একটি জীনসের আত্মকাহিনী ড. শামস্ রহমান
দ্বিতীয় পর্বঃ জীনস্ নিয়ে ঘরে ছিনিমিনি
আগের অংশ
এক। পাকিস্তান আমলে দয়ালের কলেজের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিল সামরিক মন্ত্রণালয়। তখন লেঃ কর্নেল, উইং কমান্ডার আর ক্যাপ্টেনদেরই দাপট। তারাই সর্বেসর্বা। আর যারা কোর বিজনেস, মানে শিক্ষা প্রদানের দায়িত্বে ছিল, তারা নেহায়েত শিক্ষক। দাপট-দাররা শিক্ষকদের কখনো জুনিয়ার পার্টনার, কখনো বা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ভাবতো দ্বিধাহীন চিত্তে। স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানগুলি সামরিক মন্ত্রণালয়ের তত্বাবধানে থাকবে, না শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আসবে, তা নিয়ে নীতি নির্ধারকদের মাঝে জোর আলোচনা চলে। উপনিবেশিক চিন্তা-চেতনায় সৃষ্টি এই ধারণার ভিত্তিতে নীতি নির্ধারকদের অনেকে সুপারিশ করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তত্বাবধানে আনতে। অনেকে আবার স্ট্যাটাস-কুতে বিশ্বাসী ছিল। তবে তাদের প্রভাব ছিল অত্যন্ত সীমিত। কলেজের অনেক ছাত্ররাই ছিল স্ট্যাটাস-কু্র পক্ষে। সিদ্ধান্ত অন্যরকম হতে পারে ভেবে ছাত্ররাও লবিং করে এবং এক পর্যায়ে জেনারেল ওসমানীর শরণাপন্ন হয়। শেষ পর্যন্ত ছাত্ররাই জয়ী হয়। দয়ালের কলেজসহ অন্য কলেজগুলি সামরিক মন্ত্রণালয়ের তত্বাবধানেই থেকে যায়। তবে টানাপোড়ন চলে বেশ কিছু দিন। আর এই টানাপোড়নের মাঝে দারুণভাবে নাজুক হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানগুলির প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা। বিশেষ করে দয়ালের কলেজ। সেই সময় প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন কলেজের একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক। বিজ্ঞানের শিক্ষক হলেও, একবার প্রশিক্ষণের জন্য জার্মানিতে গিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর দার্শনিক যেমন, মার্ক্স, এঙ্গেলস, হেগেলের সমাজনীতি ও রাজনৈতিক রচনাবলী নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করেন। ব্যাপক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হওয়া সত্যেও তার পক্ষে সুষ্ঠুভাবে সবদিক পরিচালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। ছাত্র রাজনীতির অনুপ্রবেশ; ছাত্র প্রতিনিধি নিয়োগে ভোটা-ভোটি; সভা-সমাবেশ; মিটিং-মিছিল এবং যখন তখন বহিরাগতদের আগমন। এসব মিলিয়ে এক বিশৃঙ্খল পরিবেশ। এরই মাঝে উনিশশো-তেহাত্তর সনের শুরুতে আত্মপ্রকাশ করে এক নতুন দল। নাম কাঞ্চন পার্টি। দলের নেতারা কলেজের প্রিন্সিপালের ছেলের নামে নামকরণ করে এদলের। পর পর সাত সাতটি কন্যা সন্তানের পর জন্ম হয় এই পুত্র সন্তানের। প্রিন্সিপাল নাম রাখেন কাঞ্চন। এ যেন সাত ভাই চম্পার ঠিক উল্টো চিত্র; সাত বোন কাঞ্চন জাগো রে জাগো। বাবা আদর করে সুরেলা কণ্ঠে ডাকে কাঁন্ননচন। আর কাঞ্চন দৌড়ে চলে বাবার কোলে। এই ছিল অফিসে যাওয়া আর ফেরার সময়ের বাপ-ছেলের ছেলেমানুষি খেলা। দুই। আদর যতই থাক, হিসেবের বেলায় ছেলে-মেয়ে সমান। ছুটির দিনে কে কয়টা চকলেট পাবে; ঈদের নতুন জামা পাবে; জন্মদিনে উপহার পাবে, তা সব সমান-সমান। প্রিন্সিপালের মাথায় সমান-সমান ব্যাপারটি এত বেশী কাজ করে যে অনেক সময় সমান-সমান করতে গিয়ে ছেলেকেও কানের দুল আর হাতের চুড়ি উপহার দেয়। একবার বড় ঈদের উপহার হিসেবে সব মেয়েদের কপালের টিকলি দেয়। ছেলেকে আবার কেন আলাদা করে দেখা? ছেলেকেও তাই। তখনো প্রিন্সিপাল ও তার স্ত্রীর বোধোদয় হয়নি বুকিশ্ সমান-সমানের বাস্তবতা। কাঞ্চন পার্টির নেতারা প্রিন্সিপালের সমান-সমান ধারাটা আত্মস্থ করলেও তাদের কাছে প্রিন্সিপালের সমান-সমান প্রিন্সিপ্যলগুলি তত বেশী বৈজ্ঞানিক মনে হয়নি। তাই তারা দলের সমান-সমান আদর্শকে আরও বৈজ্ঞানিক করার জোড় প্রচার চালায়। কার্ল বেঁচে থাকলে কোন এঙ্গেল বা কোন কোন এঙ্গেলসএ দেখতো তা বলা কঠিন। তবে কাঞ্চন পার্টির নেতাদের সে ব্যাপারে কোন মাথা ব্যথা নেই। তারা বৈজ্ঞানিক সমান-সমানের ঝাণ্ডা উড়িয়েই চলে। এ ধারা সাধারণ ছাত্রদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে এবং তারা হাজারে হাজারে দলে ভিড়ে। যারা ভিড়ে, তারা কতটুকু বুঝে ভিড়ে, তা বোঝা না গেলেও, দলের উদ্দেশ্য কি ছিল তা অল্প সময়ের মধ্যেই পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলে দলে দলে উত্তেজনা ও দলাদলি বাড়ে এবং কলেজের পরিবেশে নেমে আসে চরম অবক্ষয়। তিন। সদ্য তৈরি জীনস্- মানে আমার জন্মের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দয়াল প্রিন্সিপালের অফিসে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পায়। মুক্তির খবর দ্রুত পৌঁছে যায় কলেজ এবং আশে পাশের গ্রামে। খবর পেয়ে আনন্দে কলেজ মুখরিত। সবার মুখে মুখে এই একই প্রশ্ন - কবে ফিরবে দয়াল? তখন জীনসের জন্য হিথ আর হিথ্রোর জয় জয়কার। দয়াল মুক্তি পেয়ে হিথ্রো-হিথ হয়ে সোজা চলে আসে কলেজে। আমাকে পেয়েই সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আমি যেন জীবনের ছবি। আমি যেন পূর্ব বাংলার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক। আমি যেন উনশত্তুরের রাহমানের রক্তাক্ত সার্ট থেকে রূপান্তরিত হয়েছি একাত্তরের দয়ালের রক্তাক্ত জীনস্এ। নবজাত কুন্টাকিন্টেকে হাতের মুঠোয় নিয়ে পাহাড়ের চুড়ায় দাঁড়িয়ে তার পিতা যেভাবে ঊর্ধ্ব আকাশের পানে তুলে ধরে; তেমনি, দয়াল আমাকে তুলে ধরে বিশ্ব দুয়ারে। কলেজের ছাত্রদের একতা ও মনের দৃঢ়তা, ত্যাগ আর নেতৃত্বের উৎকর্ষতার ফসল আমি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীনস্ না হলেও, আমি এক স্বতন্ত্র জীনস্। নিজের স্বকীয়তা নিয়ে এখন শুধুই সামনে চলার সময়। এখন শুধুই ভবিষ্যতের ভাবনা। নিশ্চয়ই আমার গায়ে একদিন প্লাস্টিকের বোতামের স্থলে সংযুক্ত হবে তামার বোতাম। নিশ্চয়ই একদিন হিমালয় থেকে ভেসে আসা পাথরের ঘষায় ঘষায় রূপান্তরিত হবো stone-washed জীনসে। একদিন নিশ্চয়ই পিছনের তালি পকেটের ঠিক উপরে এক অভিনব কায়দায় সংযুক্ত হবে নকশিকাঁথার নক্সায় এক টুকরো লেদার; আর যার গায়ে উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা হবে - Made in Bangladesh. চার। ইতিমধ্যে কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি। বাড়ি আসে দয়াল। পৃথিবীতে যে মাত্র তিনটি টাউন আছে তা হয়তো অনেকেই অজানা। জর্জ টাউন, কেপ টাউন ও গোলাপপুর টাউন। দয়াল গোলাপপুর টাউনের বাসিন্দা। ধলেশ্বরী নদী যেখানে বাঁ দিকে বেঁকে উত্তরে ধাবিত হয়েছে, ঠিক তার পুবের পাড় ঘেঁষে যে টাউন, তার নামই গোলাপপুর টাউন। বাড়ী পৌঁছাতে দয়ালকে প্রথমে কলেজ থেকে বাসে এবং শেষে যেতে হয় নৌকায়। যখন ধলেশ্বরীর উপর দিয়ে ব্রিজ হবে তখন হয়তো রেললাইন বসবে, বাস চলাচল করবে; তবে আজ নৌকাই একমাত্র ভরসা। বাড়ী আসার সময় দয়াল সঙ্গে করে সযত্নে সুটকেসের তলায় আমাকেও নিয়ে আসে। আমাকে পড়লে যে বাবা মা বোন ও আঁটনিয়-স্বজনরা সহজভাবে নিতে নাও পারে, সে চিন্তা যে দয়ালের ছিল না, তা নয়। এরা সবাই দয়ালের আপনজন। এদের আপত্তি উপেক্ষা করা সহজ নয়। তাই প্রথম প্রথম বেশ কিছুদিন আমি পড়ে ছিলাম দয়ালের সুটকেসের তলায়। তখন বঞ্চিত ছিলাম সূর্যের মুখ আর বিশুদ্ধ হাওয়া থেকে।
একদিন বিকেলে দয়াল এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভায় যাবে। সেখানে অনিক সহ যোগ দেবে আরও প্রায় তিনশ বন্ধু। আর এই সভাটি অনুষ্ঠিত হবে স্তোনিয়ার কানের কারুকাজে তৈরি বিশাল এবং অত্যাধুনিক এক ভবনে। চারদিকে যার বিস্তীর্ণ মাঠ, যা ঘন সবুজ আর মনোরম ঘাসে ঢাকা। সবুজের এক প্রান্ত থেকে ভবনের দোরগোড়ায় বেয়ে উঠেছে থাক থাক সিঁড়ি। মাঠের বুক চিড়ে আর ভবনের গা ঘেঁষে বহে আঁকা বাঁকা হ্রদ। শীতের বিকেলে হ্রদের জল স্নিগ্ধ হাওয়ার বেগে মৃদু মৃদু ঢেউ তুলে ভবনের হ্রদয় ছুঁয়ে যায়। পূর্ব বাংলার মাঠ ও মাটি, জল আর ভবনের এ যেন এক সহজাত মিলন। সভাটি আনুষ্ঠানিক। তাই অনেক চিন্তা ভাবনা করেই আমাকে মানে জীনস্ পড়ে। দয়ালের দীঘল দেহে মানায় ভালই। আর গায়ে জড়ায় মুজিব কোট। মুজিব কোটের সাথে পশ্চিমা কায়দার জীনস্! এ এক অভিনব সমন্বয়। আয়নায় আপাদমস্তক দেখে। এ পাশ ও পাশ করে নিজেকে পরীক্ষা করে। দয়ালের অঙ্গে তখন Clint Eastwood আর John Wayneএর ভাব ও ভঙ্গিমা। দেহের শিরায় শিরায় বিচিত্র এক অনুভূতি আর উত্তেজনা। Cowboyএর কায়দায় waterman কলম ঘুরায় তর্জনীতে। নিশানা ঠিক করে গুজে রাখে মুজিব কোটের হ্রদয় পকেটে। দয়ালের মাথায় তখন অন্তহীন কল্পনা। ভাবে, চারিদিকে যেন চোদ্দ নদীর অথৈ জল। পাশেই আদিবাসীদের বাস। অদূরেই ঘাপটি মেরে বসে আছে দূর্বিত্বের দল। সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়বে আদিবাসীদের গুহায় শত-সহস্র বছরের হিমালয় থেকে ভেসে আসা গচ্ছিত সম্পদের উপর। দয়াল যেন এদের উদ্ধারকর্তা। অবতীর্ণ হয়েছে clean Clint Eastwoodএর ভূমিকায়। বাসা থেকে বেড় হওয়ার জন্য দোতালা থেকে নীচে নামার সময় মায়ের নজরে পরে দয়াল। - বাবা, এ তুমি কি পরেছ? তালি দেওয়া পকেট, নীলের মাঝে লাল সূতার সেলাই, প্লাস্টিকের বোতাম! কেমন যেন বিশ্রি লাগছে। অন্য একটা প্যান্ট পরে যাও বাবা।
কোনটা ভাল, কোনটা মন্দ সে বিবেচনার দায়িত্ব সর্বদাই যেন মা বাবার; সমাজের তথাকথিত সিভিল শ্রেণীর! তাদের ভাবনাগুলো কেন যেন প্রজন্মের উপর চাপিয়ে দিতে চায়। দয়াল ভাবে নতুন প্রজন্মেরও যে থাকতে পারে নিজস্ব চিন্তা চেতনা, নতুন ভাবনা তা যেন বাবা-মা বা সিভিল শ্রেণীর চিন্তার বাইরে। সবই যেন হতে হবে সনাতনী, তাদের মত করে। দীর্ঘ দিন আগে কলেজ লাইব্রেরীতে পড়া খলিল গিবরানের কয়েকটি চরণ মনে পরে দয়ালের। চরণগুলি মনে ধরেছিল সেদিন, যা একজন মাকে উদ্দেশ্য করে লিখা - (Children) come through you but not from you, And they are with you yet they belong not to you. You may give them your love, but not your thoughts, For they have their own thoughts.
বাবা-মা ধনুকের মত। আর সন্তানেরা জীবন্ত তীর। মা-বাবার ভালবাসায় সন্তানেরা তীরের বেগে চেনা পথের বাইরে চলে নিজস্ব চিন্তা চেতনায়। পুরাতনকে পিছনে ফেলে, চলে তারা নতুনের সন্ধানে। বাহান্নের মিনার তার এক জীবন্ত সাক্ষর। কে শুনে কার কথা! দয়াল বলে মা, পৃথিবী বদলে গেছে। আজ এটাই মানানসই; এটাই সুন্দর। প্লিজ, আমাকে এখন যেতে দাও, বলেই যাবার চেষ্টা করে। মায়ের কথা শুনে দোতালা থেকে দৌড়ে আসে বড় বোন - তোকে একটা গুণ্ডা গুণ্ডা লাগছে। শিঘ্রি খুলে ফেল বলছি। বয়সে বড় বোন অনেক বড়। ছোটবেলা মায়ের পরই এই বোন ছোট্ট ভাইকে আদর দিয়ে আগলে রেখেছে। যদিও সে রুচি ও চিন্তাচেতনায় সনাতনী, তবু তাকে সরাসরি উপেক্ষা করা কঠিন। দয়ালদের বাড়ীর পাশে এক মস্ত বাড়ী। সে বাড়ীর ইন্দিরা মাসিমা এসেও যোগ দেয় মা বোনের সাথে। কালিয়াকৈর ও ধান-মন্দির সড়কে তাদের বড় বড় ব্যবসা। টাঙ্গাইল, মিরপুর কাতান, ঢাকাই জামদানী, বেনারসি, সাউথ ইন্ডিয়ান থেকে শুরু করে সবই মেলে সেখানে। নতুন নতুন ক্রেতা খোঁজ করা এবং ব্যবসা প্রসারের জন্য তাদের আছে গবিশা (গবেষণা ও বিশ্লেষণ শাখা) নামে এক গবেষণা সেল। যে কোন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মত গবিশাও কাজ করে গোপনে। গবিশার সাফল্যে মাসিমাদের ব্যবসাও জমজমাট। কাঞ্চন পার্টির গঠনের বেশ কয়েক বছর আগে, যুদ্ধের সময় এ দলের দুজন শীর্ষ নেতাদের সাথে গবিশার যোগাযোগ হয় এবং সেই থেকে তাদের সাথে একটা ওয়ার্কিং রিলেশনশিপ গড়ে উঠে। ইন্দিরা মাসিমা মা-বোনের সাথে শুধু যোগই দেয় না, কথাও বলে একই সুরে। বলে - দয়াল বাপ, অন্য একটা প্যান্ট পর তুমি। অন্য প্যান্টে তোমায় মানায় ভাল। দয়াল শুনেও না শুনার ভান করে। তাই নিরুত্তরে তাকিয়ে থাকে অন্য দিকে। মাসিমার ভয়টা অন্য জায়গায়। ঘরে তার দু দুটা বাড়ন্ত বয়সের ছেলে। যদি তাদের গায়ে লাগে দয়ালের বাতাস? যদি তারাও আমেরিকান cowboyদের মত জীনস্ পরা শুরু করে? উপায় হবে কি তবে?
পাঁচ। এদিকে কাঞ্চন পার্টি তাদের বৈজ্ঞানিক সমান-সমানের ঝাণ্ডা উড়িয়েই চলে। তারা জীনসের চেয়ে সমান-সমানের ঝাণ্ডায় বেশী বিশ্বাসী বলে প্রচার করে। ফলে কেউ বুঝে, কেউ বা না বুঝে এ দলে ভিড়ে। তারা সদলবলে কলেজে অন্য দলের সাথে লিপ্ত হয় সংঘর্ষে। স্বাধীনতার পর পর লুকিয়ে রাখা গলফ্ স্টিক ব্যাবহারেও পিছপা হয়নি তারা। ছাত্রদের রুম ভাঙ্গা, কলেজের দারোয়ান আর সিকিউরিটি গার্ডদের থেকে লাঠি-শোটা ছিনিয়ে নেওয়া এবং তা নিরীহ ছাত্র ও আশে পাশের গায়ের মাতব্বর শ্রেণীর মানুষের উপর ব্যবহার করা ছিল তাদের এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সব মিলিয়ে কলেজে অরাজকতা সৃষ্টিই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। চারিদিকে তখন ব্যাপক রব শিকদার-বাড়ীর শিকদার আর সিরাজগঞ্জের সিরাজ এখন একই কাতারে। এরা মিলে কলেজে ধ্বংস আর সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টির জোর প্রচেষ্টা চালায়। এক পর্যায়ে অরাজকতা রূপ নেয় মহা তাণ্ডবে যা কালিয়াকৈরের অদূরে অবস্থিত নক্সা-বাড়ীর তাণ্ডবকে হার মানায়। এমনকি কাঞ্চন পার্টি একবার ইন্দিরা মাসিমাদের ধান-মন্দির সড়কের ব্যবসা কেন্দ্রেও আঘাত হানে। গবিশার সাথে সুসম্পর্ক থাকা সত্যেও তারা কেন এমন কাজ করে, তা যোগবিয়োগে মেলে না। পরবর্তীতে শিকদার, সিরাজদের কৌশল নিয়ে এগিয়ে আসে হাতে গোনা কিছু সংখ্যক ছাত্র যারা মাক্ষন জীনস্ ছিনিয়ে নিয়ে দয়ালের জীনস্ তৈরির শুরুতেই বিরোধিতা করে। তাত্ত্বিকভাবে মা, বোন আর মাসি; কাঞ্চন পার্টি এবং জীনস্ তৈরির বিরোধিতাকারীরা ভিন্ন ভিন্ন আদর্শে আর মূল্যবোধে বিশ্বাসী হলেও, একটা জায়গায় তাদের ছিল গভীর মিল। তারা সবাই দয়ালের জীনসে্ অবিশ্বাসী। একদিকে দয়াল, অনিক - অন্যদিকে মা, বোন, মাসি; কাঞ্চন পার্টি, এবং জীনস্ তৈরির বিরোধিতাকারীরা। দয়ালের জীনস্(মানে আমাকে) নিয়ে চলে তুমুল টানাটানি। শেষে দয়ালের হ্যাচকা টানে ফসকে যায় অবিশ্বাসীদের হাত। যদিও দয়াল তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে, কিন্তু এই টানাটানিতে জীনসে্র কোটি কোটি সুতার শক্ত বাঁধনে আঘাত লাগে এবং কিছুটা শিথিল হয়ে পড়ে। সামনের দু একটি প্লাস্টিক বোতাম সেলাই করা সূতা থেকে ঝুলে পড়ে আর লাল হলুদের মাঝা মাঝি রং এর সূতায়, ডবল স্টিচে পিছনের তালি আটা এঁটে থাকা বা পকেটটি প্রায় খসে পড়ে পড়ে। তখন গাড় নীলের জীনস্টা মানে আমাকে কেমন যেন আত্মবিশ্বাসহীন ফ্যাকাসে দেখায়। (চলবে)
আগের অংশ
ড. শামস্ রহমান, মেলবোর্ন
|