bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













সিডনিতে বাংলাদেশী মেয়ের
নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং আমাদের সন্তানেরা

সোলায়মান দেওয়ান



আমি ক্রাইম থ্রিলার মুভি ছাড়া তেমন কোন মুভি দেখি না। সেই কলেজ জীবন থেকে এই ধরনের মুভির প্রতি আমার আসক্তি। মনে আছে, বউয়ের উৎসাহে অনেকদিন আগে একটা ক্রাইম থ্রিলার উপন্যাসও লিখেছিলাম। এখনও প্রতিদিন বাসায় ফিরে রাতে ডিনার করার পর, আরাম করে বসে এক ঘণ্টা কোন ক্রাইম থ্রিলার মুভি বা সিরিজ দেখি। আমার এই পছন্দের কথা আমার বউ, ছেলে, মেয়ে সবাই জানে। আমি মাঝে মাঝে তাদের সাথে সাইবার ক্রাইম থেকে, ড্রাগ, কিডন্যাপ সহ সব ঘটে যাওয়া বিষয়ে গল্প করি। তারপর তাদেরকে জিজ্ঞাসা করি, এখানে কি কি সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল। ওরা উত্তর দেয়। আমি মন দিয়ে শুনি। আমি বলি, ওরা শুনে। এটা আমাদের একটা খেলা। আমার ছেলেরও প্রিয় সাবজেক্ট “ক্রিমিনোলোজি”। সে এই বিষয়েই উচ্চতর পড়াশোনা করার প্ল্যান করে রেখেছে।

পৃথিবীর অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় অস্ট্রেলিয়াতে ক্রাইম রেইট খুব কম। তাই হঠাৎ যখন ভয়াবহ কোন ক্রাইম ঘটে, তখন এই দেশের মানুষ প্রচণ্ড রকম একটা ধাক্কা খায় আর সেটা যদি আমাদের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে ঘটে তাহলে তো কথাই নেই।

কিছুদিন আগে সেই রকম একটা ঘটনাই ঘটেছে। অনিমা নামে বারো/তেরো বছরের একটা ফুলের মত মেয়ে তার মা বাবার সাথে মাইগ্রেশন নিয়ে এই দেশে আসে। এখানে যারা মাইগ্রেশন নিয়ে আসেন। তাদেরকে একটা সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। বলা যায়, এই সংগ্রামে বাংলাদেশীরা, তাঁদের পরিশ্রমের কারণে, কম বেশী সবাই তাঁদের কাঙ্ক্ষিত সফলতা অর্জন করছে। এই পরিবারটিও এর ব্যতিক্রম ছিল না। মেয়েটি ভাল ভাবে স্কুল- কলেজ শেষ করে মেডিকেলে ভর্তি হয়। তারই সম বয়সী একটা পাকিস্তানী ছেলেকে সে পছন্দ করে ফেলে। মা বাবার নিষেধ সত্ত্বেও সে ছেলেটির সাথে সম্পর্ক নষ্ট করেনি। এই কারণে মা বাবার সাথে তার একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। সে ছেলেটির সাথে থাকা শুরু করে (এবং এক সময় হয়ত ছেলেটিকে বিয়ে করে)। কিন্তু ছেলেটির সাথে তার যে সুখের সময় কাটছিল, তা নয়। মেয়েটি পুলিশের কাছে ছেলেটির বিরুদ্ধে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অভিযোগ করে। পুলিশের অভিযোগ ছেলেটি মেয়েটিকে নির্মম ভাবে খুন করেছে। বানিংস থেকে এসিড কিনে এনে সে মেয়েটির লাশ বাথটাবে রেখে পুরো শরীর এসিড দিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে। পুলিশ যেদিন বাসার দরজা ভেঙ্গে ভিতরে ঢুকেছিল, সেদিন মেয়েটির শরীরের সব কিছু এসিডে গলে গিয়েছিল শুধু পায়ের গোড়ালি ছাড়া।

এই ঘটনা যে কোন ক্রাইম থ্রিলারের মতই। সিনেমাতে যা দেখে সাসপেন্স বা উত্তেজনা লাগত, বাস্তবে তা দেখে ও জেনে আমার মত অনেকেই হতবিহবল হয়ে গেছে। আমি নিজেও মেয়ের বাবা। আমি হৃদয় দিয়ে মেয়েটির মা বাবার কষ্টটা যেন উপলব্ধি করলাম। বুকটা প্রচণ্ড শূন্যতায় ভরে গেল। সারাদিন অফিসে মন বসাতে পারলাম না। বাসায় এসে, আমার ১০ বছরের মেয়ের কাছে গেলাম। আমার মেয়েটি তখন স্কুলের হোম ওয়ার্ক করছিল। আমি চুপ করে ওর পাশে বসলাম, ও বলল, “পাপা কিছু বলবে”? আমার মেয়েটি আমার চেহারা দেখেই যেন বুঝেছিল আমি কিছু বলতে এসেছি। আমি বললাম, “হ্যাঁ মা”। এই বলে, আমি আমার মেয়েকে অনিমার এবং সাথের ছেলেটির ছবি দেখালাম। এরপর ওকে সব ঘটনা খুলে বললাম। আমার মেয়ে মন দিয়ে শুনল। কথা শেষ করে, আমি মেয়েকে বললাম, “মা তুমি বুঝতে পেরেছো এখানে মেয়েটি কি ভুল করেছিল”? আমার দশ বছরের মেয়েটি বলল, “মেয়েটির উচিৎ ছিল ছেলেটি থেকে দূরে সরে যাওয়া, ও ওর মা বাবার কাছে যেতে পারত”। আমি বললাম, “আর”? আমার মেয়ে বলল, “ওর উচিৎ ছিল কাউকে বলা, কারো সাহায্য চাওয়া”। আমি আমার মেয়ের মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিলাম। আমার মেয়ে বলল, “পাপা, আমি কিন্তু কোনদিন তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাব না”। আমি আমার মেয়ের কপালে আদর দিয়ে বললাম, “আমার মেয়ের জন্য তার বাবার দরজা সব সময় খোলা (মাই ডোর ইজ অলওয়েজ ওপেন ফোর মাই ডটার)”।

আমার মনে পড়ে গেল, প্রায় ২৪ বছর আগে সিডনিতে আমার এক বন্ধুর মামা সোবহান সাহেবের সাথে আমার পরিচয় হয়। সোবহান মামা অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। রিফিউজি ভিসার জন্য আবেদন করে এই দেশে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। তিনি যখন রেসিডেন্সি পান, তখন দেশে গিয়ে ছেলে মেয়েকে নিয়ে আসেন। তার ছেলের বয়স ১৩ বছর আর মেয়ের ১০ বছরের মত হবে। তিনি লাকেম্বাতে মসজিদের পাশে বাসা নেন, এই আশাতে যে, তার ছেলে মেয়ে ধর্মীয় পরিবেশের মধ্যে থাকবে। মসজিদের আজান দেওয়ার সাথে সাথে তিনি ছেলেকে মসজিদে নামাজের জন্য পাঠিয়ে দিতেন। ঘরে মেয়ে এবং স্ত্রী নামাজ পড়তেন। তাঁরা অত্যন্ত পর্দাশীল ছিলেন। তিনি আমাদের খুব স্নেহ করতেন। একসময় আমি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে তার সাথে যোগাযোগ কমে যায়। প্রায় আট নয় বছর পর তার সাথে আমার একবার দেখা হল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মামা ভাল আছেন? তিনি আমাকে দেখে কেঁদে ফেললেন। তারপর যা বললেন, তা হল এই যে, তার ছেলে মসজিদে আসা যাওয়া করতে করতে কিছু লেবানীজ ছেলেদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে এবং এখন তাদের সাথে মিশে ছেলে বিপথে চলে গেছে। চুরি-চামারি থেকে মেয়েদের উত্যক্ত করা-কোন কিছুই বাদ নেই । মেয়ে ছিল শান্ত শিষ্ট। একদিন স্কুল থেকে ডেকে পাঠাল যে, মেয়েটি অনেক দিন ক্লাস করছে না। খোজ নিয়ে জানতে পারলেন, মেয়েটি ক্লাস বাদ দিয়ে আরেকটা ছেলের বাসায় গিয়ে সময় কাটাত। ধর্মীয় অনুশাসন দিয়ে তিনি তাদের রক্ষা করতে পারেন নি।
দেশীয় সংস্কৃতি এবং সামাজিক মূল্যবোধ দিয়ে যে ছেলে মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, সেটা লন্ডন আমেরিকাতে বসবাসরত অনেক সিলেটি আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকে শুনেছি এবং নিজেও লন্ডনে থাকার সময় দেখেছি।

