তবুও শিশুদের জন্য বাংলা বই কিনুন ড. শাখাওয়াৎ নয়ন
ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে প্রথম ঢাকায় গিয়েছি। বেইলী রোডের একটি বইয়ের দোকানের নাম দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। দোকানটির নাম "তবুও বই পড়ুন"। কী দারুণ নাম! কোনো বইয়ের দোকানের নাম এত সুন্দর হতে পারে! আমার ভাবনার মধ্যেই ছিল না। তখনো মাদারীপুরের নেছারিয়া লাইব্রেরী, সরদার লাইব্রেরীর নাম মাথায় নিয়ে ঘোরাফেরা করি। আর এত সুন্দর নাম দেখে মুগ্ধ না হয়ে পারি? এখনো সেই মুগ্ধতা কাটেনি, কাটবেও না কোনো দিন। অনেকদিন পরে জানতে পেরেছি উক্ত বইয়ের দোকানটি প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের চরমপত্র-খ্যাত শব্দ সৈনিক, লেখক এম আর আখতার মুকুল। আজ অনেক বছর পর সিডনি একুশে বইমেলা এবং ‘ইকরিমিকরি বুক স্টুডিও’ নিয়ে লিখতে বসে, সেই বইয়ের দোকানের নামটি আবার মনে পড়লো।
যাই হোক, আমার লেখার শিরোনাম "তবুও শিশুদের জন্য বাংলা বই কিনুন"। কারণ অনেক। আপনার কি মনে হয় না? বাংলা ভাষায় শিশুদের জন্য লেখা বইয়ের সংখ্যা নগণ্য এবং মান-সম্মত বইয়ের অভাব প্রকট। আমার কিন্তু এটাই মনে হয়। একটু ব্যাখ্যা করে যদি বলি, তাহলে বলতে হয়- সেই যে কবেকার ঠাকুরমার ঝুলি, কিংবা সুকুমার রায়ের লেখা দারুণ দারুণ ছড়া, সীতানাথ বসাকের আদর্শলিপি, যতীন্দ্র মোহন বাগচী’র কাজলা দিদি কিংবা রোকুনুজ্জামান খান দাদা ভাই এর খেলাঘর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তারপর? তার আর পর নাই। বাংলাদেশে প্রতি বছর একুশে বইমেলায় ৩/৪ হাজার নতুন বই প্রকাশিত হয়। যার অধিকাংশই বড়দের জন্য কবিতা, উপন্যাস এবং গল্প। এ ছাড়া রাজনৈতিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ। এসবের বাইরে কিশোরদের জন্য মুহম্মদ জাফর ইকবাল নিরলস ভাবে লিখছেন এবং দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তাঁর সফলতা দেখে অনেক প্রকাশক এবং তরুণ লেখকও এখন কিশোরদের জন্য বই লিখছেন এবং প্রকাশ করছেন। বলতে গেলে জাফর ইকবাল যদি কিশোরদের জন্য না লিখতেন, তাহলে আমাদের কিশোরদের জন্যও তেমন কোনো বই পাওয়া যেত না। জাফর ইকবালের আগমনের পূর্বে বাংলা সাহিত্যে কিশোর উপন্যাস ছিল মামা-চাচা কেন্দ্রিক হিরো চরিত্র প্রধান। এখন সেই বেহাল দশা কেটেছে, মামা-চাচার কাছ থেকে সায়েন্স ফিকশনের দিকে যাত্রা করেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে শিশুদের জন্য (যাদের বয়স ১০ বছরের নিচে) কে বা কারা লিখেন? আপনি দুই/চারজন লেখকের নাম বলতে পারবেন? আমি নিশ্চিত, এটা খুব সহজ হবে না। কারণ আমাদের দেশে শিশুদের জন্য কবি-লেখকরা তেমন করে ভাবেন নাই, লিখেন নাই। তাই আমরা এখন কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না, কারো নাম মনে করতে পারছি না। এটা খুবই দুঃখজনক একটি পর্যবেক্ষণ।
