জ্ঞান বিজ্ঞানের দৌড় ড. সফিকুল হাসান মিন্টু
আজ অফিসে লগ ইন করে এম ডির ব্লগে চোখ পড়তেই প্রথম ধাক্কাটা খাই। অবাক কাণ্ড! বিগ বস বলে কি? মঙ্গল গ্রহে কিভাবে খাওয়ার পানি সাপ্লাই হবে, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট হবে সেই বিষয়ে কথা বার্তা। “মার্স ওয়ান” মিশনের টপ হান্ড্রেডের অন্যতম একজন মানুষের সাথে সিডনি ওয়াটারের এম ডির সাক্ষাৎকার। সপ্তাহ দু’য়েক আগে ব্রিজবেনে অনুষ্ঠিত “অজ ওয়াটার ২০১৮” তেও এই নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অজ ওয়াটার হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ান ওয়াটার এসোসিয়েশনের বার্ষিক সেমিনার। যেখানে এই দেশের ও বাইরের স্বনামধন্য পানি বিশেষজ্ঞরা অংশগ্রহণ করে। ঘটনার শুরু তারও আগে, ওই মহিলা মে মাসের শুরুতে আমাদের হেড অফিসে এই নিয়ে একটা প্রেজেনটেশনও দিয়ে গেছে। সেই খবর এই অন্ধ দেখে নাই।
এই সব আকাশ মহাকাশ বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহ কোন কালেই ছিল না। কিন্তু ব্যাপারটা যেহেতু এতদূর গড়িয়েছে তাই এখন কিছু চিন্তা ভাবনা মাথায় আনাগোনা করছে। “মার্স ওয়ান” হচ্ছে সুইডেন ভিত্তিক একটা প্রাইভেট কোম্পানি, যারা ২০৩৩ সালের মধ্যে মঙ্গল গ্রহে স্থায়ীভাবে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে। এই নিয়ে তারা সারা বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞাপন দিয়ে, যাচাই বাছাই করে টপ একশো জন মানুষকে সিলেক্ট করেও ফেলেছে! যাদের মধ্য থেকে চূড়ান্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার পর কিভাবে প্রথম চারজন ভাগ্যবান বাছাই করা হবে তার প্রক্রিয়াও বলে দিচ্ছে!
আমি এখন সেই সেরা ১০০ জন মানুষের প্রোফাইল, সাক্ষাৎকার এবং যোগ্যতা দেখি, পড়ি এবং অবাক হই। কি সাহস তাদের, কি বৈচিত্র্য তাদের বয়স, ধর্ম বর্ণ ও যোগ্যতায়। সবাই এক পায়ে খাড়া কিভাবে তাদের জীবন উৎসর্গ করে দিবে মানব জাতির কল্যাণে এই দুঃসাহসিক কাজে। পৃথিবীর রসদ যদি কোনদিন ফুরিয়ে যায় তাহলে একটা উপায় তো বের করতেই হবে! সেই ১০০ জনের মধ্যে পুরুষ মহিলা প্রায় সমান সমান। এক তৃতীয়াংশ আমেরিকান, বাকি দুই তৃতীয়াংশ বিশ্বের অন্যান্য দেশের। যাদের মধ্যে সাতজন অস্ট্রেলিয়ান, চারজন ইন্ডিয়ান, একজন পাকিস্তানীও আছে। দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য জানি না, ওদের মধ্যে আমার মতো ভীতু বাঙালি কাউকে খুঁজে পেলাম না।
এখানে বলে নেয়া যাক, কেন মানুষ প্রায় অর্ধ শতক আগে চাঁদে পা দিলেও এখন চাঁদ বাদ দিয়ে মঙ্গলগ্রহে বসতি গড়নের পরিকল্পনা করছে। চাঁদ পৃথিবীর খুব কাছে থেকে পৃথিবীকে চক্কর দিলেও এর পরিবেশ মানুষের বসবাসের জন্যে অনুপযোগী। কারণ চাঁদে মানুষের বাঁচার জন্যে পানি, চাষ-যোগ্য মাটি, বায়ু এই সব অতি প্রয়োজনীয় রিসোর্স নেই। চাঁদের এক দিন পৃথিবীর প্রায় এক মাসের সমান যা মানুষ বা অন্য জীবকুলের জন্যে ভালো নয়। তাছাড়া ওখানে সূর্যের মারাত্মক তেজস্ক্রিয়তা থেকে বাঁচার উপায় মানুষের জানা নেই।
পৃথিবীর কাছাকাছি অন্য যে দুইটা গ্রহ আছে তারা হচ্ছে মঙ্গল ও শুক্র। শুক্রের অসুবিধা হলো, এটা সূর্যের খুব কাছে, ৪০০ ডিগ্ৰী তাপমাত্রা, এক এক রাত পৃথিবীর ১২০ রাতের সমান। ওখানে ব্যারোমেট্রিক প্রেশার পৃথিবীর সাগরের ৯০০ মিটার নিচের যে অবস্থা, সেই রকম। অ্যাসিড বৃষ্টি অন্য এক মহা সমস্যা!
