bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












বদরুল আলম খানের
“সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন”
গ্রন্থের উপর কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

সূর্য কিঙ্কর মজুমদার


গত ২৫ ডিসেম্বর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ৩০তম বার্ষিকী। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ভূ-রাজনৈতিক বিপর্যয় হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কেন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত স্পষ্ট কোনো পূর্বলক্ষণ ছাড়াই সোভিয়েত ইউনিয়ন নামের এই পরাশক্তি ও পৃথিবীর বৃহত্তম দেশটি যা কয়েক দশক ধরে দ্বিমেরু বিশ্বের অন্যতম মেরু হিসেবে পরিগণিত ছিল একনিমিশে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেল, বিংশ শতাব্দীর সবচাইতে বিস্ময়কর এই প্রশ্নের উত্তর বদরুল আলম খানের রচিত “সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন” গ্রন্থটিতে খুঁজে পাবেন। তাছাড়া আরো পাবেন সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্থান থেকে পতনের পুঙ্খানুপুঙ্খ অভূতপূর্ব বিশ্লেষণ।

১৩ নভেম্বর সিডনিতে একটি অতি মনোরম পরিবেশে প্রায় ৬২ জন সিডনি প্রবাসী বাংলাদেশি সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশে বদরুল আলম খান তাঁর প্রকাশিত “সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন” গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করেন। এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে বাংলাদেশের প্রথমা প্রকাশন।

সৌভাগ্যক্রমে আমার গ্রন্থটির প্রাথমিক পর্যায়ের পাণ্ডুলিপিটি পড়ার সুযোগ হয়েছিল। আমি ও বদরুল আলম খান মস্কোতে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেছি। আমার সুদীর্ঘ ৪৬ বছরের মস্কোতে অভিবাসী জীবনের অভিজ্ঞতা এবং চোখের সামনে দেশটিকে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে যেতে দেখেছি বিধায় লেখক হয়ত আমাকে পাণ্ডুলিপিটি পড়ার সুযোগ দিয়ে গ্রন্থটির মূল্যায়ন ও মন্তব্য সংযোজনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। আমার উপর এই গুরুদায়িত্ব অর্পণের ও বিশ্বাস পোষণ করার জন্য আমি লেখকের কাছে খুব কৃতজ্ঞ। পরে অবশ্য বদরুল আলম খান গ্রন্থটির অনেক পরিবর্তন সাধন করেছেন। নাম ও প্রচ্ছদ দুটিরই পরিবর্তন আনা হয়েছিল। আমি পাণ্ডুলিপিটি পড়ে খুব অভিভূত ও আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম এই কারণে যে, রুশ সাম্রাজ্যের বিস্তারিত ইতিহাস, রুশ জাতীর উদ্ভব, রুশ ভাষার জন্ম-কথন, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, চিত্রকলা, সঙ্গীত, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সমাজজীবনের এমন অন্তর্দৃষ্টি-পূর্ণ বিশ্লেষণ আমি অনেক নামি-দামী রুশ বিশেষজ্ঞদের মধ্যেও খুব কম লক্ষ্য করেছি।

“সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন” গ্রন্থটি কোন কল্পকাহিনী নয়। কারো মুখের কথা শুনে লেখা নয়। এই গ্রন্থটি চরম বাস্তবতার অবিসংবাদিত একগুচ্ছ ঘটনাবলির প্রতিফলন। নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, গ্রন্থটি লেখা হয়েছে বদরুল আলম খানের রাশিয়াতে সুদীর্ঘ ১১ বছরের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। গ্রন্থটিতে আছে রুশ আত্মার সন্ধানে জার-তন্ত্রের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ইতিহাস, রুশ-বিপ্লবের, বিপ্লবোত্তর গৃহযুদ্ধের, আনকোরা সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার, বিভীষিকাময় দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের, পশ্চিমা দেশগুলির সাথে পঞ্চাশ বছরের স্নায়ু যুদ্ধের, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতির, লেনিন থেকে সমসাময়িক রাষ্ট্রনায়কদের শাসন আমলের রাজনৈতিক উত্তান-পতনের বিস্তারিত কথা – অল্প কথায় গ্রন্থটি আমার মতে একটি অনবদ্য সংকলন।

