bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













বাড়ি ফেরা
কাজী সুলতানা শিমি




ডঃ ফিলিপ নীৎসে
সেটা ছিল ২০১৮ সালের মে মাস। ডেভিড গডেল মনে মনে ঠিক করলেন, এবার তিনি বাড়ি ফিরবেন। এই অস্থায়ী ভুমে তার জীবনযাত্রার মান একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তিনি পরিবার, সমাজ, এমনকি দুনিয়াকে আর কিছুই দিতে পারছেন না। দেয়ার কিছুতো নেই-ই বরং কেমন অসহায় আর অপ্রয়োজনীয় লাগে নিজেকে সারাক্ষণ। বিজ্ঞানী, গবেষক, শৌখিন-অভিনেতা হিসেবে যে জীবন ছিলো বর্ণিল। আলো ঝলমলে। এখন এই নির্জীব, একাকিত্বে অযথা শরীরটা কষ্ট করে বয়ে বেড়াবার কোন অর্থ নেই। তো, যেই ভাবা সেই কাজ। তিনি ফিলিপ নীৎসের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তার মনোবাসনার কথা জানালেন। কে এই ফিলিপ নীৎসে!

“ড. ডেথ”-নামে পরিচিত ফিলিপ নীৎসে Exit International নামে একটি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। স্বেচ্ছামৃত্যুর আইনি বৈধতা পাবার লক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন দুনিয়া জুড়ে। তিনি ১৯৭২ সালে লেজার ফিজিক্সে ডক্টরেট করার পর, বিজ্ঞানী কিংবা পদার্থবিদ না হয়ে পার্ক রেঞ্জার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন নর্দান টেরিটরিতে। কাজ করার সময় এক দুর্ঘটনায় পায়ে মারাত্মক আঘাত পেয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পরেন। তখন আবারো ক্যারিয়ার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৮৮ সালে তিনি সিডনী ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিবিএস পাশ করেন। ডঃ ফিলিপ নীৎসে, বিশ্বের প্রথম চিকিৎসক যিনি ১৯৯৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় নর্দান টেরিটরিতে স্বেচ্ছামৃত্যু কার্যকর করেন আইনগত ভাবে। সেকারণে এবং সেই থেকে তার নাম হয় “ড. ডেথ”।

ডঃ ফিলিপ নীৎসে ১৯৯৭ সালে “এক্সিট ইন্টারন্যাশনাল” প্রতিষ্ঠা করার কারণে ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়া মেডিক্যাল বোর্ড চিকিৎসক হিসেবে তার রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে। এই ঘোষণায় তিনি অস্ট্রেলিয়া মেডিক্যাল বোর্ডের বিরুদ্ধে মামলা করেন এবং মামলায় হেরে গেলে প্রতিবাদ হিসেবে প্রকাশ্য জনসমক্ষে তিনি তার সমস্ত সার্টিফিকেট পুড়িয়ে ফেলেন। মেডিক্যাল বোর্ডের যুক্তি ছিল চিকিৎসকদের কাজ যেকোন মূল্যে মানুষের জীবন বাঁচানো। স্বেচ্ছামৃত্যুর প্রচারণা তাই শপথের পরিপন্থী। পরবর্তীতে আপীল করে জিতে গেলেও মেডিক্যাল বোর্ডের আর্জিতে কোর্ট তার প্র্যাকটিসের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করে। তখন, অস্ট্রেলিয়া মুক্তচিন্তার দেশ নয় এই অভিমান ও অভিযোগে তিনি দেশ ছেড়ে নেদারল্যান্ডে চলে যান এবং সেখান থেকেই এই প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। স্বেচ্ছামৃত্যু বরন করতে ইচ্ছুক এমন যেকোন মানুষকে তিনি আইনি সহায়তা থেকে শুরু করে সার্বিক সহযোগিতা দিতে এগিয়ে আসেন।

পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার ইচ্ছার কথা জানিয়ে ডেভিড গডেল যখন তার সাহায্য চাইলেন, স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এগিয়ে এলেন নীৎসে। যাবতীয় প্রস্তুতি শেষে ডেভিড গডেলকে তিনি এয়ারপোর্ট থেকে সুইস ফাউন্ডেশনের নির্দিষ্ট মেডিক্যাল সেন্টারে নিয়ে যান। অস্ট্রেলিয়া থেকে সুইজারল্যান্ড যাবার পথে ফ্রান্সে ডেভিড পরিবারের সাথে কিছু সময় কাটান। তারপর আনন্দ ও আন্তরিকতার সাথে বিদায় নেন। গডেল সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে আমার নিজের জীবন নিজে শেষ করার সুযোগ পেয়েছি। সবার কাছ থেকে আন্তরিক বিদায় নিয়ে শান্তিতে বাড়ি ফিরতে পারছি। তিনি নিঃসংকোচে জীবন-বিমুখতার কথা স্বীকার করে বলেন, যখন জীবন ও সমাজকে কিছুই দেয়ার থাকেনা তখন সম্মানের সাথে চলে যাওয়াটা একটি ন্যায্য অধিকার হওয়া উচিৎ। গ্লানি নেই, অমর্যাদা নেই। শ্রদ্ধা ও সম্মান নিয়ে বাড়ি ফেরার মতো।

জৈন ধর্মে সান্থারা নামে একটি প্রথা আছে। দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে দেহ থেকে বিদেহী হওয়ার এই ধর্মীয় প্রথা হলো পরমাত্মায় রূপান্তরিত হওয়া। যখন শরীর আর চলেনা, জীবনের সব চাওয়া ও পাওয়ার হিসেব চুকে যায় মৃত্যুকে আহবান করার এই রীতিকে সান্থারা বলে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে ভারতের কোলকাতায় সুহানি দেবী এই সান্থারা পদ্ধতিতে দেহ পরিত্যাগ করে স্বর্গ-যাত্রার আয়োজন করেন। দীর্ঘদিন রোগে ভোগা অবস্থায় পরিবার ও নিজের যন্ত্রণা মুক্তির লক্ষ্যে সুহানি দেবী ধর্মীয় রীতিতে পরমাত্মা হবার সিদ্ধান্তে অনশন শুরু করেন। পরিবারের লোকেরা তাকে সম্মান জানিয়ে তার দেহ ত্যাগ পর্যন্ত প্রার্থনার আয়োজন করেন। দুঃখ নেই, গ্লানি নেই। প্রার্থনা আর শান্তির মাধ্যমে মৃত্যু কামনার পরিবেশে সুহানি দেবী ১১ দিন অনশনের পর দেহ ত্যাগ করেন। ভারতীয় বেশকিছু ধর্মীয় বিশ্বাসে স্বেচ্ছামৃত্যু সমাদৃত। কেননা শাস্ত্রমতে বিনাশ ঘটে শরীরের, প্রাণের তো বিনাশ নেই।

বেটসি ডেভিস ক্যালিফোর্নিয়ার একজন চিত্রকর ও স্টেজ পারফর্মার। মাত্র ৪১ বছর বয়েসে জানতে পারলেন তিনি প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত। এ রোগের কারণে ধীরে ধীরে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও শরীর সব বিকল হয়ে পড়বে। এর কোন চিকিৎসা নেই। একথা জানার পর ২০১৩ সালে তিনি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের পরিকল্পনা করেন। পুরোপুরি অচল হয়ে পরার আগে তিনি তার শখ ও ইচ্ছাগুলো উপভোগ করে যেতে চান। তাই এই পরিকল্পনা। ভ্রমণ শেষে এক পার্টির আয়োজন করেন তিনি। তার সব প্রিয়জনদের সান্নিধ্যে থেকে তিনি শেষ বিদায় নিতে চান এই আশায়। নিমন্ত্রণ পত্রে লিখা ছিলো, “ডিয়ার রিবার্থ পার্টিসিপেন্ট, সাহসী মন নিয়ে আমাকে বিদায় জানানোর জন্য তোমাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এই পার্টির কোন নিয়ম নেই। তোমরা যা খুশী তাই করতে পারো। নাচ, গান, আনন্দ-স্ফূর্তি, প্রার্থনা, যেমন ইচ্ছে। শুধু আমার সামনে কাঁদতে পারবেনা, এই নিয়ম মানতে হবে।“ সেদিন নীল-সাদা কিমানো ড্রেসে বেটসি জীবনের শেষ সূর্যাস্ত দেখলেন প্রিয়জনদের সাথে। সন্ধ্যে ছয়টার পর চিকিৎসক সবার উপস্থিতিতে পার্টিতেই বেটসিকে একটা ইনজেকশন দিলেন। তার চার ঘণ্টা পর পার্টি থেকে বেটসি চলে গেলেন দুর আকাশে তারা হয়ে। এই আনন্দ বিদায় একজন সাহসী মানুষের পক্ষেই সম্ভব।

এ সবই মানুষের গল্প। স্বেচ্ছামৃত্যুর বাস্তবতার গল্প। বলা হয় সময়ের চাওয়া। ভিক্টোরিয়া অঙ্গ রাজ্যে স্বেচ্ছামৃত্যু বৈধ। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ায় গত বছর আইনটি পাশ হয়েছে; এ বছর থেকে প্রয়োগ শুরু হবে। সম্প্রতি তাসমানিয়ার আপার হাউসে স্বেচ্ছামৃত্যুর আইন পাশ হয়েছে। একসময় জন্ম-নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটি নিয়ে প্রবল বিরোধিতা ছিলো। এখন মৃত্যু-নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেকে ঘোর বিরোধিতা করছেন। সময় ও পরিস্থিতিতে এই আবেগ একসময় স্বাভাবিক হয়ে আসবে হয়তো।

সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়ানো, কিংবা প্রতিযোগিতার দৌড়ে ন্যুব্জ হয়ে পড়া পরিবারের যখন চিকিৎসা খরচ বইবার সামর্থ্য থাকবেনা তখন প্রিয়জনদের এই কষ্ট দেখা কতোটা যৌক্তিক! ব্যয়ভার, যন্ত্রণা, নাকি আবেগ কে বেশী জোরালো সময়ই ধীরে ধীরে তা ঠিক করে দেবে।

জীবন-মৃত হয়ে বাঁচবার চেয়ে শ্রদ্ধার সাথে বিদায় নেয়াই বোধকরি অধিক সম্মানের। যে জীবন ছিলো আদরের, ভালোবাসার, আকাঙ্ক্ষার - সে জীবন এমন অবহেলায়, যন্ত্রণায়, গ্লানিতে ভরবার কি প্রয়োজন! স্বামী বিবেকানন্দের কথায়, “জীবন হলো প্রদীপের মতো, যা প্রতি মুহূর্তে পুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অর্থহীন ভাবে বেঁচে থাকা কি সম্মানজনক? মৃত্যুর অন্ধকার সুড়ঙ্গে মাথা উঁচু করে প্রবেশের অধিকার কি থাকতে নেই?”

আসলে যেতে তো হবেই, সন্ধ্যা নামার আগেই বাড়ি ফেরাই মঙ্গল নয় কি!




কাজী সুলতানা শিমি, সিডনি




Share on Facebook               Home Page             Published on: 23-Nov-2020

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot