bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন



রবি ও রথী / সিরাজুস সালেকিন


আগের অংশ


বিশ শতকের প্রারম্ভে শহরের কলকারখানার বাড়বাড়ন্তে গ্রামের শিল্পী সমাজ ভেঙে পড়েছিল সেদিন রবীন্দ্রনাথ আক্ষেপ করেছিলেন শিল্পীকে মজুরে পরিণত করা হচ্ছে। গ্রামকে স্বনির্ভর করে গড়ে তোলার যে স্বপ্ন রবীন্দ্রনাথ দেখতেন তা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে হাতে কলমে কারুশিল্পের কাজ বিশ্বভারতীতে প্রথম শুরু হয় প্রতিমা দেবীর উদ্যোগে ১৯২২ সালে শান্তিনিকেতনের কলাভবন চত্বরে। পরে সুনির্দিষ্ট কারণে রবীন্দ্রনাথ ১৯২৮ সালে এই চর্চাকে সরিয়ে শ্রীনিকেতন রেল কোম্পানির এক পরিত্যক্ত বড়ো চালাঘরকে সারাই করে হল অফ ইন্ডাস্ট্রি নাম দিয়ে স্থানান্তরিত করেন এবং রথীন্দ্রনাথের উপর বিশ্বভারতীর গ্রামীণ শিল্প বিভাগটির গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেন। বস্তুত তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বে গড়ে ওঠে শিল্পভবনের মজবুত ভিত এবং মূলত তাঁরই উদ্যোগে এদেশে সর্বপ্রথম জাতি–ধর্ম ভেদাভেদ উপেক্ষা করে গ্রামে গ্রামে প্রশিক্ষিত কারুশিল্পী নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন শিল্পে হাতেকলমে কাজ শেখানোর চেষ্টা শুরু হয়। রথীন্দ্রনাথ কারুশিল্পের দীক্ষা পেয়েছিলেন জাপানের কাছ থেকে। ১৯২৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত তিনি এই বিভাগটির কর্ণধার ছিলেন। মূলত রথীন্দ্রনাথের অক্লান্ত চেষ্টা ও পরিশ্রমে ‘শিল্পভবন’ একটি সার্থক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং ভারতবর্ষের কারুশিল্পের হৃত–গৌরব পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়। ধীরে ধীরে শ্রীনিকেতনের পার্শ্ববর্তী গ্রামের মানুষদের নিকট শিল্পভবন রুজি–রোজগারের এক আকাঙ্ক্ষিত কর্মস্থল হয়ে ওঠে। আজকে যখন দেখি বাটিক শিল্প, সৌন্দর্যমন্ডিত চর্মশিল্প, স্থানীয় মৃত্তিকা নির্মিত গ্লেজ–পটারি ইত্যাদি নতুন নতুন ডিজাইনের হ্যান্ডলুম শাড়ি, বেডকভার, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, দরজা–জানালার পর্দা, মোড়া,বাঁশ, বেত, গালার কাজ, সৌখিন চামড়ার ব্যাগ, বাটিকের চাদর, পোড়ামাটির কাজ তখন মানসপটে ভেসে ওঠে রথীন্দ্রনাথ। এই সমস্ত জিনিসে যেন রথীন্দ্রনাথের হাতের স্পর্শ লেগে আছে। ভারতীয় কারুশিল্পে দেশ বিদেশে খ্যাত ও চাহিদা-যুক্ত ‘শান্তিনিকেতনী রীতি’ প্রবর্তন করার মূলে ছিলেন শিল্পী ডিজাইনার রথীন্দ্রনাথ।

মুচিশিল্পকে কেউ যদি ভারতবর্ষে আমদানি করার দাবি করে থাকেন তবে তিনি রথীন্দ্রনাথ। ‘আজকে চামড়ার কাজ ভারতবর্ষ জুড়ে চলেছে, কিন্তু অনেকেই জানেন না যে এই শিল্প রথীদাই প্রথম বিদেশ থেকে শিখে এসে প্রচলন করেছিলেন’ — মৈত্রেয়ী দেবীর এই বক্তব্যের সাথে সহমত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাণী চন্দ, বীরভদ্র রাওচিত্র। ১৯২৪ সালে ইউরোপ ভ্রমণই এর অনুপ্রেরণা। রাণী চন্দ তাঁর সব হতে আপন বইতে জানাচ্ছেন — ‘স্বামী–স্ত্রী বিদেশে কিছুদিন থেকে এই ক্রাফট অতি যত্নের সঙ্গে শিখে এসেছিলেন। উত্তরায়ণের জাপানি ঘরের লাগা দক্ষিণের বারান্দায় বৌঠান–রথীদা আমাদের কয়েকজনকে নিয়ে চালু করলেন এই কাজ।’ চর্মশিল্প কাজে রথীন্দ্রনাথের অসাধারণ দক্ষতা ছিল। এই কাজে বহু পরীক্ষা–নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভারতীয় শিল্পকাজের ছাপ আনতে সক্ষম হন। চামড়াকে ট্যানিং করে তার ওপর ছবি ও নকশা মিলিয়ে কত না রঙে সাজিয়ে দৈনন্দিন শিল্প গড়ে তুললেন। হাতব্যাগ, ফাইল, ফোলিয়ো ব্যাগ, লেদার কেস, বাক্স — কত রকমের জিনিস গড়ে তুললেন। চামড়া শিল্পকে ডিজাইন প্রযুক্তিতে রূপান্তরিত করে ব্যাপকভাবে বিপণন ব্যবস্থা গড়ে উঠল। এই কাজে স্থানীয় কারুশিল্পীরা উপকৃত হল। বিক্রি থেকে ভালো রোজগার এল। স্বনির্ভরতার আশা জেগে উঠতে লাগল। শান্তিনিকেতন ডিজাইন দেশে বিদেশের বাজারে ছড়িয়ে পড়ল। স্থানীয় চর্মশিল্পীদের সুবিধার্থে শিল্পসদন ও স্থানীয় চর্মশিল্পী গোষ্ঠীবৃন্দের যৌথ উদ্যোগে রথীন্দ্রনাথ উদ্ভাবিত ‘শান্তিনিকেতনী চর্মশিল্প’ গত ২০০৭–২০০৮ সালে ভারত সরকারের বিশেষ স্থানাঙ্কিত সম্পদ স্বরূপ ভৌগলিক চিত্র (Geographical Identification) ব্যবহারের স্বীকৃতি আনানো একটি যুগান্তকারী ঘটনা। চর্মশিল্প আর বাটিক শিল্পের প্রবর্তক হিসাবে রথীন্দ্রনাথ এর কাছে এদেশ ঋণী থাকবে চিরকাল।

কাঠের কাজ রথীন্দ্রনাথের প্রাণের সম্পদ। আজীবনই নিজের হাতে কাঠের কাজ করে গেছেন তিনি। কাঠের জাত, কাঠের প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর খুব ভাল ধারণা ছিল। যেমন কোন কাঠে কোন জিনিস ভাল দেখাবে, কোন কাঠে কোন ডিজাইন ভাল খুলবে সে সম্বন্ধে তিনি বিশেষ অভিজ্ঞ ছিলেন। কাঠের inlay ও কাঠের আসবাবপত্র যেমন চেয়ার, টেবিল, আলমারি ইত্যাদি তিনি খুব ভাল তৈরি করতে পারতেন। রথীন্দ্রনাথই প্রথম শিল্পসম্মত, সহজ–সরল অন্দরসজ্জা ও আসবাবপত্রের উৎপাদন ও বিস্তৃত প্রসারণের মাধ্যমে বিশ শতকে দেশের ধনী ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত থেকে গ্রামের সাধারণ মানুষের কাছে আসবাবপত্রের সৌন্দর্য এনে হাজির করলেন। শুধু তাই নয়, আজকে যে স্থান-সংকোচনশীল আসবাবপত্র লভ্য, তা এদেশে প্রথম চালু করেন রথীন্দ্রনাথই। ১৯২৫ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যকালীন সময়ে শান্তিনিকেতনে উত্তরায়ণ চত্বরে নির্মিত গৃহগুলি এবং ঐ গৃহগুলির প্রয়োজনে নির্মিত আসবাব ও অন্দরসজ্জাগুলি মূলত রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর দক্ষিণহস্ত সুরেন কর মহাশয়ের মস্তিষ্ক প্রসূত। চিত্রভানুতে, কোণার্কে, উদয়নে, স্নানঘর ও স্নানঘর সংলগ্ন আসবাব–স্থাপত্য যখন নির্মাণ করলেন তখন ভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর ফুল ও প্রকৃতিমুখী জ্যামিতিক ডিজাইন নতুন আস্বাদে ফিরে এল।

রথীন্দ্রনাথ প্রথম শ্রেণীর একজন আর্কিটেক্ট ছিলেন অথচ ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা নিয়ে তিনি কখনও পড়েননি। এটা তাঁর সহজাত গুন। নানারকম বাড়ির ডিজাইন করা তাঁর অন্যতম হবি ছিল। আর্কিটেক্ট রথীন্দ্রনাথের শিল্পীমনের পরিচয় বহন করে শান্তিনিকেতনের বাড়িগুলো। রথীন্দ্রনাথ তাঁর বন্ধু সুরেন্দ্রনাথ করের সাথে শান্তিনিকেতনে যে ছোটো ছোটো হস্টেল এবং বাসগৃহের পরিকল্পনা করেছিলেন তার বিশেষ একটা চরিত্র ছিল। স্থপতি রথীন্দ্রনাথের এই দিকটি সুন্দরভাবে ধরা দিয়েছে এ্যান্ডুশ সাহেবের কলমে — ‘Rathi is writing poetry in bricks and mortar.’।

শান্তিনিকেতনের কঙ্করময় জমিতে গোলাপ গাছ হতনা বললেই চলে। সেই জমিতে গোলাপ-বাগান করেছিলেন রথীন্দ্রনাথ। রথীন্দ্রনাথের সেই দুঃসাধ্য-সাধন দেখে প্রত্যক্ষদর্শী গোলাপ-প্রেমী কবির সন্তুষ্ট উচ্চারণ — ‘রথী, আমি জীবনে কখনই ভাবতে পারিনি এখানে গোলাপ ফুল দেখব। তুমি অসম্ভবকে সম্ভব করেছ।’

রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন যে তাঁর ছায়ার বাইরে যদি রথীন্দ্রনাথ জন্মাতেন, তবে রথীন্দ্রনাথ নিজের নামেই সুপরিচিত হতেন, বিখ্যাত মানুষ হতেন। ব্যক্তি রথীন তাঁর পিতৃ-পরিচয়ের আড়ালেই ঢাকা পড়ে ছিলেন, হারিয়ে গেছেন পিতৃ-ছায়ায়। তবে এ নিয়ে রথীন্দ্রনাথ এর কোন মাথা ব্যথা ছিল না। শুধুমাত্র এ কারণেই রথীন্দ্রনাথকে এতটা শ্রদ্ধা আর ভালবাসা যায়। রথীন্দ্রনাথের জ্যাঠতুতো দাদা হিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর পারিবারিক খাতায় রথীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন — ‘রবিকাকার একটি মাণ্যবান ও সৌভাগ্যবান পুত্র হইবে, কন্যা হইবে না। সে রবিকাকার মত তেমন হাস্য-রসপ্রিয় হইবে না, রবিকাকার অপেক্ষা গম্ভীর হইবে। যে সমাজের কার্য্যে ঘুরিবার অপেক্ষা দূরে দূরে একাকী অবস্থান করিয়া ঈশ্বরের ধ্যানে নিযুক্ত থাকিবে।’ কথাটা খুবই সত্যি হয়ে গেল। তিনি যেন ছিলেন রবি রথের সারথি।

আসলে রথীন্দ্রনাথের জীবনে আবেদনের চেয়ে নিবেদন শিল্পই যেন বেশি। নানা সময় নানা কাজে পিতার ইচ্ছার কাছে আত্মবলি দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত বিশ্বভারতীর একজন বড়ো-মাপের ‘কেয়ারটেকার’–ই থেকে যেতে হয় তাঁকে। নীরব কর্মেই ছিল তাঁর আসক্তি ও মাহাত্ম্য। চিরজীবন তিনি উইংসের আড়ালেই রয়ে গেছেন, স্টেজে নামবার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেননি। তিনি ‘কর্মের উচ্চ দাম’ দিয়েছেন, কিন্তু তাঁর মতো ‘কর্মীর নাম নেপথ্যেই’ রয়ে গেছে।

জীবনের উপান্তে রথীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী ত্যাগ করে আকস্মিকভাবে স্বেচ্ছা–নির্বাসন নেন দেরাদুনে। কেউ বলেছেন ভুল বোঝাবুঝি, কেউ বলেছেন সরকারি নিয়মের বাঁধন ভালো লাগেনি, কেউ বলেছেন অবকাশ যাপনের আকাঙ্ক্ষা। কিন্তু কেউ বলেননি পিতার ছায়া থেকে দূরে ‘নিজের জীবন’কাটাবার সে ছিল প্রয়াস। চিরকাল নেপথ্যচারী মানুষটির মৃত্যুও ঘটেছে জনতার দৃষ্টির আড়ালে। কবি গুরুর প্রিয়তম পুত্রটি ১৯৬১ সালের ৩রা জুন মাত্র ৭২ বছর বয়সে দেরাদুনের বাড়ীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর অনেক পূর্বেই তিনি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি সরকারকে দান করে দিয়েছিলেন। পিতার জন্ম-শতবর্ষের বিপুল কোলাহলের আড়ালে সহজেই চাপা পড়েছে কবি-পুত্রের মৃত্যু সংবাদটি। এমনভাবে নিজেকে নিশ্চিহ্ন করতে পারাও কি আর্ট নয়?



আগের অংশ

সিরাজুস সালেকিন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 12-Jun-2018

Coming Events:





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far