কোথায় যায় প্রাণ? ড. শামস্ রহমান
(কাঁকনের স্মরণে)
যুদ্ধের শুরুতেই কাকাকে হারাই। এত কাছে থেকে মৃত্যু দেখিনি কখনো তখনও। শুনেছি প্রতিবেশীর মৃত্যুর কথা; কাগজে দেখেছি মৃত দেহ অসংখ্য। এসব মৃত্যু তখন মনে হতো শুধুই সংখ্যা।।
কাকার মৃত্যুই মৃত্যু সম্পর্কে প্রথম ভাবায়, অবিনশ্বরের এ অদ্ভুত বিস্ময় - ‘শান্ত-শুয়ে, মনে হয় অমৃত পানে গভীর ঘুমে; তবু বলে মৃত এ জনমে। দেহ আছে, নেই শুধুই প্রাণ; কোথায় যায় প্রাণ’? দিদা বলতো – ‘দেখিস, তপ আবার আসবে ফিরে’।।
কাঁকনের সাথে প্রথম পরিচয় সেই শ্যাম দেশে, উন্নিশ্য বেরাশির গ্রীষ্মের শেষে। চার-পাঁচ বছরের লাউয়ের ডগার গড়নে গভীর নয়নে সে এক মিষ্টি মেয়ে তখন। ‘মা, এটা সূর্য কাকা’- ওর বাবা বলে। সেটাই আমাদের প্রথম পরিচয়। আদরে আলতো করে নেড়ে দেই ওর মাথার চুল- ঘন, যেন অমাবস্যাচ্ছন্ন কোটি কোটি চুলের বাহার। কাঁকন তখন শুধুই কাহোই চড়ানো চুলের বাঁধন দুলিয়ে তাকিয়ে থাকে দূরে দিগন্তের ওপারে। ভেজা দৃষ্টি তার রয়ে যায় সবার অগোচর।।
তারপর? - পৃথিবী থেকে ঝড়ে পড়ে অনেকটা সময়; আজ তা এক চতুর্থাংশ শতাব্দীর বেশী বলে মনে হয়। হঠাৎ কাঁকনের সাথে আবার দেখা। ওর বাবা বলে – ‘এই কাকাকে চেন?’ ও বলেনি কিছুই। শুধুই তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিহীন দৃষ্টিতে - অভিব্যক্তিতে তার আমি তখন শুধুই সুদূর দেশের ভেলা-হারা ‘খুকুর সেই কাবলিওয়ালা’।। কাঁকনের অনেক কষ্ট তখন। ইচ্ছে করে আদর কোরে ওর মাথায় হাত বুলাতে; ভুলাতে এ জনমের কষ্ট যত! সূর্যরশ্মি থেকে নিয়ে শক্তি, সমুদ্র থেকে সাহস, বটের অদম্য মনোবল! তারপরও পারিনি বাড়াতে বাহু। ওর অসংখ্য চুল তখন শুধুই গুটি কয়েক সংখ্যা।।
কাকার মৃত্যু – সে এক নিদারুণ কষ্ট। তবে প্রকৃতির নিয়মেই ঝরে পড়ে পুরাতন। কিন্তু কাঁকন? ওরা যখন ছেড়ে যায় কাকাদের? রেখে যায় অবুঝ, রক্ত মাংসে গড়া অস্তিত্ব? বোঝার আগেই মধুময় এ প্রকৃতি-বিশ্ব; সে কষ্ট বেশি কষ্টকর।। শুরুতে – দেহ আর প্রাণ আসে একই সাথে। থাকে হয়ে বিশ্বাসী, একে অপরের পাশাপাশি। এভাবেই জনম জীবনের। শেষে- প্রাণ যায় চলে, নীরবে দেহকে পিছনে ফেলে। এভাবেই ছায়া ফেলে মৃত্যু।
দেহ থাকে প’ড়ে সবার গোচরে; দেখা যায়, ছোঁয়া যায় তারে; তবু থেকেও থাকেনা কিছুই। প্রাণ যায় চলে; যায় না ছোঁয়া, যায় না দেখা তারে; তবুও না থেকেও থাকে প্রাণ, প্রাণের গহীনে ঘুরে ফিরে বারে বারে। দেহ আর প্রাণের এ এক অদ্ভুত লুকোচুরি খেলা। এ খেলা চলছে এভাবেই, কাল থেকে কালে। তাই, কাঁকনের মা’ও কি দিদার মত বলে? – ‘দেখো, কাঁকন আবার আসবে ফিরে’।।
লিংচোপিং, সুইডেন, নভেম্বর ২০১৫ তে শুরু এবং সাংহাই, এপ্রিল ২০১৬ তে শেষ।
|