আমরা যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে পড়তাম তখন কেউ যদি আমাদের বলতেন যে, একদিন এই মহাশক্তি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে, তাঁকে আমরা হয়ত তখন নিঃসন্দেহে পাগল ভাবতাম। এমন সচল ও পেশাদার এবং কার্যকরী ছিল সোভিয়েত প্রোপাগান্ডা। তখন ঘুণাক্ষরেও বুঝিনি যে, এই সম্মোহিত ছবির ভিতর লুকিয়ে আছে অবশ্যম্ভাবী ধ্বংসের দৈত্য।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কারণগুলি এখনও বিতর্কের বিষয়, তবে প্রধানগুলি বেশ সুস্পষ্ট। লেখক সোভিয়েত রাষ্ট্র কেন ব্যর্থ হল তার কারণগুলি কয়েটি ভাগে ভাগ করেছেন। কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থার উত্থান পতনে আধ্যাত্মিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কারণ অন্তর্নিহিত থাকে। ঠিক তেমনি থাকে অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক কারণ। আমি গ্রন্থটিতে লেখক সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার যে চারটি কারণ উল্লেখ্য করেছেন তার বিশ্লেষণ না করে, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণগুলির বিশদ পর্যালোচনা করব। এই কারণগুলি বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করা প্রয়োজন। এতে আমার ধ্যান ধারনার কিছু প্রতিফলন থাকলে তার জন্য লেখকের কাছে ক্ষমা প্রার্থী।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন ও দেশের অর্থনীতির উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেশটির পতনের অন্যতম কারণ। অক্টোবরের বলশেভিক বিপ্লবের সময় ব্যাপকভাবে ঘোষিত শ্রমজীবী শ্রেণীর একনায়কত্বের পরিবর্তে শেষপর্যন্ত ব্যক্তি ও কমিউনিস্ট পার্টির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে জনগণ ও সরকারের মধ্যে যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তাই সোভিয়েত শাসন ব্যবস্থায় জনগণের ইচ্ছার কোনো প্রতিফলন কখনই ঘটেনি। দলের নেতারাও জনগণের সঙ্গে যোগাযোগের সেতু নির্মাণের চেষ্টাও কোনদিন করেননি। বরং কমিউনিস্ট পার্টির অবাস্তবোচিত জন-বিচ্ছিন্ন সিদ্ধান্ত জনগণকে আরো বিচ্ছিন্ন করে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে ত্বরান্বিত করেছে।

সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ পতনের আরকটি অনুঘটক। কমিউনিস্ট পার্টি লেখক, কবি, শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতা এমনকি বিজ্ঞানীদের চিন্তার স্বাধীনতায় নিয়মিত হস্তক্ষেপ করেছে। মুক্ত-চিন্তাশীল ব্যক্তিদের কার্যকলাপের উপর সেন্সরশিপ, বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অভাব সোভিয়েত জনজীবনকে অসহনীয় করে তোলে। এর ফলস্বরূপ, বরিস পাস্তেরনাক, আলেকজান্ডার সলজেনিৎসিন, সের্গেই আইজেনস্টাইন, সের্গেই প্রকোফিয়েভ, দিমিত্রি শোস্তাকোভিচ, সিভেতোস্লাভ রাসত্রাপোভিচ, জোসেফ ব্রডস্কি, আন্দ্রেই সাখারভ প্রমুখ কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপের সমালোচনা করায় হেয় প্রতিপন্ন হয়েছেন, নির্বাসনে গেছেন, এমনকি কেউ কেউ দেশ ছাড়তেও বাধ্য হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন নোবেল প্রাইজ ভূষিত। রাষ্ট্রের এমন অদূরদর্শিতা দেশের পতনের পথ সুগম করেছে।