সেই বিবেচনায় মঙ্গল গ্রহে সব দিক থেকেই মানুষের জন্যে মঙ্গলজনক। ওখানে এক দিন-রাত্রির দৈর্ঘ্য প্রায় পৃথিবীর সমান, ২৪ ঘণ্টা ৪০ মিনিট। অন্য গ্রহের তুলনায় ওখানকার তাপ মাত্রা খুব বেশি গরমও না খুব বেশি ঠাণ্ডাও না। ওখানকার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি পৃথিবীর ৩৮% যেখানে মানুষ হয়তো মানিয়ে নিতে পারবে। যেখানে পানির অস্তিত্ব আছে, অর্থাৎ বরফ গলিয়ে করা সম্ভব। সূর্য কিরণ আছে যা থেকে সোলার এনার্জি তৈরি করা সম্ভব।
এইতো মাত্র কয়েক বছর আগে কথা। আমার অতি পরিচিত এক ভদ্রমহিলার সাথে কথা হচ্ছিলো উনার জন্মদিন অথবা তাদের বিবাহ বার্ষিকীতে। ভীষণ খুশি খুশি অবস্থা! কারণ জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, জানেন মিন্টু ভাই, এইবার আমার জামাই আমাকে একটা দারুণ জিনিস গিফট করছে। ওই দূর আসমানের একটা তারা! এখন আমিই ঐটার একমাত্র মালিক।
আমি বলি, কিভাবে সম্ভব?
সম্ভব, সম্ভব মিন্টু ভাই। অনেক দাম দিয়ে কিনেছে সায়েফ। খুব অথেনটিক সোর্স। ইউনাইটেড নেশন এপ্রুভড!
আকাশ মহাকাশের তারা নক্ষত্র সব ধনী মানুষদের দখলে চলে গেছে, সে আমি জানি। আমি গরিব একটু ঘাটা ঘাঁটি করে সস্তায় কিছু পাওয়া যায় কিনা সেই চেষ্টায় আছি। চাঁদের ও মঙ্গল গ্রহের জমি কেনা বেচা হচ্ছে, ইন্টারনেটে দেখলাম, সেটাও ইউনাইটেড নেশন অনুমোদিত। মাত্র ২০ - ৩০ ডলার দিয়ে দুই একরের প্লট পাওয়া যাচ্ছে। চান্দের জমি সেই হিসাবে মন্দ না! পৃথিবীর খুব কাছে! যেতে না পারলেও পূর্ণিমার রাতে অন্তত একে তাকে দেখিয়ে বলা যাবে, ঐখানে আমার জমি আছে!
