গম্প
শনিবার শাহাদাত চৌধুরী
সেদিনটা ছিল শনিবার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আমার অপছন্দের একটা দিন। এদেশে ছুটির দিনে এত ছোটাছুটি, বাজারহাট, আর ঘরের কাজ যেন প্রতি সোমবার আমি কাজে যাই শুধু বিশ্রাম করার জন্য। আজ সকাল থেকেই বিপত্তি। গোসল চলাকালে এতো বোতলের মাঝে কোনটা যে শ্যাম্পু বুঝতে হিমশিম। কাল থেকে চশমা পরে গোসল করা লাগবে। তারপর ড্রেসিং টেবিলে কতো কি কৌটা। এতদিন আমি নাকি রাতের ক্রিম দিনে দিচ্ছিলাম। হয়তো এজন্যই আপিসে ঘুম ঘুম লাগতো। নাস্তার টেবিলে শুধু ঠাণ্ডা দুধ আর সিরিয়াল। এখন পৃথিবীর সব প্রিয়জন বাদ দিয়ে আমি খালি রহিমা’র মাকে মিস করি। আহ ঐ গরম পরোটা। যাক সে দুঃখের কথা। নাস্তার পর বাজার-যাত্রা। বাজারে তখন খুব মনোযোগ দিয়ে ২ লিটার আর ৫ লিটার তেলের দাম তুলনা করছিলাম – কবিতার ফোন। কেমন আছি, আজ ফ্রি কি না। মনে হচ্ছিল ওর মাথায় ৫ লিটারের বোতলটা ঢেলে দেই, দাম যাই হোক। কবিতা আমার বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটের বান্ধবী। কাছেই থাকে। মনি এসেছে ঢাকা থেকে, আমাকে খুঁজছে। মনি? কোন মনি? আমার তেলের হিসাব উল্টা-পাল্টা হয়ে গেল।
সেই আর্কিটেক্ট বান্ধবী মনি! মনি ছিল আমার সমবয়সী খালাতো বোন জাতীয় কিছু। ওর মা আর আম্মা একই স্কুলে পড়াতেন। এক সাথে বুয়েটে ঢুকি। হৈচৈ করে আসর জমাতে পারতো। ওর কাজ ছিল সবার সামনে আমাকে ডুবানো। ওর সুবাদে সবাই জানে যে আমি ছোটকালে কোরবানির ছাগলের তাড়া খেয়ে সবার সামনে ভ্যাঁ করে কান্না জুড়েছিলাম। ও এটাও রটিয়ে দিয়েছিলো যে দীলুর আমাকে খুব পছন্দ। দীলু মনিদের বাসায় ভাড়া থাকতো। যেমন মোটা তেমন হাবাগোবা টাইপের। মনি আমার কাছ থেকে সবসময় অংক আর রসায়ন বুঝে নিতো। সোজা এসাইনমেন্টও নিয়ে আসত। বলতো যে আমি ভীরু হলেও মেধাবী। ছেঁকা খাওয়া বড় ভাইয়েরা আমাকে সাবধান করে দিতেন যে এসব প্রশংসা কাজ বাগিয়ে নেওয়ার বুদ্ধি।
আমাদের সময় ক্যান্টিনের ১টা টেবিলে ২টা মেয়েকে ঘিরে ৮টা ছেলে আড্ডা দিতো। তবে আমার কানে সব কোলাহল ছাপিয়ে কেন যেন মনির গলাটাই বাজতো। ও থাকলে ক্যান্টিনের সব খাবারই মজা লাগতো। ক্যাম্পাসের ও কখন কোথায় আছে তাই মাথায় ঘুরতো। অবাক, কার পার্কে ওর দাড়িয়ে থাকা ড্রাইভারটাকে দেখলেও ভাল লাগতো। মনি যখন অন্য বন্ধুদের সাথে মেতে থাকতো, আমার মন খারাপ হতো। আমি সত্যি ভীরু ছিলাম। এসব অনুভূতির কথা কাওকে বলার সাহস পাই নি। যাক ছাত্রজীবনটা বোঝার আগেই শেষ হয়ে গেল। পাশ করার পর আমি হঠাৎ বৃত্তি পেয়ে উচ্চশিক্ষার্থে দেশ ছাড়ি। তাড়াহুড়ো আর উত্তেজনায় কারো কাছ থেকে বিদায় নেওয়া হয় নি। আর মনির সাথে যোগাযোগ ছিল না। তখন অন্তর্জাল বা মুঠোফোনের ব্যাবহার ছিল না। শুনেছিলাম ও এক বড় ডাক্তারের বৌ হয়ে কাতারে রানীর হালে আছে।
আজ দশ বছর পর সেই মনি। সিডনিতে একা বেড়াতে এসেছে। কবিতার বাসায় উঠেছে। মাত্র ৫ দিন থাকবে। আর্কিটেক্ট, তাই অপেরা হাউস দেখার খুব শখ। স্বামী এখন ঢাকার বড় এক হাসপাতালের পরিচালক। ছেলে মেয়ে নেই। এত বার থাকতে শনিবার, যেদিন আমার সময়ের টানাটানি থাকে! কবিতা নামিয়ে দিয়ে যাবে।
দুপর ২টায় আমার কলিং বেল বেজে উঠল। পর পর ৩ বার। দরজা খুলতেই খুশিতে আমাকে জরিয়ে ধরল। তারপর গর গর করে সিডনির আবহাওয়া থেকে শুরু করে রাস্তা ঘাটের একটা মূল্যায়ন করে দিল। আরো কতো কথা। মনি দেখছি আগের মতই অস্থির আর হৈচৈ টাইপের আছে। দেখতে একটু ক্লান্ত লাগছিল যদিও। আমার বৌ জিনাতকে বলে, তুমি ওকে ভাল আদর যত্ন করে হ্যান্ডসাম বানিয়েছ; আগে যেমন শুটকি মাছ ছিল তাতে কোন মেয়ের চোখে লাগতো না। তারপর একটা জামদানি শাড়ি জিনাতের হাতে দিয়ে বলে, এর বদলে তোমার হ্যান্ডসাম জামাইকে এক বিকেলের জন্য ভাড়া নিলাম, আমাকে অপেরা হাউস ঘুরে দেখাবে।। আর আমাকে 'প্রথম আলো' বইটা দিয়ে বলে, এটা তোর মজুরি। আমি অবাক। মনি কি করে জানে যে আমি সুনীলের পাঠক। হুম সব শনিবার মন্দ যায় না।
ভুল। শনির দশা তখনো শেষ হয় নি। আমি বেড়াবো বলে আজকেই ট্রেন লাইন বন্ধ করে মেরামত চলছে। চল্লিশ মিনিটের পথ পার হতে ঘণ্টার বেশি লাগলো। মুঠো ফোনটারও যাই যাই অবস্থা, গত রাতে চার্জ দেওয়া হয় নি। ছাতা নেই নি, তাই রোদ-ঝলমল দিনেও বৃষ্টিতে ভিজলাম। আমার পছন্দের কফির দোকানটা শনিবার বন্ধ পেলাম, কাপুচিনোর গল্পটা বৃথা গেল। গরম কাপড় সংগে নেই, তাই ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। অপেরা হাউসের অর্ধেক ঘেরা দেওয়া, ধোয়া মোছা চলছে, কাছে যাওয়া গেল না। তবে মনি দেখলাম খুশিতেই আছে। কোন অভিযোগ নেই। খালি পুরানো স্মৃতি আর বন্ধুদের নিয়ে গল্প। সেই সাদাকালো ছায়াছবি 'শনিবারের চিঠি' পারার টিভিতে, তাও মনে করিয়ে দিলো। অপেরা হাউস খুব মনোযোগ আকর্ষণ করলো বলে মনে হল না।
বিকেলে সমুদ্রের ধারে একটা বেঞ্চে বসলাম। রোদ-বৃষ্টির কারণে আকাশে একটা রঙধনু দেখা দিল। হৈচৈ টাইপের মনি এখন একদম চুপ। ব্যাগ থেকে ১টা কাঠের কলম বের করে বলে, নে তোর কলম, এটা ভুয়া।। সেই চন্দন কাঠের কলমটা? মনে পড়ল। শাহজালালের মাজারের পাশে এক ভণ্ড আমার কাছে তা ১০০ টাকাতে বিক্রি করেছিলো। তখন তা অনেক টাকা। শনিবার মাঝ রাতে ঐ কলমে কারো নাম ৭ বার লিখলে নাকি তার মন পাওয়া যায়। আমার সফর সঙ্গী আমার এই বোকামি ক্যান্টিনের আড্ডাতে ফাঁস করে দিয়েছিল। হাসাহাসির ফাঁকে মনি ছোঁ মেরে কলমটা নিয়ে গিয়েছিলো। ও নাকি তা ২০০ টাকায় মোটু দীলুর কাছে বিক্রি করবে। সমুদ্রের ধারে সন্ধ্যা নামছে। মনি শান্ত গলায় বলে, আমি ভেবেছিলাম দেশ ছাড়ার আগে তুই এই কলমটা ফেরত নিতে হলেও দেখা করে যাবি। আসলে শুধু তোর কলমটা ফেরত দিতেই সিডনিতে এসেছি। যদিও কলমটার কালি শুকিয়ে গেছে। আবার কবে মরে যাই, কোন দেনা রাখতে চাই না।। বুঝলাম না মনি হঠাৎ এরকম গম্ভীর কেন। তার চোখে এক ফোঁটা অশ্রু। আমি না দেখার ভান করলাম।
যাইহোক। মনি দেশে ফিরে গেল। আবার যোগাযোগ ফীকে হয়ে গেল। শনিবার আসে শনিবার যায়। ব্যস্ত জীবন, প্রথম আলো বইটা পড়া শুরু করা হয়নি। ঠিক ২৬টা শনিবার পর কবিতার ফোন। মনি আর নেই। ফুসফুসের ক্যান্সার ছিল। ধরা পড়েছিলো সিডনি আসার ২ সপ্তাহ আগে। মনি কাওকে জানাতে নিষেধ করেছিল। আমার পৃথিবীটা বুঝি ভেঙ্গে পড়লো। বাথরুমে লুকিয়ে কাঁদলাম, পুরুষদের কাঁদা নিষেধ যে। সেই সমুদ্রের ধারে মনির বেঞ্চে বসে থাকলাম প্রথম আলো বইটা বুকে ধরে। না আজ আকাশে রঙধনু নেই। বইটা খুলে হঠাৎ শেষ পাতায় দেখি ৭ বার আমার নাম লেখা। সব অচেনা লোকের সামনেই আজ আমার চোখেও অশ্রু। মনিকে বলা হোল না যে, সেই বহু বছর আগে এক শনিবার মাঝ রাতে আমিও লুকিয়ে ওর নাম ৭ বার লিখেছিলাম।
শাহাদাত চৌধুরী, সিডনি
|