এমতাবস্থায়, বছর দুয়েক আগে আমরা একদল বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম, শিশুদের জন্য বই প্রকাশ করবো, বই লিখবো। ২০১৬ সালে ঢাকার একুশে বইমেলায় "ইকরিমিকরি বুক স্টুডিও" নামক একটি প্রকাশনা নিয়ে বইমেলায় হাজির হলাম। ছোট বড় সকলের কাছ থেকে অভূতপূর্ব সাড়া পেলাম, বাড়তি পাওনা এলো বিভিন্ন এনজিওদের কাছ থেকে। বাংলাদেশে অনেক এনজিও আছে যারা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করে, স্কুল চালায়। তারা আমাদের বই কিনতে এলো। আমাদের আকাশে সফলতার নতুন নতুন তারকা উদিত হতে লাগলো, এখনো হচ্ছে।
আপনি নিশ্চয়ই বাংলাদেশে রেলস্টেশনে, বাসস্টান্ডে হকারদেরকে বই বিক্রি করতে দেখেছেন, তাই না? তারা শিশুদের বই বিক্রি করে। সেই বইগুলি কেমন? শুধুমাত্র কতগুলি মাছ, ফল, ফুলের ছবি, তাই না? সেখানে কি কোনো গল্প আছে? না, নেই। অথচ আমরা যারা বিদেশে থাকি, তারা তো জানি এসব দেশে শিশুদের জন্য কত সুন্দর সুন্দর ছবিওয়ালা গল্পের বই থাকে। যাকে বলা হয়, "বেড টাইম স্টোরিজ"। আমাদের দেশে এরকম বই নেই কেন? আগে তো ছিল। তাই আমরা শিশুদের নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম।
আপনার মনে প্রশ্ন আসতে পারে, "ইকরিমিকরি বুক স্টুডিও" নামটি কেন? কারণ আপনি জানেন, শিশুদের জন্য বই হতে হয় সুন্দর সুন্দর ছবি সম্বলিত। তাই আমরা বইগুলো দারুণ দারুণ ছবিতে গল্প এবং ছড়া বলে। আমাদের বইগুলোতে যত না লেখা আছে, তার চেয়ে ছবি আছে অনেক বেশী। কারণ একটি ছবি হাজার শব্দের চেয়ে বেশী কথা বলতে পারে। তাছাড়া যে শিশুটির বয়স মাত্র এক/দুই বছর সে তো পড়তে পারে না। কিন্তু ছবি দেখে আনন্দ পায়। আমার লক্ষ্য করেছি, এই বয়েসের শিশুরা বড়দের বইয়ের ছবিওয়ালা পৃষ্ঠাগুলোতে কলম দিয়ে আঁকাআঁকি করে। তাকে নিষেধ করলে, কান্না করে। কিংবা সেই পৃষ্ঠাটি ছিড়ে নিতে চায়। সুতরাং তাদের জন্য বই হতে হবে ছবি ছবিতে ভরপুর। ছবিতে ছবিতে গল্প বলা, সংখ্যা শেখানোর ব্যবস্থা ইত্যাদি। আমাদের বইয়ের জন্য যারা ছবি এঁকেছেন তারা সবাই স্বনামধন্য ধ্রুব এষ, চিন্ময় দেবর্ষি, জুলকারনাইন আসজাদী, তন্ময় হাসান, এবিএম সালাউদ্দিন ষুভ, মাহবুবুল হক, সব্যসাচী মিস্ত্রী, নাজমুল আলিম মাসুম, সারা টিউন, বিপ্লব চক্রবর্তী, শেখ ফারহানা টুম্পা, শামীম আহমেদ। যারা লিখেছেন তারাও সুপরিচিত স্বনামধন্য মানুষ; যেমন তুষার আব্দুল্লাহ, সানজিদা সামরিন, কাকলী প্রধান, বিনয় বর্মণ, মানব গোলদার, ধ্রুব এষ, ফারজানা তান্নী, আহমেদ রিয়াজ, মাহবুবুল হক এবং আরো অনেকে। আপনিও হতে পারেন আমাদের একজন লেখক।
লেখার আছে আরো অনেক কথা। কিন্তু আপনার সময় আছে কি? দীর্ঘ লেখা পড়ার সময় সবার থাকে না। আবার না হয় লিখবো। কিন্তু সিডনি’র একুশে বইমেলা নিয়ে দুই একটি পর্যবেক্ষণের কথা বলা যাক। আমি নিজে উক্ত বইমেলার আয়োজক সংগঠন ‘একুশে একাডেমি, অস্ট্রেলিয়া’র একজন। কিন্তু তারপরেও যা সত্য তা বলতেই হচ্ছে। আমরা দেড় যুগের বেশী সময় যাবৎ সিডনিতে বইমেলা আয়োজন করছি, দিনে দিনে বইয়ের দোকানের সংখ্যা এবং তাদের বই বিক্রি বেড়েছে, একথা বলা যায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত সিডনি’র একুশে বইমেলায় শিশুদের জন্য তেমন কোনো বই বিক্রি হতে দেখিনি। কারণ কি? এখানে কি শিশুরা আসে না? প্রচুর সংখ্যক শিশুরা বইমেলায় আসে। অথচ তাদের কথা কেউ ভাবছে না। সিডনিতে কয়েকটি বাংলা স্কুল আছে। ছাত্রের অভাবে স্কুলগুলি চালানো বেশ কঠিন হচ্ছে বলেই জানি। অথচ কত সভা-সমাবেশে বাংলা নিয়ে কত কথা শুনি! আমরা প্রায় সবাই উদ্বিগ্ন, প্রবাসে আমাদের শিশুরা ঠিকমতো বাংলায় বলতে পারছে না। আবার অন্যদিকে তাদেরকে বাংলা ভাষাটা শোখাচ্ছিও না। তাহলে উপায়? কোনো উপায় নেই। আমাদের শিশুদের শুরুতেই বাংলা ভাষার ছড়া, গল্প, কবিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। বাঙালি সংস্কৃতির সাথে তাদের সংযোগ ঘটাতে হবে। এসব কিছুই আমাদের জাতিসত্তার জন্য প্রয়োজন। হতে পারে এখনো শিশুদের জন্য বাংলা ভাষায় ভালো বইয়ের অভাব। তবুও শিশুদের জন্য বই কিনুন। আপনার শিশুর জন্য আমরা কিছু না কিছু নিয়ে এসেছি, আরো আনবো। কথা দিচ্ছি, এ অবস্থা থাকবে না। আমরা কাজ করছি, আপনিও আমাদের সাথে যোগ দিন। আপনি তো আপনার শিশুকে প্রতিদিন কত কত গল্প বলে খাওয়াচ্ছেন, ঘুম পড়াচ্ছেন; সেই গুলোই আমাদের কাছে লিখে পাঠান। আপনার গল্পের/ছড়ার জন্য ছবি আঁকার শিল্পী আমাদের আছে। ভেবে দেখুন, শিশুরা কোনো খ্যাতিমান পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের নাম দেখে বই পছন্দ করে না। তাদের কাছে ছড়া, গল্প কিংবা ছবিটা ভালো লাগলেই সে নেবার/পাবার জন্য কান্না শুরু করে দেয়। সুতরাং আপনিও হতে পারেন, আমাদের একজন সহযাত্রী লেখক, ছড়াকার কিংবা অনুবাদক। এভাবেই আমরা ঋদ্ধ হবো, শিশুদের হাত ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাবো এবং বড় হবো তাদের সাথেই।
দেখা হবে ১৯ ফেব্রুয়ারি রবিবার, ২০১৭ একুশে বইমেলায়, সিডনিতে ইকরিমিকরি বুক স্টুডিওতে...
লেখা পাঠাবার ইমেইল: ikrimikrimail@gamil.com; shakhawatnayon@gmail.com
ড. শাখাওয়াৎ নয়ন, সিডনি
|