একটি জীনসের আত্মকাহিনী ড. শামস্ রহমান
পর্ব একঃ জীনসে্র জন্ম কথা
পরের অংশ
১। সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ। যুদ্ধের ক্ষত তখনো স্পষ্ট। নিঃশ্বাসে তখনো গোলাবারুদের গন্ধ। জনপথ প্রায় বিচ্ছিন্ন। এর মাঝেই দূর দূরান্ত থেকে মানুষ ছুটছে আপনজনের কাছে। অস্ত্র কাঁধে মুক্তিযোদ্ধারা ফিরছে বাড়ি। চারিদিকে সবুজের মাঝে লাল সূর্য খোঁচা পতাকা হাতে বিজয়ের ধ্বনিতে মানুষের উল্লাস। জয় বাংলা আর আমার সোনার বাংলা কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠে।
নতুন দেশ। নতুন সরকার দায়িত্বে। ধ্বংসাবশেষ থেকে দেশকে গড়ে তোলার জোর প্রচেষ্টা তখন। স্কুল, কলেজ খুলেছে ইতিমধ্যে। এবার আবার অনেকের মত দয়ালেরও স্কুলে যাবার পালা। দয়ালের স্কুল এক বিশেষ ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটা একদিকে যেমন স্কুল, অন্যদিকে কলেজ। তবে প্রতিষ্ঠানটি শুধুই কলেজ নামে পরিচিত। স্কুলে পড়েও কলেজে পড়ে, এটা ভাবতেই ভিন্ন এক অনুভূতিতে ভরে উঠতো দয়ালের মন-প্রাণ। এক ধরণের নস্টালজিয়া চেপে বসতো বাহ্, আমি তো বেশ বড়! কেউ জিজ্ঞেস করলে একটু পাকামোর ভাব ধরে জোরের সাথেই বলতো আমি কলেজে পড়ি। দেশে তখন এ ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল মোট চারটি । গ্রামের মাঝে বিস্তীর্ণ এক সমতল জমির উপর দয়ালের কলেজ। চারিদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। ভিতরে অসংখ্য কাঁঠালের গাছ; খেলার মাঠ এবং বিভিন্ন অবকাঠামো দিয়ে ভরা। বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায়ই নেই, কি আছে ভিতরে! আর কিই বা হয় সেখানে! বাইরের মানুষের ভিতরে ঢোকা যেমন মানা, তেমনি ভিতরের ছাত্রদেরও বাইরে যাওয়া নিষেধ। কলেজের ব্যবস্থাপনা নিয়মতান্ত্রিক এবং ভীষণ কড়া। সময়মত খাওয়া-পড়া আর সকাল বিকাল বাম-ডান করা। বাম-ডান করে করে, এক সময় বাম-ডানের ব্যাপারটা একটা যান্ত্রিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ঘন ঘন বাম-ডানে দয়াল টোটালি কনফিউসড্। বিশেষ করে যখন বলে বামে কিংবা ডানে, তবে চলে লক্ষ-হীন সামনে। আর যদি কখনো লক্ষ নিবিষ্ট করে, তাহলে আইস্-রাইট বলে দৃষ্টি মেলে ডানে। ২। যুদ্ধের ঠিক আগে আগে। মার্চ মাসের শুরু তখন। দেশ নিয়ে মানুষের মনে নানা ভাবনা। পার্লামেন্টের অধিবেশন বসবে কি? কি হবে? কোন দিকে যাবে? নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে কি ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে শেষ পর্যন্ত? ঘরে বাইরে তখন এসবই আলোচনার প্রধান বিষয়। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ না থাকলেও, ক্লাস বন্ধ। অফিস-আদালত চলছিল, তবে ঢিলেঢালা ভাবে। শহরে শহরে মিটিং মিছিল। জয় বাংলা আর আমার সোনার বাংলা মিছিলে মিছিলে। শ্লোগান আর গানই হয়ে উঠে বিজয়ের শক্তি আর দেশাত্মবোধের প্রেরণা। তখন, যখন-তখন অনিকের কলেজে ঢুকে যেত বাইরের কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের মিছিল। শ্লোগানে ভারি হয়ে উঠতো চারিদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা কলেজের বাতাস। কলেজের প্রশাসক বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থেকেছে, যা অনিককে অবাক করতো। এও সম্ভব? কোথায় গেল কলেজের সেই কড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা? দেশের ঠিক এই রকম এক পরিস্থিতির মাঝে দয়াল, অনিক সহ আরও বেশ কয়েকজন বন্ধু এক বিকেলে গল্পে মশগুল। হঠাৎ দয়াল বলেঃ - এখনই মোক্ষম সময়। কলেজের অডিটরিয়ামের স্টেজের পিছনে দেয়ালে ঝুলানো কাপড়টা নিয়ে নিলে কেমন হয়? দয়াল নামটা দেয়া হয় সেই ঐতিহাসিক ছাত্র আন্দোলনের সময়। কোন না কোন ভাবে কাউকে সাহায্য করতেই হবে তাকে। না পারলে ওর পেটের ভাত যেন হজমই হয় না। তাই সবাই মিলে নাম দেয় দয়ালু। তা থেকে দয়াল। - অনেকটা আশ্চর্যের স্বরেই অন্য এক বন্ধু জিজ্ঞাস করে - নিয়ে নেব মানে? - হ্যাঁ, নিয়ে নেব! উত্তরে দৃঢ়তার সাথেই দয়াল বলে। ও অনেকটা এই ধরনেরই। ভেবে চিন্তে যা সিদ্ধান্ত নেয় তা করেই ছাড়ে। নেতৃত্ব প্রদানে এক কাঠি সরস। - মাঝখান থেকে আর এক বন্ধু মন্তব্য করে দৌর্ঘে-প্রস্থে এত বড় কাপড় নিয়ে নেওয়া কি চাট্টিখানি কথা! - অনিক বলেঃ ধরা পরলে কি হবে আমাদের? - অনিকের সাথে স্বায় দেয় আরও দুএক জন - তাইতো, দোস্ত, ধরা পরলে কি হবে?
এ সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না দয়াল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে, হঠাৎ বলেঃ চল! এক্ষণই চল। নিজেদের দখলে নিয়ে নেব।
বলেই সে উঠে দাঁড়ায়। তার সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায় আরও কয়েকজন। সেই মূহুর্তে অনিক কি করবে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। ভয় ও দুর্বলতা, সতর্কতা ও তথাকথিত নৈতিকতা সবই কাজ করে তার মধ্যে। একদিকে ভয় ও নৈতিকতার প্রশ্ন; অন্যদিকে বন্ধুদের অলিখিত দলীয় চাপ কিংবা তাদের সাথে সলিডারিটি। কোনটা ওজনে ভারী? সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়ের জানালাও খুব প্রশস্থ নয়। এটাও সত্য, সমদূরত্ব বজায় রাখার সময় এটা নয়। যাবে কি যাবে না, সেটাই প্রশ্ন! যাওয়ার সিদ্ধান্তে ঝুঁকি আছে সত্য, তবে এর উপর নির্ভর করছে জীবনের অনেক কিছু। শেষে বন্ধুদের সাথে সলিডারিটির মাঝে লক্ষ অর্জনই উত্তীর্ণ করে ভয়, সতর্কতা ও তথাকথিত নৈতিকতাকে। অনিক নীরবে যোগ দেয় অন্য বন্ধুদের সাথে। আড্ডার জায়গা থেকে অডিটরিয়াম বেশি দূরে নয়। মূহুর্তেই সবাই পৌঁছে যায় অডিটরিয়ামের দোরগোড়ায়। বিশাল আকৃতির অডিটরিয়ামকে তখন কেমন যেন ভাবলেশহীন দেখায়। ছাত্র শিক্ষক শূন্য শত শত চেয়ারগুলোই শুধু লাইন ধরে সাজানো। দেয়ালের বিমূর্ত নক্সাগুলি দয়ালের কাছে সেই সময় আরও বিমূর্ত হয়ে উঠে। এক সময় নক্সাগুলির মাঝে একধরণের মানে খুঁজে পেলেও আজ ওর কাছে শুধুই অর্থহীন আঁকা-ঝোঁকা। শত শত সৌর জগতের মাঝে একটি চাঁদ তারা যেন অতিশয় ক্ষুদ্র ও তাৎপর্য হীন। দয়াল আজ মিল্কিওয়েতে ভেসে মিলে যেতে চায় শত শত