দুর্বল পরিকল্পিত অর্থনীতি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ বললে ভুল হবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নের গড় জাতীয় আয়ের (জিডিপি) ৩০ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় হত। পুঁজির অভাবে ভোগ্যপণ্য ও শিল্প-কারখানার উৎপাদন না হওয়ায়, মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্রমান্বয়ে ব্যাহত হতে থাকে। অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণের অভাব, কৃষি ও শিল্পে অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ, সম্পদের অপচয়, শ্রমিকদের অধ্যক্ষতা, আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে পশ্চাদপদতা এবং শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মানুষের মাথাপিছু আয় ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে । কৃষিতে যৌথ খামার ব্যবস্থা কৃষকদের দুর্দশাকে আকাশচুম্বী করে তোলে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রজাতন্ত্রগুলির মধ্যে বাজেটের অসম বণ্টন অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের একটি বিশেষ কারণ। কেন্দ্রীয় বাজেটের তহবিল প্রজাতন্ত্রগুলির মধ্যে অসম ভাবে বিতরণ করা হত। দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনায় তাঁদের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে খুব কমই বিবেচনায় নেওয়া হত। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার প্রজাতন্ত্রের উৎপাদন এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর আধিপত্য বিস্তার করে প্রজাতন্ত্রগুলিকে তাঁদের প্রাকৃতিক সম্পদ এবং উৎপাদনের উপর মালিকানা থেকে বঞ্চিত করত । ফলস্বরূপ প্রজাতন্ত্রগুলি সম্পূর্ণরূপে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভরশীল ছিল যা তাঁদের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অসন্তোষ বাড়িয়ে তোলে। আশির দশকের শেষের দিকে, প্রজাতন্ত্রগুলি তাদের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করতে শুরু করে। তাঁরা ইউনিয়ন বাজেটে কর প্রদান বন্ধ করে কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সকল প্রকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে।

আন্তর্জাতিক বাজার সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাপনার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক বাজারে টিকতে পারেনি। তাছাড়া প্রতিযোগিতামূলক বাজারে পণ্য তৈরিতে বাকি বিশ্ব যেভাবে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করেছিল তার সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থা খাপ খাওয়াতে না পারায়, পণ্য উৎপাদনে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। নিম্নমানের ভোগ্য পণ্যের চাহিদা যেমন দেশের ভেতরে ছিলনা, ঠিক তেমনি তার চাহিদা বিদেশেও না থাকায়, রপ্তানির কোন সুযোগ ছিলনা। জনসংখ্যার অধিকাংশই তাঁদের শ্রমের ফলাফলের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তাই তাঁদের কর্মক্ষমতা ছিল সর্বনিম্ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের অধিবাসীরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাঁরা পশ্চিমা দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান থেকে অনেক পিছিয়ে। এই বাস্তবতা তাঁদের কোন প্রেরণা জোগাতে ব্যর্থ হয়েছিল । সমাজতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা তাই বাজার প্রতিষ্ঠান প্রতিস্থাপন করতে পারেনি। সোভিয়েত ইউনিয়নে বসবাসকারী মানুষের উদাসীনতা দেশটির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড একবারে ভেঙ্গে দেয়।

সীমাহীন দুর্নীতি, আমলাদের অযোগ্যতা, দায়িত্ব হীনতা ও অদক্ষতা সোভিয়েত অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে। পঞ্চাশ বছরের স্নায়ু যুদ্ধের ফলস্বরূপ সোভিয়েত ইউনিয়ন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা অর্থনীতির সাথে অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। বিভিন্ন প্রকার আন্তঃ মহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র এবং পারমাণবিক মারণাস্ত্র, মহাকাশে প্রতিযোগিতা, দশ বছর ব্যাপী আফগান যুদ্ধ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি সোভিয়েত ছত্রধর দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচুর অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যদান সোভিয়েত অর্থনীতিকে সুনামির মত আঘাত করে। দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন না করে, ব্রেজনেভ স্নায়ুযুদ্ধে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। ব্রেঝনেভের আমল থেকেই দেশটির ভিত্তিতে মরচে পড়তে শুরু হয়েছিল।


