দোকান কোরবানি এবং ওভারসিজ কোরবানি কি ইসলাম সম্মত? ড. শাখাওয়াৎ নয়ন
সিডনিতে যারা দোকান কোরবানি দিয়েছেন, কিছু প্রশ্ন তাহাদের করকমলেঃ
(এক) আপনি কি কখনো চিন্তা করেছেন, আপনারা সবাই কিভাবে একই পরিমাণ মাংস পাচ্ছেন? কোরবানি তো মাংসের দোকান না যে আপনি একই পরিমাণ টাকা দিয়ে একই পরিমাণ মাংস পাবেন। এমন তো হবার কথা নয়। তাই না?
(দুই) অস্ট্রেলিয়ার সব গরুর দাম যদি একই হয় তাহলে একই পরিমাণ টাকা দিয়ে কোরবানি দেয়া যেতে পারে। কিন্তু সেটা কি সম্ভব?
(তিন) অস্ট্রেলিয়ায় সব গরুর ওজন কি একই? যদি তা না হয়, তাহলে সমগ্র সিডনিতে সবার কোরবানির মাংসের পরিমাণ একই হচ্ছে কিভাবে?
(চার) অস্ট্রেলিয়ায় একটি গরু যখন খামার থেকে বিক্রি করা হয়, তখন কমপক্ষে ঐ গরুটির ওজন হয় ৪/৫মন। এই ওজনের কম হলে খামার ব্যবসায়ী বিক্রি করেন না। কারণ তার লোকসান হবে। তাহলে আপনারা যারা ৭ ভাগে ২১০-১৫ ডলার খরচ করে কোরবানি দিয়েছেন, তারা মাংস পেয়েছেন ২০/২১ কেজি; এটা কিভাবে সম্ভব? একটু খেয়াল করুন, ২০ কেজি গুণন ৭ = ১৪০ কেজি। সাড়ে তিন মন। বাকি এক/দেড়মন মাংস কোথায়? গরুর সাইজ কোনোটি বড়, কোনোটি ছোট, আবার কোনোটি মাঝারি হবার কথা। অনেক সময় খামারে একই দামে এক সাথে অনেক সংখ্যক গরু/ছাগল বিক্রি হয়। কিন্তু তাই বলে সব গরু/ছাগলের ওজন কিন্তু একই হয় না। সম্ভবও নয়। (পাঁচ) আপনার কোরবানির মাংসের মধ্যে কি একটি গরুর সব অংশ খুঁজে পেয়েছেন? যেভাবে বাংলাদেশে পেতেন? নিয়মানুযায়ী কম করে হলেও সব অংশই পাবার কথা, তাই না?
(ছয়) আপনার কোরবানির গরুর চামড়ার টাকা কি করেছেন? বাংলাদেশে তো চামড়া বিক্রির টাকা গরীবদের দেয়া হয় কিংবা কেউ কেউ মসজিদ/মাদ্রাসা/আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামকে দিয়ে দেয়। সিডনিতে কি করেছেন?
(সাত) আপনার কোরবানির (প্রিয়!) পশুটি দেখতে কেমন ছিল? সেই পশুটি কোরবানি দেয়ার উপযোগী ছিল কি না, তা নিজ চোখে দেখেছেন?
(আট) এখানে প্রতিটি গরু সাত ভাগে সাত জনের নামে কোরবানি দেয়ার লোক বেশি; স্লটার হাউজে শত শত গরু জবাই হয়; আপনি কিভাবে নিশ্চিত হলেন, আপনার নামে যে গরুটি কোরবানি দেয়া হয়েছে, সেই গরুটির মাংসই আপনি পেয়েছেন?
অনেকেই এক কথায় বলবেন, বিশ্বাস। আপনার ‘সরল বিশ্বাস’ কিংবা ‘সত্য জানতে না চাওয়াটা’ যদি কাউকে অন্যায় করার সুযোগ করে দেয়, সেই অন্যায়ের দায় কি আপনার উপরও পড়ে না? আমি নিশ্চিত, আপনাদের মনে এই বিষয়ে অনেক প্রশ্ন এবং উত্তর তৈরি হয়েছে। দয়া করে শেয়ার করুন। আমাদের অজানা, জানা হবে। ভুল জানা সঠিক হবে কিংবা আংশিক জানা পূর্ণতা পাবে। শুধু সিডনিতেই প্রায় চার/পাঁচ হাজার বাঙালি কোরবানি দিয়েছেন। এরকম একটি ধর্মীয় বিষয়ে আমাদের স্বচ্ছ ধারনা থাকা প্রয়োজন, তাই না? কোনো দেশের কোনো সংস্থা মাংসের গায়ে হালাল সার্টিফিকেট দিতে পারে; দেয়া প্রয়োজন। কারণ সেটা দৈনন্দিন ব্যাপার। কিন্তু কোরবানি কি সেরকম বিষয়? এটা কি হালাল-হারাম নিশ্চিতকরণ প্রক্রিয়ার মতো? কোরবানি তো প্রত্যেকের অংশগ্রহণের বিষয়, তাই না?
যতদূর জানি, অস্ট্রেলিয়ায় কোরবানি দেয়া হয় তিনভাবে (১) দোকান কোরবানি (২) খামার কোরবানি এবং (৩) ওভারসিজ কোরবানি। দোকান কোরবানির বিষয়টি অধিকাংশ মানুষ সহজলভ্য মনে করছে; তাই হয়তো জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমার এই লেখাটি পড়ে কারো না কারো যদি মনে হয়, ‘সব কিছু তো ঠিকঠাক মতই হচ্ছে...এসব নিয়ে আবার এত প্রশ্ন করার কী আছে?’ আমি বলবো- অবশ্যই প্রশ্ন করার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ আমরা সৃষ্টির সেরা জীব। ঠিক-বেঠিক যাচাই-বাছাই করার জন্য পরম করুণাময় আমাদের জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়েছেন। সুতরাং প্রশ্ন করতেই হবে। হযরত আলী (রা:) বলেছেন, ‘প্রশ্ন জ্ঞানের অর্ধেক’।
পুনশ্চঃ
(১) দোকান কোরবানিঃ যদি কোনো একটি দোকানে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে কিংবা দোকানের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তিকে ফোনে, ইমেইলে কিংবা মেসেজ পাঠিয়ে অগ্রিম টাকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোরবানি দেয়া হয় তখন তাকে দোকান কোরবানি বলা হয়।
(২) খামার কোরবানিঃ কোরবানিযোগ্য পশুর (গরু/ভেড়া/ছাগলের) খামারে গিয়ে নিজে পছন্দ করে, নিজ হাতে যে কোরবানি দেয়া হয়, এটাকে খামার কোরবানি বলা হয়।
(৩) ওভারসিজ কোরবানিঃ সিডনি বসেই যদি কোনো একটি দোকানে গিয়ে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে কিংবা দোকানের দায়িত্বশীল কোনো ব্যক্তিকে ফোনে, ইমেইলে কিংবা মেসেজ পাঠিয়ে অগ্রিম টাকার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাংলাদেশে কোরবানি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়, তখন তাকে ওভারসিজ কোরবানি বলা হয়।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ উপরোক্ত “দোকান কোরবানি” এবং “ওভারসিজ কোরবানি” নাম দুটি ধর্মীয় নিয়মসিদ্ধ নয়। দোকান কোরবানি এবং ওভারসিজ কোরবানি ইসলাম সম্মত হচ্ছে কি না? এ প্রসঙ্গে কোনো মতামত ব্যক্ত করছি না; শুধুই প্রশ্ন উত্থাপন করছি। অনেকেই হয়তো উত্থাপিত প্রশ্নসমুহের উত্তর জানেন। যারা জানেন না, তারা উপযুক্ত আলেম-ওলামা কিংবা ইসলামী চিন্তাবিদদের পরামর্শ নিতে পারেন। ভালো থাকবেন। ঈদ মোবারক।
ড. শাখাওয়াৎ নয়ন, সিডনি
|