নীরবতার শব্দ
অন্তর্ভেদী প্রচণ্ড শীতের এই নিঃসঙ্গ রাতে বরফে ঢাকা এক প্রত্যন্ত গলির ল্যাম্পপোস্ট আমি আঁধারের ছায়া আমার স্বল্প আলোয় বিষণ্ণ, বিবর্ণ তবুও এই আঁধার আমার একমাত্র সহমর্মী।
নৈশব্দ আমার একমাত্র সঙ্গী যদিও তার বন্ধুত্বের দাবি কখনো রাখিনি, আমার চিন্তাগুলো শব্দ খুঁজে পায় অস্তিত্বের অন্তঃপুরে নীরবতার প্রশান্ত সমুদ্রে।
আমি কালের শেষ খুঁটিটার মত আজ কত বছর ধরে আমার মনের সুপ্ত বাসনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি শীতে-গ্রীষ্মে-শরৎ-বসন্তে, আমি বসে থাকি সেই ডাকপিয়নের বিরামহীন অপেক্ষায় কবে নিয়ে আসবে সে আমার বহু প্রতীক্ষিত ভালবাসার সোনালি ফিতায় মোড়ানো রঙিন খামটি।
আমার আলোর নিচে স্মৃতির বিমুগ্ধ তুষার ধূসর কালো খোয়া পাথরের রাস্তায় সযত্নে বিছিয়ে আছে বরফের নকশীকাঁথা, আলো আঁধারের লুকোচুরিতে তবে একি কোন অভিসারের পূর্বাভাস?
স্বপ্নেরা জেগে ওঠে শরীরের কোষে কোষে - মাটির বুক চিঁড়ে বীজের ক্রোড়ে লুকিয়ে থাকা নতুন জীবনের পূর্বাভাস আর একি সঙ্গে আমার ইচ্ছার নদীর বুকে জাগে জোয়ারের টান।
স্বপ্নভঙ্গ হলে নিঃস্পৃহ দৃষ্টিতে দেখি বিষাদের নৃত্যনাট্য - সময়ের ফুটপাথে আমি যেন এক বিজ্ঞাপনের মলিন বিলবোর্ড, নিদারুণ অবজ্ঞায় লুটিয়ে পরা স্বপ্নের মরদেহের উপর কালের শকুনিদের উল্লাস আর মনের অন্তর্বাস ছুঁয়ে থাকে শুধু কালের গভীর দীর্ঘশ্বাস।
আমার বৃত্তাবদ্ধ জীবনের অন্তরালে ঘনীভূত একাকীত্বের পোস্টারে আলো-আঁধারের ছায়া, উড়ে যায় আমার গোপন চিঠি বেনামি ঠিকানায় ভুলটা জেনেও প্রতিনিয়ত বসে থাকি উত্তরের অপেক্ষায়।
গভীর রাতের বুক চিড়ে আসে ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া শিশুর কান্না আমার মনের কান্না হেঁটে বেড়ায় নির্জন, নির্ঘুম গলির বুকে কান পেতে শুনতে পাই তার নীরবতার শব্দ, অভিশপ্ত একাকীত্ব গ্রাস করে রাতের আঁধার গলির খোয়া পাথরের রাস্তার মত আমিও কি হৃদয়ে সুপ্ত ব্যথার ইঙ্গিত পাই না - পাথরের কোন ব্যথার অনুভূতি নেই।
রাত গভীর হয় - আকাশ ভরে নামে তুষারের ঢল শীতের বাতাস রাতের আঁচলে রেখে যায় আমার অস্তিত্বের তপ্ত নিশ্বাস আমি আমার অনুজ্জ্বল আলোয় খুঁজে ফিরি ঘন তুষারপাতের দেয়ালের ওপারে প্রতীক্ষিত প্রেমের বিনম্র অনুরাগ।
সিডনি, ১২ই মার্চ ২০১৮
|
বিচ্ছিন্ন স্বপ্নের নিঃসঙ্গ গোলাঘর
অস্তগামী সূর্যটা ক্রমে নরম হয়ে গোধুলিবেলায় দিগন্তের দিক-চিহ্ন মুছে দিয়ে সন্ধ্যাপ্রদীপের কাছে করে যাবে সমর্পণ - আয়ুষ্কালের ক্যালেন্ডারের আরো একটি পাতা উলটে যাবে।
আকাশে শুরু হবে নক্ষত্রপুঞ্জের মৌন-মেলায় সময় আর ইচ্ছার তৃষ্ণা, স্বপ্নগুলি মিশে যাবে চাঁদের অলস ছায়ায়, নৈশব্দের নীল আগুনে আমার সব আশা নিশাচর পাখির মত রাত-নদী পেরিয়ে খুঁজবে শান্তি-সুখের সুবর্ণ দ্বীপ।
রাত গভীর হলে আমার বর্ধিষ্ণু স্মৃতির দেওয়ালে অপেক্ষারত সময়কে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি তখন ঘনীভূত একাকীত্বের ঝুলবারান্দায় ফেলে আসা দিনগুলির করব সন্ধান - যদিও ওদের স্মৃতি আজও মনের মণিকোঠায় সতেজ প্রাঞ্জল।
ঘড়ির কাটার লেজ ধরে রাত গভীর হবে আর চিন্তার সিঁড়িপথে অক্লান্ত মাকড়সা বুনবে জাল, বিরহী হৃদয়ের ক্লান্তিগুলি অবশেষে হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়াবে - আর অদম্য আকাঙ্ক্ষাগুলি স্পর্শ করবে অবসাদের সেই কলঙ্ক প্রাচীর।
দূরের সপ্তমীর চাঁদের মিষ্টি আলো জানালার ভেতর দিয়ে উঁকি দিয়ে কমল পরশ বুলিয়ে যাবে আমার চোখে-মুখে, মনের অন্তরালে বয়ে যাবে বিলুপ্ত প্রায় প্রশান্তির সঞ্চালন।
পুকুরের শান্ত জলে আনমনে হারিয়ে যাবে জ্যোৎস্না রাতের মায়াবী প্রতিচ্ছবি, আমি অপেক্ষায় রইব রুপালি রাতের পরে সোনালি ভোরের - আবার ইচ্ছারা বেগ পাবে পদ্মপাতায় সকালের শিশির দিয়ে প্রথম প্রেমের কবিতা লেখার অসফল প্রচেষ্টার।
মন ছুটে যাবে দূরে-বহুদূরের শঙ্খচিলের দেশে সেই শীতের শিশির সিক্ত ঘাস-ফুলের বনে ধীরে ধীরে রাত গভীর হবে - নীরবতার প্রতিশব্দের প্রচ্ছায়ায় অবশেষে ঘনীভূত হবে একাকীত্ব আর বর্ধিষ্ণু খেয়ালগুলি রেখে যাবে অসংখ্য ইঙ্গিত।
আজ কত বছর ধরে নিঃসঙ্গ মনে খুঁজে ফিরি জ্যোৎস্নার সংলাপ আর কালের কলতানে হারিয়ে যাওয়া গানের স্বরলিপি, চতুর্দিকে স্মৃতির উর্বশী উঠানে বসে থাকে আমার বিচ্ছিন্ন স্বপ্নের নিঃসঙ্গ গোলাঘর - পরবাসে আমি একজন নিভৃতচারী ইন্দ্রজিৎ, যদিও এমনটি হবার কোন পরিকল্পনা ছিলনা।
সিডনি, ২৪শে এপ্রিল ২০১৮
|