সোভিয়েত অর্থনীতি তেল ও গ্যাস রপ্তানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের বৃহত্তম জ্বালানি উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে পৃথিবীর শক্তিশালী বা পাওয়ার হাউজ হিসেবে গণ্য হোতো। কিন্তু ১৯৮৬ সালে তেলের দাম ১২০ ডলার থেকে নেমে ব্যারেল প্রতি ২৪ ডলার হলে সোভিয়েত অর্থনীতির ভীত পুরোপুরি ভেঙে যায়। তার সঙ্গে যুক্ত হতে থাকে একের পর এক মার্কিন বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা। বছরের পর বছর অর্থনৈতিক স্থবিরতা সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেতর থেকে পঙ্গু করে দেয়। সোভিয়েত অর্থনীতি তখন ঘুণে ধরা এক অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছিল।

১৯৮৬ সাল থেকেই সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ক্রমশ প্রকট হতে থাকে। সেই সাথে গরবাচেভ এবং ইয়েলৎসিনের দ্বন্দ্ব, ধীর বিষক্রিয়ার মত কাজ করে, দলকে ক্রমশ দুর্বল করে দেয়। ফলস্বরূপ, ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত রাজনীতি দুই পরস্পর বিপরীত মেরুতে ভাগ হয়ে যায়। একদলের নেতৃত্ব দেন বরিস ইয়েলৎসিন এবং অপর দলের নেতৃত্ব দেন ইগর লিগাচেভ। এতে করে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও ঐক্য ভেঙ্গে পরে। এই সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত রাষ্ট্রীয় সংহতি বিপন্ন করে তোলে। ১৯৮৯ সালে লাটভিয়া, এস্তোনিয়া এবং লিথুয়ানিয়া প্রথম স্বাধীনতার দাবি জানায়। আর্মেনিয়া, মোল্দোভা, ইউক্রেন এবং জর্জিয়া দ্রুত তা অনুসরণ করে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙার একটি গুরুত্বপূর্ণ বাহ্যিক কারণ ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে সংঘটিত বিপ্লবসমূহ। সোভিয়েত ইউনিয়নের বাইরে পূর্ব ইউরোপে কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী কিছু দেশ ছিল, যাদেরকে সোভিয়েত স্যাটেলাইট স্টেট বলা হয়। এই দেশগুলো যেমন পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, ইউগোস্লাভিয়া, রোমানিয়া, পূর্ব জার্মানি ও হাঙ্গেরি সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ না হলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বারা প্রভাবিত ছিল এবং সেখানে সোভিয়েত আজ্ঞাবহ কমিউনিস্ট সরকার ক্ষমতায় ছিল। ১৯৮৯ সালে গর্বাচেভের নতুন সামরিক নীতি অনুযায়ী পূর্ব ইউরোপের স্যাটেলাইট দেশগুলো সোভিয়েত বলয় থেকে বের হতে চাইলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই দেশগুলিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করবে না বলে ঘোষণা দেয়। এর ফলস্বরূপ সোভিয়েত জোট মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কিছুদিনের মধ্যেই এই দেশগুলোতে কমিউনিস্ট বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এখানে বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য পোল্যান্ডে কমিউনিস্ট বিরোধী লেখ ওয়ালেন্সার নেতৃত্বে ট্রেড ইউনিয়নবাদী “সলিদারিটি” পার্টি কমিউনিস্ট সরকারকে স্বচ্ছ নির্বাচন প্রদানে বাধ্য করে। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে লেখ ওয়ালেন্সা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৮৯ সালে ৯ নভেম্বরে বার্লিন প্রাচীর ভেঙে দুই জার্মানি এক হয়ে যায়। এরপর ১৭ নভেম্বর থেকে ২৯ ডিসেম্বর চেকোস্লোভাকিয়ায় 'ভেলভেট বিপ্লবের’ মাধ্যমে সেখানকার কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাত করা হয়। ১৬ থেকে ২৬ ডিসেম্বর রোমানিয়াতে নাগরিক অশান্তি বিপ্লবে পরিণীত হয়ে নিকোলাই চশেস্কুকে ক্ষমতাচ্যুত করে কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটে। পূর্ব ইউরোপের এই ঘটানগুলি সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিত একেবারেই দুর্বল করে দিয়ে ভাঙ্গনের পথ প্রশস্ত করে।

১৯৯০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি একদলীয় শাসনের অবসান ঘটাতে ভোট দেয়। নতুন গঠিত আইনসভা সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি ত্যাগ করার পক্ষে ভোট দিয়ে রাশিয়ার সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র (বর্তমানে রাশিয়া) গঠন করে এবং ১২ জুন ১৯৯১ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বরিস ইয়েলৎসিন রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বরিস ইয়েলৎসিনের নেতৃতে বিরোধী গোষ্ঠীর সক্রিয় বিরোধিতার কাছে হার মেনে ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে গর্বাচেভ...

