‘অনেকতো হলো, এবার ফেরা তরী’ আল নোমান শামীম
ভোর হয়ে আসছে প্রায়, বাইরে কাউন্সিলের পরিষ্কার কর্মীরা নিষ্ঠার সাথে কাজ করছে, যেন আগামীকাল সবকিছু ঝকঝকে থাকে। নাগরিক সুবিধার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ছাড় নেই এদের। নিভৃতে বসে খানিকটা নীরবেই ভাবছিলাম, দেড়যুগ পেরিয়ে যাচ্ছে প্রবাসী জীবনের, কত দ্রুত কেটে যাচ্ছে জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত সময়। তৃতীয় বিশ্বের মানুষ হবার কারণে কত কিছুইনা করতে হয় আমাদের। পরিবার, দেশ, চেনা শহর, প্রিয় মুখগুলো ছেড়ে পাড়ি দিতে হয় অচেনা পড়শির দেশে।
‘ভবিষ্যৎ’ সে একটা বেশ মজার ব্যাপার। নিরাপত্তা, শিক্ষা, ভালো থাকার সোনার বাটি, বাড়ি-গাড়ি-আরো অনেক কিছুই ‘ভবিষ্যতে’র জাদুর বাক্সে ভরে নিয়ে ছুট দেই আমরা। প্রাচ্য, মধ্যপ্রাচ্য, পাশ্চাত্য, যেখানে বাঙালিরা গড়ে তুলছে দ্বিতীয় ভুবন। নাড়ী ছেঁড়া বাঙালি রাখী বাঁধে দূরের দেশে। সম্পর্কের উনুনে জ্বলতে জ্বলতে বার্ধক্য চলে আসে, নাড়ীর টানে বাঙালির আর দেশে ফেরা হয়ে উঠে না। বাবা বলতেন, পৃথিবীতে অভয়ারণ্য বলে কিছু নেই। এতটা পথ হেঁটে এসে বুঝি, মধ্যবিত্ত সংগ্রামী বাবা অনেক আগেই জীবনের পাঠশালায় উচ্চতর ডিগ্রী নিয়ে ফেলেছিলেন। নিজ দেশে নিজ সময়ে বেঁচে থাকার মহত্ত্বে বাবা এখন প্রায়ই বলেন, ‘অনেকতো হলো, এবার ফেরা তরী’। সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে উচ্চে তুলে ধরে প্রতিজ্ঞা করেছি, তোকে সেভাবেই মানুষ হতে হবে। প্রবাসী জীবনের যান্ত্রিকতার কথা বুঝি না, এতটুকু জানি, এখানে আঙ্গুলের ফাঁক দিয়েই বেড়িয়ে যাচ্ছে মহামূল্যবান সময়।
কপালে ভাঁজ ফেলা উদ্বিগ্ন বাবা আর মায়ের হাত ধরে কম্পমান এই মেট্রিক পরীক্ষার্থীর সেগুন বাগিচা উচ্চ বিদ্যালয়টিকে মনে হয়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার, পান থেকে চুন খসা যাবে না। আর এইতো সেদিনের কথা, ওলংগং বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ পরীক্ষা দিলাম, লেখাপড়ার পাট চুকালাম। প্রবাসে এতোগুলো বছরে কতো পরিচিত-অপরিচিত মুখ, সিডনীতে আন্তর্জাতিক ছাত্রদের সংগ্রামগুলো এতো কাছে থেকে দেখা যে, জীবনকে কেমন গল্পের মতো মনে হয়। সাধ্য আর সাধনার দ্বিতীয় ভুবনেই কোলাহল মুখর বাঙালির প্রতিষ্ঠার গল্প, নিজেদের সংগঠিত করে অস্ট্রেলিয়ার মূল স্রোতে মেশার গল্প। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বিবর্তনের গল্পগুলো রচিত হচ্ছে।
আশা, আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, খেদ, সমৃদ্ধি, ব্যর্থতা, জয় আর অবিরত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে একটি অহংকারী জাতি কিভাবে নিজের আত্মিক পরিচয়ে বিদেশ বিভুয়ে বেড়ে উঠে সেটিকে খুব কাছ থেকে দেখা একজন মানুষের জীবনের পরম পাওয়া বটে। সেই সব মানুষ আর তাদের জীবন সংগ্রামের কথা বলতে পারাটি হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।
|