্সের কাছে যেতে পারলাম। গিয়েই বললাম আমি কিন্তু একটা ছবি তুলবো যে আমি ভ্যাক্সিন দিচ্ছি। শুনে নার্স হেসে বলল ভ্যাক্সিন দিচ্ছো তার ছবি তুলতে যদিও মানা তবে কি ভ্যাক্সিন দিচ্ছো তার ছবি তুলতে পারো। আমি বললাম এটা কেমন কথা! এই ভ্যাক্সিন আমি দিয়েছি কিনা তার প্রমাণ কি! উত্তরে জানালো, তুললে নিজ দায়িত্বে তুলতে পারো কেউ যেন না বুঝে। প্রোটকল ভেঙ্গে আমি তোমাকে অনুমতি দিতে পারছিনা। এদিকে আমি দুই ডোজ ভ্যাক্সিনের জন্য দুই রঙের দুই পোশাক রেডি করে রেখেছি প্রমাণ রাখব বলে। এখন ছবি না থাকলে কি করে হবে! অবশেষে সোয়া নয়টায় প্রথম ডোজ ভ্যাক্সিন দেয়া হলো, ফাইজার। বিশ মিনিটের মতো অবজার্ভেশনে থাকার পর রাত দশটার দিকে বাসায় ফিরলাম।
তিন সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজের দিন। সেদিনও কনকনে ঠাণ্ডা ও উড়িয়ে নেয়া বাতাস। তবে এবার আগেভাগেই সোয়াটার, স্কার্ফ, হুডি লাগানো জ্যাকেট সহ যাকিছু দরকার সব নিয়ে নিলাম সাথে। সকাল সাড়ে দশটায় বুকিং। সাড়ে নয়টায়ই চলে গেলাম। গিয়ে দেখি এবার একটু পরিবর্তন। প্রথম ডোজের সময় যেখানটায় গাড়ী পার্ক করে ঘুমিয়েছিলাম সেখানে এবার বড় টেন্ট পেতেছে। পোর্টেবল টয়লেটের ব্যবস্থাও করেছে। অনেক ভলান্টিয়ার সারি বেঁধে ভ্যাক্সিন দিতে আসা লোকজনদের নানা ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে। এবার ঠিক সাড়ে দশটায় যাদের বুকিং তাদের লাইনে দাঁড়াতে ডাকলো। সাড়ে দশটায় লাইনে দাঁড়ানো সবাইকে সোয়া এগারোটার ভিতর ভ্যাক্সিন দিয়ে দিলো। ২য় ডোজ দেয়ার সময় আমি নার্সকে বললাম আমি কিন্তু প্রথম ডোজ ফাইজার দিয়েছি, তুমি আবার ২য় ডোজ এসট্রাজেনেকা দিয়ে দিওনা না যেন! সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, না না আমাদের কাছে রেকর্ড আছে তো। তবু নিশ্চিত হতে নিজেই দেখে নাও। এই বলে সে আমাকে সিরিঞ্জটা দেখালো। সেখানে ফাইজার লেখা তার একটা ছবি তুলে রাখলাম। বিশ মিনিট অবজার্ভেশন শেষে বাসায় ফেরা।
তেমন স্বস্তিকর অভিজ্ঞতা হয়নি ভ্যাক্সিন নেবার ব্যাপারে। যদিও অভিজ্ঞতাটা একান্তই ব্যক্তিগত তবুও এতো বড় একটা প্রক্রিয়া আমার পাঁচ ঘণ্টা সময়ের সাথে তুলনা করে সান্ত্বনা পাবার চেষ্টা করলাম। ২০২০ এবং ২০২১ দু’বছরে থেমে যাওয়া পৃথিবী সচল করতে যারা শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন, ভাবছেন, তাদের প্রতি সম্মানবোধ প্রকাশ না করাটা একটু অকৃতজ্ঞতাই মনে হয়। পুরো ব্যাপারটা যদি ভাবি- অক্লান্ত গবেষণার পর ভ্যাক্সিন আবিষ্কার করা, প্রস্তুত করা, প্যাকেজিং করে বাজার জাত করা, সরবরাহ করা, ভ্যাক্সিন সেন্টারগুলোতে বণ্টন করা সহ আমার বাহুতে প্রয়োগ করা অব্ধি যে মেধা, শ্রম, চিন্তা, ও সময় ব্যয় হয়েছে তার সার্বিক প্রক্রিয়াটি কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়! এই জটিল কর্মযজ্ঞে শুধুই হেলথ ওয়ার্কার ছাড়াও অন্য অনেকেরই অবদান রয়েছে। সম্মিলিত অবদানেই পৃথিবী আবারো গতিশীল হতে যাচ্ছে খুব শীঘ্রই। দুঃসময়ের ধৈর্য আর বিপন্ন দিনের সাক্ষী থাকা এই আমরা পরস্পর পরস্পরকেও কৃতজ্ঞতা জানাতে পারি বৈকি! কেননা থেমে থাকা এই বর্ণহীন পৃথিবী ফিরছে নিজ গতিতে মানুষেরই সহমর্মিতায়।
কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি
|