সূর্যের সাথে। আর স্টেজের দুপাশে দাঁড়ানো সাদা ও সবুজ রঙ্গের সাইড-উইংস গুলি? কতদিন দয়াল শেক্সপিয়ার আর সমারসেট মমের নাটকের ডায়লগ প্রমট্ করেছে এই সাইড-উইংসের ছায়ায় দাঁড়িয়ে। এদের উপর পূর্ণ আস্থা রেখেছে। ভরসা করেছে। অবশ্য, উনিশশো পয়সট্টির সেপ্টেম্বরের সাতদিনের নাট্য উৎসব সব উলট-পালট করে দেয়। উৎসবে দয়ালদের ক্লাস মঞ্চস্থ করে লিও টলস্টয়ের War and Peace থেকে বিশেষ কয়েকটি অংশ। যথারীতি ডায়লগ প্রমট্ এর দায়িত্ব পড়ে দয়ালের উপর। তবে, নাটক শেষে অনেকে বলে, প্রমট্ করার সময় নাকি দয়ালকে অডিটোরিয়ামের দর্শকরা সাইড-উইংসের ভিতর দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পায় এবং প্রায়ই তার প্রমট্ করা ডায়লগও শোনা যায়। শুনে, দয়ালতো হতভম্ব। বলিস কি রে! তবে তো উইংসগুলি আমাদের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। মনে হচ্ছে, আমাদের নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টাও করেনি। এদের উপর আমাদের আস্থা ছিল। অনেক ভরসা ছিল। ভেবেছিলাম, এদের ছায়ায় দাঁড়ালে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। নির্ভাবনায় যাওয়া যাবে সামনে। দেখছি সে ধারণা ভুল। ভাগ্যিস, যুদ্ধটা সীমাবদ্ধ ছিল মূলতঃ পশ্চিম ফ্রন্টে। তবে, শান্তির জন্য দৌড়াতে হয় পূর্ব ফ্রন্ট তাস্খন্দ পর্যন্ত। আজ অবশ্য ভিন্ন কথা। সাইড-উইংসগুলি এখনো যদিও দাঁড়িয়ে, তবে অনেকটাই নিস্তেজ। অন্যকে নিরাপত্তা দেওয়া দূরের কথা, নিজের অস্তিত্ব নিয়েই আজ টানাটানি; সারশূন্য দ্বিজাতীয় তত্বের অস্তিত্বই বিলীন হওয়ার পথে। ৩। চারিদিক নিস্তব্ধ। আমাদের মধ্যে দয়ালই ছিল খানিকটা লম্বা এবং মাসেলধারী। তাই ওই দায়িত্ব নিল সবার নীচে থাকবার। অনিক হ্যংলা পাতলা বলে, ওকে বলা হলো সবার ওপরে যাবার। এভাবেই একজনের কাঁধে অন্যজন ভর করে স্টেজের পেছন দেয়াল ঘেঁসে ঝুলানো বিশাল থান কাপড়টি টেনে নামায়। গাড় নীল, মোটা এবং একটু ঘস্ঘসে এ কাপড়ের নাম মাক্ষন জীনস্। পাট আর তুলার সংমিশ্রণে তৈরি সূতায় পশ্চিম পাকিস্তানের কারখানায় এ কাপড় তৈরি। সময়ে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় এই কারখানায়। তৈরি হয় পাট-তুলা ও বস্ত্র আনা-নেওয়ার জন্য নতুন নতুন রাস্তাঘাট আর বন্দর। তৈরি হয় কর্মচারী ও তাদের পরিবারদের থাকার ব্যবস্থা। সেই সাথে ছেলেমেয়েদের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে, বিশ্ব বাজার না পেলেও, ইতিমধ্যে পূর্ব বাংলা হয়ে উঠে মাক্ষন জীনস্এর এক মস্তবড় বাজার। যেহেতু অনিকের ছাত্রাবাস ছিল অডিটোরিয়ামের সবচেয়ে কাছে, তাই সিদ্ধান্ত হলো মাক্ষন জীনসের অংশটুকু অনিকের কাছেই থাকবে। এত বড় কাপড় দুএক জনের পক্ষে বয়ে নেওয়া ছিল অত্যন্ত কঠিন ও জটিল ব্যাপার। তাই সবাই মিলে সর্ব উচ্চ গোপনীয়তার সাথে ধরাধরি করে নিয়ে যায় অনিকের কামরায়। এত সতর্কতার পরেও নেওয়ার সময় সিকিউরিটি গার্ড যে দেখে ফ্যালে তা ওরা টেরই পায়নি। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জানাজানি হয়ে যায় মাক্ষন জীনস্ ছিনিয়ে নেওয়ার খবর। ছাত্রাবাস ও ডাইনিং হলে হৈ হৈ রৈ রৈ পরে যায়। কেউ বলে দয়াল, অনিক ও অন্যরা জড়িত। কেউ বলে ওরা রাতের অন্ধকারে কলেজ থেকে প্রাচীর ডিংগিয়ে পালিয়ে গ্যাছে। কেউ কেউ আবার শঙ্কিত, ওদের কি হবে? তা ভেবে।
বাকি সবাই বেঁচে গেলেও, দয়াল ফেঁসে যায়। সন্ধ্যারাতেই সিকিউরিটি গার্ড দিয়ে প্রিন্সিপ্যাল দয়ালকে ডেকে পাঠায়। দয়াল অফিসে পৌঁছালে প্রিন্সিপ্যাল মারমুখো ভাব দেখায়। বলে শুনলাম, কলেজের কাঁঠালতলায় বসে আড্ডা দাও আর ষড়যন্ত্র পাকাও? আর কারা কারা ছিল সেখানে? মারমুখো ভাব দেখালেও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তেমন কিছু করতে সাহস করেনি। কিছুক্ষণ আটকে রাখে অফিসে। তারপর ছেড়ে দেয়। ছেড়ে দেওয়ার সময়, সাময়িকের জন্য হলেও মাক্ষন জীনসের অংশটুকু ফেরত দিলে খুশী হব, এই ধরনের একটা মন্তব্য করেন প্রিন্সিপ্যাল। দয়ালের মনে পরে কলেজে আসার প্রথম বছরের কথা। অডিটোরিয়ামের এই স্টেজেই এক সময় ইংরেজি শিক্ষক টিম ওয়েবস্টানের পরিচালনায় আর ছাত্রদের অভিনয়ে প্রদর্শিত হয়েছে শেক্সপেয়ারের নাটক। দেখানো হয়েছে ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে নিয়ে আসা ৮-মিলি মিটারে Charles Dickensএর সিনেমা Great Expectations। পরিবেশিত হয়েছে আলমগীরের কণ্ঠে Cliff Richardএর গান Summer holiday, Bachelor boy, কিংবা Falling in love with you । তখন নাটক, সিনেমা, গান, সেই সাথে চিন্তা-চেতনায় বেশ একটা বিলেতি বিলেতি ভাব ছিল। সময়ে সব বদলে গ্যাছে। পূর্ব বাংলায় মাক্ষন জীনসে্র বাজার যত বেড়েছে, এই স্টেজের সুর ও ভাষা তত বদলে গ্যাছে। এখন গানের সুর ও ভাষা ভিন্ন। কারার ঐ লৌহ কপাট আর এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে
. দিয়েই আজকের ছাত্রদের Rock & Roll। ৪। নাম যেহেতু মাক্ষন জীনস্, আর দেখতে নীল, মোটা এবং কিছুটা খসখসে; চল, কাপড়টা দিয়ে আমরা জীনস্ বানাই দয়াল প্রস্তাব করে। সবার যে তখন জীনস্ সম্পর্কে সঠিক ধারণা ছিল, ঠিক তা নয়। তবে, এই প্রথমবারের মত নিজে কিছু তৈরি করার মধ্যে যে সুখ সুখ গন্ধ এবং আনন্দ তাতেই সবাই উত্তেজিত। তখন কোন বাধাই বাধা নয়। তখন কোন সীমাবদ্ধতাই সীমাবদ্ধতা নয়। তখন এমন একটা সময় যখন মনের জোড়ে যে কোন বাধা ও অসমর্থকে উৎরানো সম্ভব।
প্রস্তাবে সবাই রাজি হয়ে যায়। সক্রিয় সহযোগিতা আর টিম সলিডারিটির এ এক চূড়ান্ত রূপ। কলেজের পঁচিশ বছরের ইতিহাসে এমনটি ঘটেনি কখনো। এটা নেতৃত্বের উৎকর্ষতার সাক্ষর। সিদ্ধান্ত হল, আমেরিকার cowboy স্টাইলে জীনস্ বানানোর। কলেজের প্রাচীরের বাইরে কালিয়াকুর বাজারে চার চারটি খলিফার দোকান। কালিয়াকুর ঢাকা থেকে বেশি দূরেও নয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ। এটা একটি বন্দর নগরী। দেশ বিদেশ থেকে বাণিজ্যের নৌকা ভিড়তো দিন-রাত। বাণিজ্য হত। অবশ্য, আজ আর নেই তার সে জৌলুস। তবে এখনও বস্ত্র শিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। পরদিন গোপনে সবাই মিলে যায় খলিফাদের দোকানে। প্যান্টের ডিজাইন কেমন হবে এবং কেন হবে, তা খলিফাদের বোঝানোই ছিল এক ধরণের চ্যালেঞ্জ। তারা অতীতে অনেককিছু বানালেও জীনস্ কখনো বানায়নি। দীর্ঘদিন আমেরিকায় বসবাসরত মামাতো ভাই শহিদ হোসেনের বদৌলতে আমেরিকান জীনস্ সম্পর্কে দয়ালের মোটামুটি একটা ধারণা ছিল বিধায় দায়িত্বটা ওর উপর বর্তায়। গোপনীয়তা আর সতর্কতা রক্ষার্থে প্রথম প্রথম দয়াল একাই খলিফাদের দোকানে যায়। প্যান্টের ডিজাইন বুঝিয়ে আবার ফিরে আসে কলেজে। এভাবে দফায়-দফায় ছয় দফা কলেজ আর কালিয়াকুর করার পর, একদিন সিকিউরিটি গার্ডের নজরে পরে। পরদিন নাস্তার ঠিক আগে আগে প্রিন্সিপ্যালের অফিসে দয়ালের ডাক পরে। হাজির হতে না হতেই প্রিন্সিপ্যাল গর্জে উঠে তোমাকে বললাম মাক্ষন জীনস্টা আপাতত ফেরত দাও, পরে আমি দেখবো তোমার জন্য আমি কি করতে পারি। এখন শুনছি তুমি আমার কলেজের ঐতিহ্যবাহী মাক্ষন জীনস্ দিয়ে জীনস্ বানাচ্ছো কলেজের সীমানার বাইরের খলিফাদের দিয়ে? এসব কি সত্য? যদিও প্রশ্ন করে, তবে প্রিন্সিপ্যাল দয়ালের উত্তরের অপেক্ষা করে না। কি হচ্ছে, প্রিন্সিপ্যাল তো তার সবই জানা। সিকিউরিটি গার্ডকে ইশারায় বলে পাশের ঘরে আটকে রাখতে। আর বলে আপাতত নো খানা পিনা। কত গমে কত রুটি হয়, আর কোথায় হয় তার ঠিকানা টের পাবে ব্যাটা শিঘ্রি। শুধু অনিয়মিত খাওয়া-দাওয়াই নয়, লেখা পড়া ছিল একদম বন্ধ। বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ ছিল সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। দয়ালের অবর্তমানে জীনসের কাজ চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পরে অনিকের উপর। অনিক কালিয়াকুর যায়। যাবার পথে আশ্রয় নেয় কোন এক আম্রকুঞ্জে। খবর পেয়ে বাকি বন্ধুরাও ছুটে আসে আম্রকুঞ্জে। এতদিন জীনসের কাজ গোপনে হলেও, আজই প্রথম এই আম্রকুঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে অনিক জানিয়ে দেয় জীনস্ তৈরির ব্যাপারটা। তারপর কালিয়াকুর পৌঁছায়। খুঁজে পায় খলিফাদের। নিরাপত্তা আর জীনস্ তৈরির সুষ্ঠু তদারকির জন্য সে তখন থেকে কালিয়াকুরেই থেকে যায়। প্রত্যেক দিন খলিফাদের সাথে দয়াল কি কি নির্দেশ দিয়েছে তা নিয়ে আলোচনা হয়। লক্ষ ঠিক রেখে অনিক খলিফাদের বুঝায় এবং আজ তালি পকেট, কাল
এভাবেই ধীরে ধীরে জীনস্ তৈরির কাজ এগুতে থাকে। একটানা নয় দিন নয় রাতের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল এই জীনস্। পেছনে দুই তালি পকেট, সামনে গোল পকেট, আর এক পকেটে ছোট্ট ইনার পকেট। সেই সাথে নীচে চাপা এবং বুট কাট্। লাল হলুদের মাঝা মাঝি রং এর সূতায়, ডবল স্টিচে তৈরি হল জীনস্। মানে আমি আমার জন্ম হল। লোহার যীপার পাওয়া গেলেও, তামার বোতাম যোগার করতে পারেনি রহমতুল্লাহ খলিফা। কাজ চালাতে হয়েছে হলুদ রঙের প্লাস্টিক বোতাম দিয়ে। আমি Levis, Wrangler কিংবা Lee Cooperএর মত খ্যাতি সম্পন্ন নই; শুধুই জীনস্ - Made in Bangladesh. (চলবে)
ড. শামস্ রহমান, মেলবোর্ন
|