কচুরিপানার ফুল শাহাদাত চৌধুরী
আমার ঘোরাঘুরির জায়গাগুলি বয়সের সাথে বদলে যাচ্ছে। এক সময় পাড়ার অলি গলি, তারপর রোকেয়া হলের আশে পাশে, সেখান থেকে ব্যাংককের বিশাল শপিং মলে, কিছু কাল আগেও ফ্লেমিংটনের কাঁচা বাজারে, আর ইদানীং বানিংস হার্ডওয়্যার এর দোকানে। কী নাই ওখানে! পেরেক থেকে শুরু করে পোকা মারার ঔষধ সবই পাওয়া যায়। আর পেরেক যে এত ধরণের হয় তা আগে কখনো ভাবিনি। বিশাল গজাল থেকে শুরু করে জুতার ছোট্ট পেরেক, সবই আছে। সারা চক বাজারের মাল জড় করলেও বানিংস এর একটা দোকানও ভর্তি হবে না।
সেদিন আমার বানিংস বিহার কালে দেখলাম মাত্র ২০ টাকায়, মানে ২০ ডলারে, ৫০ ডলারের একটা পন্ড বিক্রি হচ্ছে। পন্ড বাংলা যদিও পুকুর তবে এটাকে একটা বড় গামলা বলাই ভাল। আমার বাঙালি হৃদয়, প্রকৃত মূল্য থেকে ৩০ ডলার কমে, বাড়ির পেছনে একটা জলজ বাগান, এক টুকরো স্বদেশ পাবার এমন সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাতে চাইলো না। আমি গাড়িতে পুকুর ভরে মহা আনন্দে বাড়ি ফিরলাম। বৌ অবুঝের মত মন্তব্য করে বসলো, “তুমি নাকি পয়সা নষ্ট করোনা?” বুঝলাম কাল রাতের কথা এখনো ভোলে নি। আচ্ছা বলুন তো, ৮১ ডলারে এয়ার ফ্রায়ার কিনে ৩ মাসে একবার শুকনো চিপস খাওয়া আর আমার ২০ ডলারে ৩৬৫ দিন পুকুর পাড়ে বসে চা খাওয়ার কি এক হলো? মানুষের কথায় (বৌ তো মানুষই) কান না দিয়ে আমি আমার পুকুর প্রজেক্টে নেমে পড়লাম।
পুকুরটার ঠাই হোল আমার পেছনের বারান্দায়। খোলা যায়গায় বসালে রোদে পানিতে শেওলা হবে যে। বানিংস থেকে ১টা কচু আর ২টা বিলের ধারে হয় ঐ জলজ ঘাস কিনে এনে পুকুরে লাগালাম। দেশে ঐগুলো বিনা পয়সায়ও কেউ নেবে না। তবে আমি গাছ প্রতি ১৬.৫০ ডলার খরচ করে পুকুরে একটা দেশী-ভাব আনতে পেরে মুগ্ধ। ফেসবুকে ছবি আপলোড করে বাহবা কুড়ালাম। কদিন পর পুকুর পাড়ে বসে সিডনিতে দেশের আদলে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি, আর তখনি ঠিক দেশের আদলে মশার কামড়ে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বুঝলাম মশক নিধনের জন্য মৎস্য চাষের দরকার। মাছের ব্যাপারে আমি আবার একেবারেই অজ্ঞ। কোনটা মাগুর কোনটা শিং, কোনটা রুই কোনটা কাতল, কোনটা তাজা কোনটা পচা কিছুই বুঝতে পারি না! বৌ এর ভাষ্য এ জন্য আমার আম্মার অতি আদরই দায়ী। সময়মত আমাকে কাঁচা বাজারে না পাঠানোর কুফল। কিভাবে জানি ও আমার সব সীমাবদ্ধতায় আম্মার একটা ভূমিকা খুঁজে পায়!
যাক পারিবারিক ঐতিহ্য উপেক্ষা করে গেলাম মাছ কেনার জন্য। এ্যাকুয়ারিয়াম শপে গিয়ে দেখি দোকানির হাজারও প্রশ্ন। পুকুরের আয়তন, ঠাণ্ডা পানি না ঈষদুষ্ণ, নোনা না স্বাদু, অন্য কি মাছ আছে, কি পরিমাণ অক্সিজেন আছে পানিতে, সৌন্দর্য বর্ধন নাকি মশক নিধন, ক্লোরিন ছাড়ানো হয়েছে কি না। শেষ পর্যন্ত কেচকি মাছ জাতিও কিছু একটা পানি সহ ব্যাগে ধরিয়ে দিলো, আর ক্রেডিট কার্ড থেকে ৫ সেকেন্ডের পলকে ৫টা ছোট্ট মাছ বাবদ ১৫ ডলার হাতিয়ে নিল। পৃথিবীর সব মাছ ওয়ালারা এক মায়ের সন্তান। বৌ হিসাব দিল যে আমার ডোবার পেছনে আজ অবধি ৮৪.৫০ ডলার জলে গেছে। বুঝলাম এয়ার ফ্রায়ারের গরম বাতাস এখনো ঠাণ্ডা হয় নি।
আমার কেন জানি, যখন যেই প্রজেক্ট চলে তখন খালি তাই চোখে পড়ে। যেমন টিভি কেনার সময় যে বাড়িতেই যাই সব ছেড়ে শুধু টিভি চোখে পড়তো। কারটা কতো ইঞ্চি, কোন ব্রান্ড, রিমোট কেমন, কত দাম। গাড়ি কেনার সময়ও তাই, শুধু সবার গাড়ি চোখে পড়তো।
সেদিন দাওয়াত ছিল হেলাল ভাইয়ের বাসায়। সিডনিতে বাঙ্গালিদের যদি “গারডেনিং অস্ট্রেলিয়া” টিভি চ্যানেল থাকতো তাহলে ওনার বাগান নিশ্চয়ই দেখাতো। পেয়ারা গাছ থেকে শুরু করে পান পাতা, কিছুই বাদ নেই। সব ছেড়ে আমার চোখ পড়ল ওনার জলজ বাগানের কচুরিপানার ওপর। দেশে কচুরিপানা ছিল একটা মূল্যহীন আগাছা। না চাইতেই পাওয়া যায়। কোন ঠিকানা ছাড়া ভেসে বেড়ায়। কোন যত্ন ছাড়াই আকাশী রঙের ফুল ফোঁটায়। কেও লক্ষ্য করার আগেই ২দিন বাদে ফুলটা চুপ করে ঝরে পড়ে। আমি অবশ্য হেলাল ভাইয়ের কাছ থেকে কচুরিপানা উপহার পেয়ে মহা-খুশি। যাক আমার পুকুর প্রজেক্ট বুঝি শেষ হল। আমার পুকুরে এখন কচুগাছ, জলজ ঘাস, কচুরিপানা আর ছোট মাছ। পুকুর-ধারে বসে চা খাই, ফেসবুকে ছবি দেই, আর কি চাই জীবনে।
একদিন আমাকে অবাক করে দিয়ে ঠিক মামার বাড়ির বিষ্ণু পুকুরের মত আমার পুকুরেও একটা আকাশী রঙের কচুরিপানার ফুল ফুটল। ছোট বেলায় বছর দু’বছরে গরমের ছুটিতে গ্রামে মামা বাড়ি যেতাম। কচুরিপানা ভর্তি বিষ্ণু পুকুরের পাড়ে খেলতাম। খনন কালে নাকি সেখানে একটা বিষ্ণু মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। সেই থেকে পুকুরের নাম করণ।
আমাদের খেলার দলে সব সময় ‘দুধ ভাত’ থাকত আকাশী, আমার খেলার সঙ্গীর ছোট বোন। আমরা হাই স্কুলে, আকাশী প্রাথমিকে। আমাদের পিছু ছাড়ত না। শেষ বার যখন দেখা হয়েছিলো তখন আমি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ম বা ২য় বর্ষে। অনেক দিন পর মামার বাড়ি গিয়েছিলাম; আকাশী দৌড়ে এসেছিলো। শাড়ি পরা। গ্রামের বড় মেয়েরা তখন শাড়ি পরত। অকারণেই খুশিতে ডগমগ। হাসি আর চাহনিতে চিনতে পারলাম। ছোট কালের মতই আকাশীর হাতে আকাশী রঙের কচুরিপানার ফুল! “জুয়েল ভাই! আপনি নাকি ইঞ্জিনিয়ার হবেন? বড় বড় দালান বানাবেন?” আমার ডাক নাম জুয়েল যা এখন খুব কম মানুষই জানে। আরও অনেক প্রশ্ন। কি জবাব দিয়েছিলাম মনে নেই।
আকাশীদের সব কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আজ প্রায় তিন যুগ পর অনেক কিছুই বদলেছে। সময়ে, প্রবাসে, বয়সে। এখন কচুরিপানাও অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়। কেন জানি মনে হচ্ছে আকাশীকে পাশে বসিয়ে তার সব কথার জবাব দেই। “হাঁ, আকাশী! আজ আমি বড় ইঞ্জিনিয়ার হয়েছি, সিডনিতে দোতালা দলান বাড়ি আমার। জানো, আমার একটা বিষ্ণু পুকুর আছে, সেই পুকুরে কচুরিপানায় ফুল ফুটেছে। আকাশী! তুমি কেমন আছ? কোথায় থাকো? তুমি কি এখনো কচুরিপানার ফুল নিয়ে খেলতে পছন্দ করো?”
শাহাদাত চৌধুরী, সিডনি
|