এই ঘটনার পর অনেকে তাঁদের মতামত ফেইসবুকে লিখেছেন। কেউ ধর্মীয় মূল্যবোধ, কেউ সামাজিক অবক্ষয়, কেউ আমাদের সংস্কৃতি, কেউ পাশ্চাত্য কালচার, কেউ ল্যাংগুয়েজ বেরিয়ার নিয়ে লিখেছেন। আমি প্রায়ই সব লেখা মন দিয়ে পড়েছি। সবার কথাই তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে ঠিক। কিন্তু সবচেয়ে মূল্যবান কথাটা কিন্তু অনেকেই বলেননি, আর সেটা হল, সন্তানের সাথে বন্ধুত্ব সম্পর্ক গড়ে তোলা। সন্তানের সাথে সহজ, সরল, অকপট সম্পর্ক গড়ে তোলা। এই সম্পর্ক গড়ে তোলা ছাড়া আমি বা আপনি কোনদিন তাদের আস্থা অর্জন করতে পারব না। অশুভ’র অপচ্ছায়া শুধু বাইরেই ওত পেতে নেই, ডিজিটাল টেকনোলোজির যুগে অপচ্ছায়ারা আমাদের বেড রুমে প্রবেশ করেছে। ধর্ম, সমাজ, সংস্কৃতি, নৈতিকতার বাঁধ ভেঙ্গে তারা গ্রাস করে নিতে চাইছে আমাদের সন্তানদেরকে। আমাদের সন্তানদেরকে কত যে অনিরাপদ, অরক্ষিত সময় ও পথ অতিক্রম করতে হচ্ছে, তা আমাদের সময় ও পরিবেশ দিয়ে বিবেচনা করাটা হবে ভুল। তাদের বয়সটাই ভুল করার। তাদের বয়সটাই নিয়ম ভাঙ্গার, রোমাঞ্চকর আর ভালোলাগার কিছুতে গা ভাসিয়ে দেওয়ার। মা বাবা হিসাবে আপনি তাদের সামনে ভালমন্দ দিকটা তুলে ধরতে পারেন কিন্তু সেটা মানা না মানার সিদ্ধান্ত কিন্তু তাদের। সেখানে জোর খাটালেই আসবে বিপত্তি। বরং তাদের এই ভুল পথে সব সময় পাশে থাকতে হবে। তাদের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট রাখতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে, যাই ঘটুক না কেন, আপনার দরজা তাদের জন্য সব সময় খোলা।

আপনি শুধু আশা করতে পারেন, হয়ত কোনদিন ভুল বুঝে সে ফিরে আসবে। যদি না আসে, যদি সে তার বাঁ তাদের জীবন নিয়ে সুখী থাকে, তাদের সেই আপাতত সুখ মেনে নিতে হবে। কারণ জীবনে বেঁচে থাকার চেয়ে বড় মূল্যবান আর কিছু নেই। মনে রাখতে হবে সন্তান আমার। এই সন্তান হারিয়ে গেলে বুকের ভিতর যে রক্ত ক্ষরণ হবে, তা আমাকেই একা সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।





সোলায়মান দেওয়ান, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 25-Feb-2022

Coming Events: