bangla-sydney













বড় দিন ও একটি পোস্টকার্ড!
কাজী সুলতানা শিমি


বড়দিন এলেই আমার খুব রণ আর বারবারা’র কথা মনে পড়ে। রণ এবং বারবারা ছিলো আমার প্রতিবেশী। আমাদের বাসার ঠিক উল্টো পাশে রাস্তার ওপাশে তাদের লাল টালির একতলা বাড়ি। পরিপাটি সবুজ লনের বাড়িটি ছিমছাম, গোছানো। বাড়িটিতে শুধু ওরা দুজনেই থাকতো। তেমন কোন বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মীয় স্বজনদের আসা যাওয়া ছিলোনা তাদের বাড়িতে। এমনকি তাদের ছেলেমেয়ে দেখতে আসতো কিনা চোখে পড়েনি কখনো। রণের ব্যস্ততা থাকতো সামনের লন কিভাবে নান্দনিক রাখা যায় সেই মনোযোগেই। সেকারণে নিজের লন মোয়িং অর্থাৎ ঘাস কাটা শেষে আমার বাড়ির ঘাসও কেটে দিতে আসতো। আমরা খুব অস্বস্তিতে পড়তাম। সত্তোর ঊর্ধ্ব একজন প্রবীণ বিনে পয়সায় আমাদের ঘাস কেটে দিয়ে যায় এটা আমাদের একটু কেমন জানি লাগতো। মনে মনে ভাবতাম, মানুষের মমতা প্রকাশের ধরণ খুব অদ্ভুত!

রণের গ্যারেজের দরজাটা সব সময়ই শাটার উঠানো থাকতো বলে সেখানে ঘাস কাটার নানা রকম মোয়িং মেশিনসহ নানা যন্ত্রপাতিতে ঠাঁসা, দেখা যেতো। ঘাস ঘন সবুজ ও তরতাজা রাখার জন্য এবং ভালো জাতের ঘাস গজানোর জন্য নানারকম স্প্রে এবং আগাছা পরিষ্কারের রকমারি ঔষধ ছিল তার সংগ্রহে। আমাদের যে কোন রকম যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হলেই রণকে জিজ্ঞেস করলেই সে তার গ্যারেজ থেকে এনে দিতো। ঘাসের নানারকম জাত ও খাদ্য খাবার নিয়েই ছিল তার আলোচনা ও সময় কাটানোর উপায়। আমি তার এই ‘ঘাস-প্রীতি’ দেখে ভাবতাম আহারে মানুষের কতো ধরণের আগ্রহের বিষয় থাকতে পারে! ঘাস যে কারো এমন প্রীতি-ভালোবাসার বিষয় হতে পারে রণের সাথে পরিচয় ও কথা বলার পর দেখলাম। তার নরম ঘাসের সবুজ গালিচায় মাঝে মাঝে খালি পায়ে হাটতে চাইতাম। সে অনুমতি দিতো বটে কিন্তু এমন ভাবে ঘাসের দিকে তাকিয়ে থাকতো যেনো ঘাস গুলো ব্যথা পাচ্ছে। তার করুণ চাহনি দেখলে খারাপ লাগতো। তবে মোলায়েম ঘাসে খালি পায়ে হাঁটতে যে অদ্ভুত অনুভূতি সেটা রণের ঘাস লনে হেঁটে বুঝছি। রণের ঘাসে কোন কাঁটাময় আগাছা থাকতোনা তাই হাঁটতে ভালো লাগতো।

সেই রণ আর বারবারা প্রতি বড়দিনে আমাদের জন্য গিফট আর বড়দিনের কার্ড পাঠাতো। পোষ্ট করে। সামনের বাড়ি সবসময়ই দেখা হচ্ছে কিন্তু বড়দিনের কার্ড ও গিফট পোষ্ট করে কেন পাঠাতো সেটা আমাদের বোধগম্য হতোনা। আমরা সেই গিফট পেয়ে তাদের জন্যও গিফট ও কার্ড কিনে বাচ্চাদের দিয়ে তাদের বাড়ি দিয়ে আসতাম। এই ব্যাপারটা প্রতি বড়দিনের সময়ই করা হতো। একবার কোন কারণে আমার বাচ্চারা একা একা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছিলো। বারবারা সেটা দেখে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বাচ্চা দুটোকে ঘড়ের ভিতর নিয়ে এলো যেন কোন ছেলেধরা যদি বাচ্চা দুটো নিয়ে যায়! তার চোখে মুখের আতঙ্ক এবং মমতা ভরা চাহনি টুকু এখনো আমাকে মনে করিয়ে দেয়, বয়োজ্যেষ্ঠদের ছায়াও খুব প্রয়োজন। এর কিছুদিন পর শুনি বারবারা স্মৃতিভ্রষ্ট হয়ে রিহাবে আর রণ একটি বয়স্ক পরিচর্যা কেন্দ্রে স্থায়ী ভাবে চলে গেছে। তারপর থেকে পোষ্ট করা বড়দিনের কোন গিফট বা কার্ড পাওয়া হয়না আর।

তাদের বাড়িটি এখন নতুন এক এশিয়ান দম্পতি কিনে নিয়েছে রিয়েল এস্টেটের মাধ্যমে। পরিপাটি মোলায়েম ঘাস তো দুরের কথা, ঠনঠনে শুকনা আর আগাছায় ভরা রণের প্রাণপ্রিয় লন এখন অযত্নে পরে থাকে অগোছালো কাদামাটি হয়ে। নতুন বাসিন্দাদের হিজাব পরা দেখে বুঝতে পারি তারা বড় দিন পালন করেনা। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আমি তাদের দেখতে পাই। একই বাড়ি, একই লন, একই সীমানা শুধু মানুষ গুলো অন্য। দেখি আর মনে মনে ভাবি, এই পৃথিবীর অস্থায়ী ঠিকানায় শুধু কিছু সময়ের জন্য বাড়ি, জমি, অর্থ, বৈভবকে মানুষ নিজের বলে দাবী করে, অধিকার খাটায়। মান-অভিমান, কিংবা ক্ষোভ-যন্ত্রণায় কষ্ট পায়। তারপর একসময় সবকিছু ছেড়ে চলে যায়। রেখে যায় কিছু মায়া আর রংধনু স্মৃতির আবেশ। ডিসেম্বরের এ সময়টাতে রণ ও বারবারাকে খুব মনে পরে। লনটাকে দেখে মানসপটে ভেসে উঠে দুজনের মুখচ্ছবি! স্মৃতিময় বাড়িটা দেখলেই একটা দীর্ঘশ্বাস জমাট হয় চারপাশে। আমার সবুজ রঙের লেটারবক্সে এখন আর কোনকিছু আসেনা। আমি আগের পোষ্ট করা কার্ডগুলো খুলে শুভেচ্ছার অক্ষর গুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি। যেনো আজই পাওয়া কোন শুভেচ্ছা বার্তা! পোস্ট করা কোন কার্ড বা গিফট তো নয়। রণ আর বারবারা নামের মানুষের শূন্যতা আর মমতা বড় বেশী বুকে বাজে বড় দিন এলে!




কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি





Share on Facebook               Home Page             Published on: 24-Dec-2023

Coming Events: