ছোট গল্প লক্ষ্যভেদ শতরূপা সান্যাল
আমাদের পাড়াটা ছিল উত্তর কলকাতার টিপিক্যাল উদাহরণ। সবাই সবাইকে চিনত। ও বাড়ির বড়রা এ বাড়ির ছোটদের নির্দ্বিধায় শাসন করত। এ বাড়ির সত্যনারায়ণের সিন্নি পাড়ার সব বাড়িতেই পৌঁছে যেত। ও বাড়ির বড় কাকুকে দেখলে এ বাড়ির ছোটকা সিগারেট লুকিয়ে ফেলত। সবাই মিলে দোল দুর্গোৎসব করত। সে এক হৈহৈ ব্যাপার ছিল।
আমি তখন দুই বেণি দুলিয়ে স্কুলে যাই। গ্রীষ্ম-শেষে ফুটে ওঠা কৃষ্ণচূড়ার মত টগবগে উচ্ছল কিশোরী। পাড়ায় সমবয়সী মেয়েরা ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে পড়ে, কিন্তু বন্ধু সবাইই। কেউ পড়ে হোলি চাইল্ডের মত কট্টর ক্যাথলিক মিশনারি স্কুলে, কেউ বা সেন্ট মার্গারেটের মত প্রোটেস্টান্ট মিশনারি স্কুলে। কেউ বা ব্রাহ্ম গার্লস তো কেউ বা আদি মহাকালী পাঠশালার ছাত্রী। বিকেল হলেই সবাই জড়ো হতাম পাড়ার মাঠে। এক দিকে ছেলেরা ধাঁই ধাঁই ফুটবল খেলছে, অন্যদিকে বেঞ্চ পাতা, সেখানে পাড়ার বুড়োদের মজলিশ। আমরা মেয়েরা মাঠের যেদিকটায় টগর গন্ধরাজ স্থলপদ্মের গাছ ছিল, তার কাছে, সবুজ ঘাসের ওপর বসতাম। গল্প করতাম।
তন্ময়দা ছিল আমাদের সব মেয়েদেরই হার্ট থ্রব। দুর্দান্ত রেজাল্ট করত তন্ময়দা বরাবর, আর আমার বকুনি খাবার কারণ হয়ে দাঁড়াত। অংকে লাল কালির দাগ নিয়ে রেজাল্টখানা যখন আমার রাগী বাবার হাতে কাঁপতে কাঁপতে তুলে দিতাম, মা আড়াল থেকে বলতেন, শুধু অংকটাতেই তো ফেল করেছে, বাকিগুলো দেখো! গানে নাচে আবৃত্তি তে সবেতেই ও এগিয়ে। শুধু অংকটাতেই... বাবা গর্জন করে উঠতেন, তন্ময়কে দেখেছ? গান বাজনা খেলাধুলা সবেতেই আছে অথচ ক্লাসে ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয়না! ওকে দেখে শেখো!
সত্যিই তন্ময়দা অসাধারণ। আমাদের পাড়ায় পুজোর সময় চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্য হল। মেয়েরা নাচ করেছিল, গানে পাড়ারই গান গাইতে পারা কাকু কাকিমারা। ছোটরা তো অবশ্যই ছিল। তন্ময়দা অর্জুনের গান গেয়েছিল। আমি হয়েছিলাম অর্জুন। রিহার্সাল এ রোজ দেখা হত। কী যে ভাল লাগতো। তন্ময়দাকে দেখতে পাবো বলেই রিহার্সাল টা আমার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল।
ঐ অনুষ্ঠানটার পর থেকে তন্ময়দা আমায় অর্জুন বলে ডাকতো। আমার বন্ধুরা বলত, তন্ময়দা নাকি আমায় স্পেশাল চোখে দেখে। আমি বন্ধুদের কথাতেই মোমের মতন গলে যেতাম। কেন এমন হত, বুঝতে পারতাম না। তবে, তন্ময়দা ওর ভারি মোটরসাইকেল সওয়ারী হয়ে যখন রাজপুত্তুর এর মত আমার পাশ দিয়ে চলে যাবার সময় ডান হাতটা একটু তুলে নাড়ত আমার দিকে, আমার গলে যাওয়া কিশোরী মন ধন্য হয়ে যেত।
তন্ময়দা বিই কলেজে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে গেলো দুর্দান্ত রেজাল্ট করে। আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেলো। পাড়াটা যেন খালি খালি লাগতো। বিকেলে মাঠে যেতে ইচ্ছে করত না। কিন্তু, দেখা গেলো, তন্ময়দা প্রতি সপ্তাহেই বাড়ি চলে আসছে। বিকেলবেলা মাঠে দেখতে পেতাম, কাদা মাখামাখি হয়ে তন্ময়দার বলিষ্ঠ পা দুটো ফুটবল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আমি ঐ বিকেলগুলোর জন্য অপেক্ষা করতাম।
মাধ্যমিকে আমার রেজাল্ট হল পাড়ার মধ্যে সেরা। বাবা এবার খুশি। সবাইকে প্রাণ ভরে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। হঠাৎ মনে হলো, বাড়ির সামনে যেন তন্ময়দার ভারি মোটর সাইকেল এসে থামলো। আমি দৌড়ে ঝুল-বারান্দায় যেতে যেতে শুনতে পেলাম, “অর্জুন! অর্জুন!” তন্ময়দা আমায় প্রাইজ দিতে এসেছে, আমার ভালো রেজাল্টের খুশিতে! আমার মনে হল, আনন্দে আমি মরেই যাব। ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বলল, আমার একটু তাড়া আছে রে, তাই ভিতরে যাবোনা। এটা তোর। পড়িস। তোর কাছে একটা জিনিস চাইব। দিবি? আমি বললাম, হ্যাঁ দেবো। বলো কি চাও? তন্ময়দা হাসলো, ওর সেই ভুবন ভোলানো হাসি। বলল, আচ্ছা, সময় হলে বলব। মন দিয়ে পড়াশুনো করবি। তোর মাথা আছে। অনেক কিছু করতে পারবি জীবনে! চলি রে অর্জুন! লক্ষ্যভেদ করা চাই, কিন্তু!
তন্ময়দা সেই যে চলে গেল, আর এলোনা। ওর বাড়িতেও ফিরলো না, পাড়াতেও না। তন্ময়দার মা পাগলের মত হয়ে গেলেন। কোথাও কোনো খোঁজখবর পাওয়া গেলো না তন্ময়দার। হস্টেল থেকেই সব কিছু ফেলে রেখে কোথায় যে উধাও হয়ে গেলো, জানতেই পারলাম না।
আমি তন্ময়দার দেওয়া উপহারটা খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছিলাম। বিবেকানন্দের রচনার একটা কালেকশন। মাঝেমাঝেই বইটা পড়তাম। মনে পড়ত তন্ময়দার কথা। ওর বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, রাজপুত্রের মত আসা যাওয়া। কানে বাজত, “অর্জুন” ডাকটা!
কালের নিয়মেই এক সময় পাড়াটাও অনেকটা বদলে গেলো। তন্ময়দার কথাও চাপা পড়ে গেলো নতুন নতুন ঘটনা প্রবাহে। আমারও বিয়ে হয়ে গেলো। পাড়াটা থেকে দূরে চলে গেলাম। আমার বর ভালোমানুষ। ইতিহাসের অধ্যাপক। পড়াশুনো নিয়েই থাকেন। কম কথা বলেন। আমাদের ছেলে ঋক। সে খুব মেধাবী এবং অসম্ভব দুরন্ত। তার বাবা তাকে সামলাতে পারেনা, ফলে আমিই পড়াই তাকে। আমার ঋককে দেখে তন্ময়দার বলা সেই অর্জুনের লক্ষ্যভেদের কথাটা মাঝেমাঝেই মনে পড়ে যায়। ঋকের পড়াশুনো, শিক্ষাদীক্ষা আর রেজাল্টই এখন আমার ধ্যানজ্ঞান। ওকে সবার সেরা করে তোলাই আমার লক্ষ্য।
আমি ঋককে রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দর আদর্শে গড়ে ওঠা মিশন-স্কুলে ভর্তি করে দিলাম। বলা ভালো, ও মেধার জোরেই সেখানে সুযোগ পেলো। হোস্টেলেই থাকে ছেলে। আমি প্রতি ভিজিটিং ডে তেই ট্রেনে করে চলে যাই ছেলেকে দেখতে। ছেলের পরিবর্তন টাও লক্ষ্য করি। সে অনেক ধীর স্থির শান্ত হয়ে গেছে। শুধু সিলেবাসের পড়া নয়, নানান বিষয়েই তার জানার আগ্রহ। ইন্টারনেট সাঁতরে সে এপার ওপার করে। তার এই আগ্রহে মিশনের সন্ন্যাসী শিক্ষকেরাও মদত দেন রীতিমত। আমি বুঝতে পারি, আমি ক্রমশই লক্ষ্যভেদের দিকে এগোচ্ছি।
ঋক দুর্দান্ত রেজাল্ট করল মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাতেও। আমি চেয়েছিলাম ও ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু অংক ওর প্রিয় সাবজেক্ট। সেটাই পড়তে চেয়েছিল ঋক।
ছেলের এই সাফল্য শেষ পর্যন্ত তার বাবা দেখে যেতে পারেননি। অকালে চলে গেছিলেন সামান্য অসুস্থতার পর। তাই, ঋকের জীবন জুড়েই শুধু মা আর মা। পুত্র গরবে গরবিনী আমি স্বপ্ন দেখি, ঋকের উজ্জ্বল ঝলমলে ভবিষ্যৎ, ভর-ভরন্ত সংসারের।
একদিন ঋক আমার কাছে এসে বলল, তোমার সব ইচ্ছেগুলোই আমি পূরণ করেছি, মা। এবার আমায় আমার ইচ্ছে পূরণ করতে অনুমতি দাও। আমি ভাবলাম, লাজুক ছেলে হয়তো তার পছন্দের মেয়েটির কথা আমায় বলতে চাইছে। এটা তারই প্রস্তাবনা। আমি বললাম, বেশ তো, অনুমতি দিলাম! ঋক বলল, আমায় আশীর্বাদ করো মা, জগতের কল্যাণ যেন করতে পারি। আমি সন্ন্যাস নিতে চলেছি।
আমার মাথায় যেন সারা আকাশটা ভেঙে পড়লো। ঋক আমায় হতবাক করে দিয়ে ওর প্রাণাধিক প্রিয় শিক্ষকের একটা ছবি আমায় দেখালো- মা, ইনিই আমার গুরু, আমার পথপ্রদর্শক। আমি এঁর কাছেই দীক্ষা নেব। তুমি আমায় অনুমতি না দিলে আমার তো সন্ন্যাস নেওয়া হবে না!
আমি দেখলাম, ঋকের গুরু আর কেউ নয়, আমার কিশোরী মনে ঝড় তোলা সেই তরুণ-তন্ময়দা! তন্ময়দাকে আমি সারা পৃথিবী দিতে রাজী ছিলাম একদিন। কিন্তু আজ আমি বড় কৃপণ। কি করে আমি তার হাতে তুলে দেবো আমার ছেলেকে? এই সংসার ঘিরেই যত স্বপ্ন আমার। জগৎসংসার কে নিয়ে ভাবার ফুরসৎ ই তো নেই!
সারা রাত ভাবলাম। কত কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আমাদের পাড়া। মাঠের বিকেল। চিত্রাঙ্গদা। অর্জুন। সকালে ঋক এসে বসলো পায়ের কাছে, বলল, তাহলে আমি যাই? তোমার সম্মতি দাও, মা! আমি ছেলের মাথায় হাত রেখে বললাম, দিলাম!
শতরূপা সান্যাল, কলকাতা
|