স্থায়ী ঠিকানা শাহাদাত চৌধুরী
দেশ থেকে টেলিফোন এলো। মুন্নি আমার ঠিকানা জানতে চাইলো। “কোন ঠিকানা?” একসময় ঠিকানা শুধু দুই ধরণের ছিল। বর্তমান আর স্থায়ী ঠিকানা। আন্তর্জালের যুগে ঠিকানা বহু ধরনের। “ওহ, বাসার ঠিকানা?” মুন্নি সিডনিতে আসবে এক সপ্তাহের জন্য। ওর অনেক প্রশ্ন। এয়ারপোর্ট থেকে বাসা কতদূর, আমার সময় হবে কি না, ভাবি চাকুরী করে, বিদেশে কাজের মানুষ নেই, ভাবির কষ্ট হবে কি না, ইত্যাদি। কি অর্থ হবে না ভেবেই আমার ঝটপট জবাব, “কাজের মানুষ নেই তো কি হয়েছে, আমিতো আছি।” ওর স্বামী রাশেদের নাকি একটা প্রশিক্ষণ আছে।
মুন্নি আসবে জানা মাত্রই আমার খুশিতে ঘুম নেই। কি করব, কোথায় ঘুরতে যাব, কি খাওয়াবো, কোথায় ঘুমাতে দিব। ইস, গত বছরে এত সাত পাঁচ হিসেব না করলে পাশের রাস্তার ৪ বেডরুমের বাসাটা কেনা হয়ে যেতো। এই বাসায় রুম ৩টা। আমার কেন জানি সব বাসাতেই ১টা রুম কম পড়ে। নতুন বিয়ের পর টোনা টুনির সংসার ছিল এক বেডরুমের ফ্লাটে। ভাবতাম যদি ২টা রুম থাকতো তাহলেই আমার সব চাহিদা মিটে যেতো। এখন এ বাড়িতে রান্নাঘরও ১টা কম। আরেকটা খোলা রান্নাঘর পেছনে থাকলে, ভাজা পোড়ার পদগুলি সারা বাড়ি জানান না দিয়ে রেঁধে ফেলা যেতো। গাড়িতেও ঠিক ১টা আসন কম, ওরা ২ জন আর আমরা ৪ জন। এদেশে আবার ৫ জনের যায়গায় ৬ জন গাদাগাদি করে বসলে পুলিশ ধরে।
সময় মত মুন্নিরা এলো। আমার ছেলেটা ওর ঘর খালি করে দিল। আমি হলাম পর্যটন গাইড এবং ড্রাইভার। আমার বৌ জিনাত হল আপ্যায়ন অফিসার। ও আগে থেকে রান্না করে রেখেছিল। খাবার টেবিলে মুন্নি ওর ভাবির রান্নার প্রশংসায় উচ্ছল। মুন্নি হচ্ছে আমার চাচাতো বোন। মেয়েটা সোজা ধরণের, না হলে ভাবতাম নিশ্চয় তেল ঢালছে। এদেশের মাংস আর মশলার মান ভাল, তাই মজাতো হবেই। তাছাড়া অতিথি আগমন উপলক্ষে বাজারটা একটু দেখে শুনে করেছিলাম। আমি একটু আস্তে বললাম, “হাঁ! ডালটা উচ্চ রক্ত চাপের রুগীর জন্য উপযোগী হয়েছে”। সাথে সাথে লবণ দানিটা আমার পাশে ঠক করে হাজির। অনেক দিনের সংসার, তাই আমাদের বোঝা পড়াটা ভাল।
রাতের খাবার শেষে আমরা ৩ জন ওদের ২ জনকে শহর দেখাতে নিয়ে গেলাম। জিনাত বাসায়, ঐযে ১টা সিট কম। মুল শহর কেন্দ্রে গাড়ি খুব কম চালান হয় আমার। তখনো জিপিএস এর প্রচলন হয় নি। একটু হিমশিম খাচ্ছিলাম, তবে পর্যটকদের তা বুঝতে দিলাম না। যেতে যেতে সিডনির অপেরা হাউস, হারবার ব্রিজ, তার তলে অবাক করা পানির নিচের সুরঙ্গ পথ, এসবের একটা জ্ঞান গর্ভ বর্ণনা দিয়ে দিলাম। সব কিছু বাদ দিয়ে মুন্নির ঐ সুরঙ্গ পথ দেখার শখ হল। আমিও তথাস্তু বলে গাড়ি ঘোরালাম। প্রথম চেষ্টায় ঘোরানো পেঁচানো, ২তলা ৩তলা রাস্তা ভুল করে চলে গেলাম হারবার ব্রিজের ওপরে। “অসুবিধা নেই ফিরবো পানির নীচ দিয়ে, মন্দ না হারবার ব্রিজও দেখা হয়ে গেল”, আমি সামাল দিলাম। কপাল আমার! ফেরার পথেও ফেল করলাম। রাশেদ আমাকে উদ্ধার করল, “সুরঙ্গ পথে কি জানালা আছে? এটা আবার দেখার কি হল?” বুঝলাম সরকারি চাকুরীজীবী ভগ্নীপতি বিচক্ষণ, তা না হলে কি মরুভূমির দেশে সরকারি ভাতায় নদী সুরক্ষার প্রশিক্ষণের সুযোগ পায়?
আমার বিপদ তখনো শেষ হয় নি। শহর দেখা শেষে ফেরার কালে দেখি আমার গতানুগতিক পরিচিত পথ বন্ধ। রাতে রাস্তার কাজ হচ্ছে। তাই অন্য রাস্তা ধরলাম। যা হওয়ার তাই হল, তাল গোল পাকিয়ে ফেললাম। সিডনির সব রাস্তাই আলো ঝলমল, শুধুমাত্র এপথটাই আমি আজ আসব তাই বাতি নষ্ট। ঘুট ঘুটে অন্ধকার, জনমানবশূন্য। গাড়ি থামিয়ে, টর্চ দিয়ে ম্যাপ বই দেখে রাস্তা ঠিক করছিলাম। ম্যাপ বই দেখে রাস্তা ঠিক করা জিপিএস পূর্ব যুগে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। পেছনের সিট থেকে ভয় মেশানো গলায় মুন্নি, “ভাবিকে একটা ফোন করে রাস্তা জেনে নিব?” ভাবছিলাম বলি, তোমার ইংরেজি জানা ভাবি ডান আর বাম নিয়েই বিভ্রান্তিতে থাকে, উত্তর দক্ষিণ হলে তো কথাই নেই।
দু’দিন বাদে মুন্নি দেশ থেকে আনা একটা লম্বা শপিং এর ফর্দ বের করলো। মানুকা মধু, প্রাদা সানগ্লাস, টিশত ঘড়ি, গুচি হাত ব্যাগ…। শুধুমাত্র মানুকা মধু ছাড়া ফর্দের কিছুই চিনলাম না। আমার দৌড় আবার উলওয়ারথ আর কে-মার্ট পর্যন্ত। জিনাত দেখি খুব স্বাভাবিক, “চল আজ ভাবির সাথে ঘুরাঘুরি করবে। তোমার ভাই এসব আমাকে কখনো দেয়নি তাই চিনবে না”। বিকেল বেলা ননদ-ভাবি গাড়ি ভর্তি মালামাল সহ মহা আনন্দে বাড়ি ফিরল। বুঝলাম বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। অযথাই আমি এদেশে সরকারি চাকুরী নিয়ে পড়ে আছি। জিনাত সগর্বে জানান দিল যে পথ হারায়নি আজ। পরে জানলাম, আমার বাসা থেকে মাত্র ১০ মিনিট দূরে বড় শপিং মলেই সব সওদা সমাপ্ত।
মুন্নির যাবার সময় হল। গত ৭ দিনে যেখানে যেখানে বেড়ালাম তা গত ৭ বছরেও যাওয়া হয়ে উঠেনি। এর মধ্যে মোবাইল ফেলে যাওয়া, ভুল যায়গাতে গাড়ি রাখা, অযথা বৃষ্টিতে ভেজা কোন কিছুই বাদ গেল না। ওদিকে আপ্যায়ন অফিসার দোকানের পিজা, চারকোল চিকেন বা আফগান রুটি যাই সরবরাহ করেন তাই মহা হিট হয়। বুঝতে পারছিলাম জিনাত ১০০ তে ১০০ পাবে। আমি ৩৩ পাই কিনা তাই নিয়ে চিন্তিত। যাবার দিন মুন্নি আর রাশেদ একটা জামদানি শাড়ি আর বিছানার সুন্দর নকশি কাঁথার চাদর আমাদের হাতে দিল। আড়ঙ্গের চাদর নিশ্চয় ৩৩ এর বেশি নম্বর হবে, দ্রুত হিসেব করলাম। বিদায়বেলায় মুন্নি মায়াভরা গলায় বলে,“আপনি এত বড় অফিসার, তার পরও নিজে গাড়ি চালান, নিজের হাতে গাড়িতে তেল ভরেন, নিজে খাবার টেবিল সাজান। আপনি অনেক ভাল”। ভাবলাম, ভাগ্যিস আমাকে ঘাস আর মাটি কাটতে দেখেনি। তারপর আমাকে অবাক করে ওর প্রশ্ন, “ভাইয়া! আপনি বিদেশে আর কতদিন থাকবেন? দেশে ফিরে যাবেন না? আপনার স্থায়ী ঠিকানায়?”
মুন্নিদের বেড়াতে আসার পর বেশ ক'বছর চলে গেল। আমি আজও ওর শেষ প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াই। দেশ আর বিদেশ, বর্তমান আর স্থায়ী ঠিকানা, ফেরা আর না ফেরা। কোথায় ফিরব? আমার সেই ফেলে আসা ঠিকানা আজ ইট পাথরে ঢাকা পড়েছে। কার কাছে ফিরব? ছাত্রজীবনে দেশ ছাড়ার কালে যারা আমাকে ধরে কেঁদেছিলেন, তাঁরা কেও আজ নেই। আমার বাবার স্থায়ী ঠিকানা হয়েছে বিদেশে - উত্তরার কবরস্থানে। ওনার চোখে চট্টগ্রাম জেলার বাহির ছিল বিদেশ। আমি যেমন মুন্নিকে সিডনি বিমান বন্দরে স্বাগত জানিয়েছিলাম, তেমনি আমাকে স্বাগত জানিয়েছিল মুকুল। আমার চার দশকের বন্ধু। ও যখন হঠাৎ অবাক করে প্রথম বাড়ি কেনে, আমার ঠিকানা ছিল ভাড়া বাসা। বলেছিলাম, মিলমত কোন বাড়ি চোখে পরলে আমাকে জানাতে। গত বছর তেমনি মুকুল হঠাৎ অবাক করে তার স্থায়ী ঠিকানায় চলে যায়, সিডনির কবরস্থানে। ভাবছি বলি, “মুকুল! মিলমত কোন যায়গা চোখে পড়লে ধরে রেখ, আমার স্থায়ী ঠিকানাটা এখনো ঠিক হয় নি।“
শাহাদাত চৌধুরী, সিডনি
|