আমার দাদা মারা গেছেন প্রায় ১০০ বছর হতে চলেছে। সেই সময়কালে উনি চলা ফেরা করেছেন ডিঙি বেয়ে, সাইকেলে চালিয়ে অথবা রেল গাড়িতে চড়ে। তার নাতি হয়ে আমি এখন গাড়িতে চলা-ফেরা করি নিয়মিত। প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতাও একেবারে কম না। জ্ঞান বিজ্ঞানের যে দৌড় দেখছি, তাতে আজ থেকে একশো বছর পর কি হতে পারে? আমার নাতি পুতিরা সুইচ টিপে বেলুনের মতো যানে চড়ে বাড়ি থেকে অফিসের ছাদে গিয়ে নামবে মনে হয়! কোনো যান-জটের চিন্তা থাকবে না মাথায়। এক দেশ থেকে আরেক দেশে মান্ধাতা আমলের প্লেনে চড়ে বেড়াতে যেতে বোরড ফিল করবে। তারা হলিডেতে যাবে দ্রুতগামী রকেটে করে অন্য কোনো গ্রহে!
আমি আমার অর্ধ শতকের জীবনে কত পরিবর্তনই না দেখলাম। নিজেকে পরম সৌভাগ্যবানই মনে করি এই প্রজন্মের মানুষ হয়ে। ভাবা যায়, কি একটা কপাল নিয়েই না জন্মগ্রহণ করেছিলাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমার জন্মের আগেই হয়ে গেছে, তারপর আর কোনো বিশ্বযুদ্ধ হয় নাই। সব চেয়ে বড় দুর্ভিক্ষ বা বাংলার মহামারী সেও আমার জন্মের আগেই। স্বাধীনতা যুদ্ধে মাথার উপর দিয়ে গুলি গেলেও বেঁচে গেছি। চিঠির যুগের মানুষ আমি। তারপর দেখলাম টেলিফোন, ইমেইল। এখন ভিডিও কল দিয়ে চাইলেই প্রশান্ত মহাসাগরের ওই পাড়ে মায়ের সাথে দেখা করতে পারি সাথে সাথেই। অথচ একটা সময় গেছে, মা বাবাকে এই এক নজর দেখার জন্যে দীর্ঘ চার বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে!
“মার্স ওয়ান” এর কথা অনুযায়ী প্রথমে তারা মঙ্গল গ্রহে পার্মানেন্ট স্যাটেলাইট স্থাপন করবে। তারপর তারা চার জন মানুষ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি পাঠাবে। মানুষের জার্নিটা হবে ওয়ান ওয়ে। ফিরিয়ে আনার কোন পরিকল্পনা তাদের মাথায় আপাতত নাই। তারপর চার জন, চার জন করে পর্যায়ক্রমে মানুষ পাঠাতে থাকবে। কক্ষপথে পৃথিবী যখন মঙ্গলের নিকটতম অবস্থানে আসে, তখনই যেতে লাগবে ছয় মাসেরও বেশি সময়। বাতাসে কম অক্সিজেন, কম প্রেশার, কম মাধ্যাকর্ষণ শক্তি, এই সব নানান কারণে প্রাথমিক ভাবে মানুষ ওখানে যেয়ে এনক্লোসড ঘরে থাকবে। সোলার প্যানেলে ইলেক্ট্রিসিটি তৈরি হবে, তাদের ঘরের এয়ার কন্ডিশন ও অন্য সব এনার্জি বিষয়ক কাজ করার জন্যে। বাইরে থেকে বরফ গলিয়ে খাবার পানি তৈরি হবে। ময়লা আবর্জনা এবং সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট এবং রিসাইকেল হবে। গ্রিন হাউসের তৈরি করে খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার হবে। বৈরি পরিবেশে টিকে থাকার জন্যে তারা সব প্রফেশনের সব যোগ্যতার মানুষই সিলেক্ট করা হয়েছে। ওখানে বসে বসে তারা পৃথিবীর খবরাখবর, টিভি প্রোগ্রাম দেখতে পারবে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে (অল্প বিলম্বিত সময়ে)। মূল পার্থক্য হচ্ছে. দিন একটু লম্বা, ওদের এক বছর পৃথিবীর প্রায় দুই বছরের সমান (৬৮৬ দিন)। পৃথিবীর আছে একটি চাঁদ, কিন্তু তাদের আছে দুই চাঁদ বা উপগ্রহ!
ছবি: মার্স ওয়ানের পরিকল্পনায় কেমন হবে মঙ্গল গ্রহের বাড়ি ঘর
ড. সফিকুল হাসান মিন্টু, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|