...পদত্যাগ করে বরিস ইয়েলৎসিনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। ২৫ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে শেষবারের মতো মস্কোর ক্রেমলিনের উপর সোভিয়েত পতাকা উড়েছিল। ঐ দিন থেকে নূতন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার যাত্রা শুরু হলে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব বরিস ইয়েলৎসিনের উপর বর্তায়। অতঃপর একটি একটি করে সব কয়টি প্রজাতন্ত্র স্বাধীনতা ঘোষণা করে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে আসায় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া পুরোপুরিভাবে সম্পূর্ণ হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ইতিহাস পর্যালোচনা করা বেশ কঠিন কাজ। তবে লেখক অতি নিপুণতার সাথে এই কঠিন ধাঁধার উত্তর হাল্কা রঙে পাঠকের জন্য বোধগম্য করে তুলে ধরেছেন। তিনি আবেগ দিয়ে বুঝতে চেয়েছেন বিংশ শতাব্দীর এই বিস্ময়কর ট্রাজেডির মূল কারণ। একটি সভ্যতা প্রায় ৭০ বছর টিকে থেকে হঠাৎ করে নিঃশেষ হয়ে গেল - অগণিত মানুষের সুখ, দুঃখ, স্বপ্নকে মিথ্যা করে দিয়ে সোভিয়েত রাষ্ট্র ভাঙল, প্রায় ২৯০ মিলিয়ন মানুষের জীবনে থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল, এর চেয়ে বড় ট্রাজেডি আর কি হতে পারে? এই ভাঙ্গনের প্রতিধ্বনির মধ্যে লেখক স্বদেশের ভাবনায় বিচলিত হয়েছেন। কোন মহাপ্লাবনের উত্তাল ঢেউয়ে বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেই প্রশ্নের উত্তর লেখকের কাছে দুর্জ্ঞেয় মনে হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও সাত কোটি মানুষ যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিল সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা আজও গঠিত হয়নি। তাই হয়ত লেখক গ্রন্থের পরিশিষ্টতে নিজের মাতৃভূমিকে নিয়ে তাঁর সংশয় ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেননি।

বদরুল আলম খান “সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন” গ্রন্থটি লিখেছেন অত্যন্ত সাবলীল ভাষায়। তাঁর অনবদ্য ও সর্বাঙ্গসুন্দর শব্দ চয়ন এবং চমৎকার বুনোন গ্রন্থটিকে পাঠযোগ্য করে তুলেছে। গ্রন্থটির প্রাথমিক নাম ছিল “তলস্তয়ের দেশে”। প্রচ্ছদও প্রথম নামকরণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অঙ্কিত হয়েছিল। পরবর্তীতে এই নাম পরিবর্তন করে “সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন” রাখা হয়। আসলে ভেঙেছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন – সোভিয়েত রাশিয়া নয়। কেন এমন নামকরণ করা হল তার ব্যাখ্যা লেখক মুখবন্ধে উল্লেখ করেছেন। যেহেতু বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই সোভিয়েত ইউনিয়ন বলতে সোভিয়েত রাশিয়াকেই বোঝে তাই লেখক এই কথাটি মনে রেখে গ্রন্থটির এমন একটি সার্বজনীন নামকরণ করেছেন। এতে করে গ্রন্থটির মাহাত্ম্য কোন অংশে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বরং পাঠককে কৌতূহলী করেছে এবং “সোভিয়েত রাশিয়া ভাঙল কেন” প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে পাঠকদের প্ররোচিত করবে । গ্রন্থটি পাঠকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাবে তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই।


সিডনি, ২৬ ডিসেম্বর ২০২১




ড. সূর্য কিঙ্কর মজুমদার, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 30-Dec-2021

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot