রবি ও রথী / সিরাজুস সালেকিন
আগের অংশ পরের অংশ
তিনতলা থেকে সোজা নেমে জুতা সংগ্রহ করে আবার যেতে হবে অভ্যর্থনা কক্ষে। সেখানে রক্ষিত ক্যামেরা, বা যাবতীয় জিনিস সংগ্রহ করে বের হতে হবে। বাগানের উঠোনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছে করলে ছবি তোলা যাবে। সোজা পথ ধরে হাঁটতে থাকলে হাতের বাঁদিকে চোখে পড়বে একটি গ্যারেজ। এখানে একটি গাড়ি রাখা আছে কালো রঙের। এটি মূলত রবীন্দ্রনাথের ব্যবহৃত গাড়ি। এটি এখন বিশ্রামে আছে। এর যাত্রী ছুটি নেবার পর এটিও ছুটি পেয়েছে অনন্তকালের। আর সাক্ষী হয়ে আছে একটি অধ্যায়, একটি কালের। তবে মনে হল গাড়ীটি খুব অযত্নে পড়ে আছে, ধুলাবালি মাখা গাড়ীটা দেখলে বাঙ্গালীদের মন মানসিকতার একটা চিত্র ফুটে ওঠে। আমরা বাঙ্গালীরা এরকমই। যা অনায়াসে পাই তার মূল্য দিতে পারি না।
বাড়ির পুরনো অংশের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে দালানটি। ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার আগে এটি ছিল ঠাকুরদালান। তখন এখানে দুর্গাপুজো হত। ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষার পর এই দালান নিরাকার ব্রহ্মকে উৎসর্গ করা হয়। সিডনী ফিরে এসে মনে হচ্ছে আমি সেই জোড়াসাঁকোকেই ছুঁয়ে এসেছি। জোড়াসাঁকো আমাকে আবার নতুন করে ভাবতে শেখাচ্ছে। আমার দায়িত্ববোধ আরও বেড়ে গেল। যারা এই বিদেশ বিভূঁই এ বসে শিল্প-সংস্কৃতি নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেল।
দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলো দেখলে বোঝা যায় এ তাঁর রোগশয্যার চিহ্ন। এই প্রয়াণ-কক্ষেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এর পিছনের ঘরে পর্দা টেনে তাঁর অস্ত্রোপচার করেন চিকিৎসকেরা। যাই হোক, এবার আসল কথায় আসি। যার কথা ভেবে লেখা শুরু করেছিলাম, তাঁকে নিয়ে শুরু করতেই এতটা সময় লেগে গেল। জোড়াসাঁকো যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে এক বিশাল বিজ্ঞাপন দেখলাম। আমরা দুজনেই ঠিক করলাম সন্ধ্যায় যাব সেই অনুষ্ঠানে। জোড়াসাঁকো থেকে ফিরে সন্ধ্যায় গেলাম অনুষ্ঠানে – কলামন্দিরে - অনুষ্ঠানের নাম “রবি ও রথী”। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর ছেলে রথীন্দ্রনাথ কে নিয়ে অনুষ্ঠান। মিলনায়তনের মুখে একজন টিকিট দেখছেন। আমরা গিয়ে বললাম যে আমরা কিভাবে দু’টো টিকিট পেতে পারি। উনি জানালেন যে অনুষ্ঠানটি শুধুমাত্র আমন্ত্রিত অতিথিদের জন্য। ওনাকে বললাম যে আমরা বাংলাদেশের - অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছি, সাথে সাথে উনি আমাদের দু’টো টিকিট দিয়ে দিলেন। ভেতরে ঢুকলাম, একটু পরে ঠিক সময়মত অনুষ্ঠান শুরু হল।
কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথকেই মূলত আলোকিত করা হয়েছে। শুধুমাত্র পাঠ ও রবীন্দ্রনাথ এর গান দিয়ে সাজানো। সব মিলিয়ে অনবদ্য পরিবেশনা। ঠাকুরবাড়ির নানা অজানা ঘটনা, রথীন্দ্রনাথ কে ঘিরে পারিবারিক ও শান্তিনিকেতনের কুটকাচালী, রবীন্দ্রনাথ এর জন্য রথীন্দ্রনাথ এর যাবতীয় ত্যাগকেই তুলে ধরা হয়েছে।
কবিগুরুর সাথে রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবী জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ১৮৮৮ সালে রথীন্দ্রনাথ এর জন্ম। প্রাথমিক শিক্ষা শান্তিনিকেতনে। ১৯০৬ সালে রথীন্দ্রনাথ আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যান কৃষিবিজ্ঞান পড়তে, ১৯০৯ সালে বি এস ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফেরেন। শ্রীনিকেতনে কৃষিকাজ নিয়ে কাজ শুরু করেন। আমেরিকা থেকে ফিরে রথীন্দ্রনাথ বাবার সাথে শিলাইদহ যান।
শিলাইদহ র বর্ণনা দিতে গিয়ে রথীন্দ্রনাথ বলেছেন, “সেখানে বাবা ছাড়া আর কেউ ছিল না। বিশাল নৌকায় ভেসে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায়ই আমরা জগতের নানা বিষয় নিয়ে মেতে উঠতাম”।
১৯০২ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর মাত্র ৩০ বছর বয়সে কবিপত্নি মৃণালিনী দেবী মারা যান। কবিগুরু বেশ ভেঙে পড়েছিলেন, নিজের স্বাস্থ্যের দিকে কোন নজরই দিতেন না। সেই সাথে বিশ্বভারতীর চিন্তা তাঁকে মানসিক, শারীরিক ছাড়াও অর্থনৈতিক দিক দিয়েও ভীষণ কাবু করে ফেলেছিল। এক পর্যায়ে তাঁকে শিলাইদহ পাঠানো হয় বিশ্রাম নেবার জন্য।
বাবার পরামর্শে ও মা’র ইচ্ছাতেই ১৯১০ সালে প্রতিমা দেবী কে বিয়ে করেন। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ছোট প্রতিমাকে দেখে তাকে নিজের পুত্রবধূ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু মৃণালিনীর অকালমৃত্যুর ফলে তা সম্ভব হয় নি। এরপর মাত্র ১১ বছর বয়সে প্রতিমার বিয়ে হয় গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটবোন কুমুদিনীর ছোট নাতি নীলানাথের সাথে। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই গঙ্গায় সাঁতার কাটতে গিয়ে জলে ডুবে নীলানাথের মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পাঁচ বছর পরে নিজের ছেলে রথীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে ফিরলে তার সাথে রবীন্দ্রনাথ প্রতিমার আবার বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করেন। তিনি সমাজ সংস্কারকে অগ্রাহ্য করে প্রতিমা এবং রথীন্দ্রনাথের বিয়ে দেন। এই বিয়ে ছিল
রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির প্রথম বিধবা বিবাহ। রথীন্দ্রনাথ এবং প্রতিমা দেবী নিঃসন্তান ছিলেন, তাঁরা একটি কন্যাসন্তান দত্তক নিয়েছিলেন, কন্যার নাম রেখেছিলেন ‘নন্দিনী’। নন্দিনীর জন্ম হয়েছে ১৯২২ সালে।
শান্তিনিকেতনের খরচ চালাবার জন্য রবীন্দ্রনাথ কে বিভিন্ন জায়গা থেকে টাকা ধার করতে হত। একবার তিনি তাঁর স্ত্রীর গহনা ও নিজের সোনার হাত ঘড়ি বিক্রি করলেন এক মহিলার কাছে। আশ্চর্যের বিষয় – রথীন্দ্রনাথ এর বিয়েতে সেই মহিলা সেই সব গহনা উপহার হিসেবে দান করেন।
প্রতিমা দেবী রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর স্বামীর সাথে বিশ্বভারতী এবং শান্তিনিকেতনের নানা কাজে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন। তিনি নানারকমের কারুশিল্প প্রবর্তনে এবং রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্য পরিকল্পনায় সহযোগিতা করতেন। তিনি একজন ভালো চিত্রশিল্পীও ছিলেন। তিনি কিছুদিন ইতালীয় শিক্ষক গিলহার্ডির কাছে ছবি আঁকা শিখেছিলেন।
প্রতিমা দেবীর আসল কৃতিত্ব শান্তিনিকেতনে মেয়েদের নাচ শেখাবার ব্যবস্থা করা। সেসময়ে বাঙালিদের ভিতরে নাচ শেখাবার খুব একটা ব্যবস্থা ছিল না। রবীন্দ্রনাথের বাল্মিকীপ্রতিভা এবং মায়ার খেলায় যৎসামান্য নাচের অংশ ছিল। প্রতিমা দেবী নিজে মঞ্চে উপস্থিত খুব কম হতেন। তাঁর বিয়ের অল্প পরে শান্তিনিকেতনে মেয়েদের প্রথম অভিনয় লক্ষ্মীর পরীক্ষাতে তিনি ক্ষীরির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। এরপর নিজে অভিনয় না করলেও রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যের তিনিই ছিলেন প্রধান উৎসাহী। রবীন্দ্রনাথ নিজেও চিত্রাঙ্গদা বা পরিশোধ নিয়ে নৃত্যনাট্য রচনার পরিকল্পনা করেন নি। কিন্তু প্রতিমা দেবী যখন নৃত্যনাট্যের খসড়া নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে যান তখন তিনি এই নতুন শিল্পরূপ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন।
কবিগুরুর সাথে রথীন্দ্রনাথ প্রতিমা দেবী কখনও নাচ শেখেননি এবং নিজে নৃত্যশিল্পী ছিলেন না। তিনি বর্ষামঙ্গলের দু'একটি নাচে রূপ দেওয়ার পর রবীন্দ্রনাথকে পূজারিণী কবিতার নৃত্যনাট্যরূপ লিখে দেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে মেয়েদের দিয়ে সেটি অভিনয় করাবেন মনস্থ করেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ লিখলেন নটীর পূজা। প্রতিমা দেবী অনেক পরিশ্রমের মাধ্যমে শান্তিনিকেতনের মেয়েদের দিয়ে সেটি অভিনয় করালেন। প্রায় চোদ্দ বছর পরিশ্রমের মাধ্যমে প্রতিমা রাবীন্দ্রিক গীতিনাট্যের স্থায়ী রূপ তৈরি করলেন চিত্রাঙ্গদায়।
এর আগে এসেছিল শাপমোচন। চিত্রাঙ্গদার নাচের বৈশিষ্ট্যগুলি আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল চণ্ডালিকাতে। প্রতিমা অন্তরালে থেকে পোশাক পরিচ্ছদ সাজ প্রভৃতির দিকে নজর রাখতেন। মঞ্চ-সজ্জাতেও তিনি শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন। তিনি শেষের দিকে মঞ্চসজ্জার পরিকল্পনা ছবি এঁকে রাখতেন। তিনি কলাভবনের শিল্পীদের দিয়ে নাচের ভঙ্গি আঁকিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন। রবীন্দ্রনাথ রচিত নাটকগুলির শালীন সৌন্দর্যের দিকে তিনি তীক্ষ্ণ নজর রাখতেন। তিনি মায়ার খেলা নাটকেরও নতুন রূপ দিয়েছিলেন। গল্পগুচ্ছের ক্ষুধিত পাষাণ ও দালিয়া, কথা ও কাহিনীর সামান্য ক্ষতি প্রভৃতি গল্পগুলিকে মূকাভিনয় আকারে রূপায়িত করেছিলেন। এক কথায় এই প্রতিমা দেবীর কারণেই কবিগুরু নৃত্যনাট্য রচনায় আগ্রহী হন।
১৯১২ সালে লন্ডন যান কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ, সাথে ছেলে রথীন্দ্রনাথ। আম কবিগুরুর অত্যন্ত প্রিয় ফল, একথা মনে রেখে রথীন্দ্রনাথ এক ঝুড়ি আম নিয়েছিলেন সাথে। লন্ডন এ পৌঁছে প্রথম পাতাল রেলে চড়েন, বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার তাঁদের মুগ্ধ করেছিল। কিন্তু এই সময়েই কবিগুরুর ‘গীতাঞ্জলী’-র পাণ্ডুলিপি ও তার ইংরেজি সংস্করণ “দা গার্ডেনার” হারিয়ে ফেলেন। পরদিন এর খোঁজ পড়লে বুঝতে পারেন ও দু’টি বই হারিয়ে ফেলেছেন। অবশেষে রেল এর লস্ট-লাগেজ অফিসে ওগুলো খুঁজে পাওয়া যায়।
১৯১৯ সালের ১১ অক্টোবর, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অবকাশ যাপনের জন্য আসামের তৎকালীন রাজধানী শিলং এলেন। তার সফরসঙ্গী হিসেবে আছেন পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও পুত্রবধূ প্রতিমা দেবী। ১৯৩২ সালে কবিগুরুর ইরাক ও ইরান ভ্রমণের সময় রথীন্দ্রনাথ স্ত্রী প্রতিমা কে সঙ্গে নিয়ে যান।
১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার প্রথম উপাচার্য হন। এই চেয়ার তিনি অলংকৃত করে রেখেছিলেন ১৯৫৩ সালের ২২শে আগস্ট পর্যন্ত।
কৃষি ও শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অবদানের সমন্বয় রথীন্দ্রনাথের মত খুবই কম ব্যক্তির মধ্যে দেখা যায়। রথীন্দ্রনাথের শিল্পীমন গঠনের পিছনে তাঁর বাল্য ও কৈশোরের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা, নাটক ও কাব্যচর্চার জমজমাট পরিবেশের অবদান তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় স্বীকার করেছেন — ‘এই বাড়িকে কেন্দ্র করেই ভারতের শিল্প ও সাহিত্য তখন নূতন জন্ম পরিগ্রহ করেছে।’ বিশ্বভারতীর কর্মীমণ্ডলীর এক সভায় নিজের কথা বলতে গিয়ে রথীন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন — ‘জন্মেছি শিল্পীর বংশে, শিক্ষা পেয়েছি বিজ্ঞানের, কাজ করেছি মুচির আর ছুতোরের।’ নিজেকে আজীবন তিনি অকিঞ্চন রূপে বর্ণনা করে গেলেও আমরা জানি তাঁর ‘মুচি’ আর ‘ছুতোরের’ কাজের কি বিপুল মাহাত্ম্য।
রথীন্দ্রনাথের আঁকা ফুল এর ছবি ছবি আঁকিয়ে হিসেবে রথীন্দ্রনাথের প্রথম ও প্রধান কৃতিত্ব ফুলের ছবি। সুশোভন অধিকারী সংকলিত রথীন্দ্রনাথের চিত্র-পঞ্জির তালিকায় দেখা যায় তিনি ৫২টি ছবি এঁকেছেন। জলরং, মোমরং, ক্রেয়ন, পেনসিল, প্যাস্টেল, ওয়াশ ও টেম্পেরা, ভার্নিশের প্রলেপযুক্ত টেম্পেরা, অস্বচ্ছ জলরং ইত্যাদি বিভিন্ন ধরণের মাধ্যমের আশ্রয়ে আঁকা হয়েছে এই ছবিগুলো। তাঁর আঁকা ফুলের ছবি দেখলে তা ছবি বলে মনে হয় না, মনে হয় জীবন্ত সত্ত্বা। ফুলকে তিনি দেখেছেন যত কাছ থেকে ও যত সুন্দরভাবে, তেমনি করে তিনি তাঁর তুলিতে ফুটিয়ে তুলেছেন। দেখে মনে হয় এমন রিয়ালিস্টিক ছবি আদৌ সম্ভব! শিল্পী পিতা রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন তাই তাঁর প্রশংসাসূচক উক্তি — ‘ওর (রথীন্দ্রনাথের) ফুলের ছবিগুলো সত্যি ভাল, এত delicate করে আঁকে। ফুলের ছবিতেই ওর বিশেষত্ব।’
আগের অংশ পরের অংশ
|