রবি ও রথী সিরাজুস সালেকিন
বেড়াতে গিয়ে হোটেলে থাকাটা আমার পছন্দ নয়। তা সে অস্ট্রেলিয়া হোক বা অন্য কোথাও। এবার দেশে গিয়ে সপ্তাহ খানেকের জন্য কলকাতা যাবার একটা ইচ্ছা ছিল। এখান থেকেই ই-ভিসা নিয়ে নিলাম, ঢাকা – কলকাতার টিকিটও কেটে ফেললাম এখান থেকে। সিডনী থেকেই কলকাতায় একটা বাড়ী ভাড়া করলাম এয়ার বিএনবি-র বদৌলতে। সাউথ ক্যালকাটার লেক গার্ডেনস এলাকায়। বেশ বড় বড় দুটা ঘর, লাউঞ্জ, বিশাল বড় বেডরুম, রান্নাঘর সবই আছে। আর সারা ঘর জুড়ে বিভিন্ন শিল্পীর হাতে আঁকা ছবি, ভাস্কর্য। ইন্টারনেট এ ঘরগুলোর ছবি দেখেই বুক করে ফেললাম।
আমাদের হোস্ট এর নাম রত্নোত্তমা সেনগুপ্ত। নামটা একটু অন্যরকম, তাই ঘর বুক করার সময় ওর প্রোফাইলটা পড়লাম। মহিলা একজন লেখক, সাংবাদিক, আর্ট-ক্রিটিক, ভারতীয় চলচ্চিত্রর জুড়ি বোর্ড এর সদস্য। আর তিনি নিজেও তাঁর কাজের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, দা টেলিগ্রাফ, টাইম্স অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার আর্টস এডিটর ছিলেন। ওনার বাবার নাম নবেন্দু ঘোষ, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র স্ক্রিপ্ট রাইটার। সেই সাথে অভিনয়ও করেছেন চলচ্চিত্রে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এর সময় তাঁর রচিত “ডাক দিয়ে যাই” নাটক এর জন্য তাকে চাকরী হারাতে হয়। এ সময় সলিল চৌধুরীর সাথে ও কাজ করেন। ২০০৬ সালে নবেন্দু ঘোষ বঙ্কিম পুরস্কার পান। সব মিলিয়ে প্রগতিশীল একটা পরিবার।
যাই হোক, এরকম একটা পরিবারের সাথে থাকার একটা সুযোগ পেয়ে ভালই লাগল। কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে আমরা লেক গার্ডেন এ রত্নোত্তমা বাসায় পৌঁছলাম বেশ রাতে। উনি কলকাতার বাইরে, অন্য একজন ঘর দেখিয়ে দিলেন। দুদিন পর ওনার সাথে প্রথম দেখা, অনেক গল্প করলাম। ওনার বাবার লেখা একটা বই উপহার দিলেন আমাকে। একপর্যায়ে জানালেন যে আমরা ওনার গাড়ী ভাড়া করতে পারি প্রয়োজন হলে। ভালই হল। বেশ ক’জায়গায় ঘোরাঘুরি করলাম, কলেজ স্ট্রীট এ বই কিনতে গেলাম। দেশে গেলে কলকাতা যাওয়াটা এখন একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আর কলকাতা গেলে বই তো কিনতেই হবে। আর আমার স্ত্রীর বই না হলে চলেনা। মূলত আনন্দ পাবলিশার থেকেই কেজি তিরিশেক বই কিনলাম। আমার তালিকায় দিলিপকুমার রায়, শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আবু সাইয়েদ আইয়ুব, প্রমথনাথ বিশী, রমাপদ চৌধুরী, তপন রায় চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, গোলাম মুর্শিদ, অম্লান দত্ত, প্রমুখ। আর স্ত্রীর তালিকায় সমরেশ মজুমদার, সত্যজিৎ রায়, শীরশেন্দু মুখোপাধ্যায়, আশাপূর্ণা দেবী, বিমল কর, মতি নন্দি, বিমল মিত্র, বুদ্ধদেব গুহ, আরও বেশ কয়েকজন। সেদিনই জিপিও থেকে সব বই প্যাকেট করে পাঠিয়ে দিলাম সিডনীতে।
কলকাতা যাবার আগে থেকেই ঠিক ছিল জোড়াসাঁকো যাব কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বাড়ী দেখতে। রত্নোত্তমা গাড়ী নিয়েই সকাল সকাল রওনা হলাম, অনেক খুঁজে পেতে চিতপুর জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি পৌঁছলাম। আমি এর আগে একবার এসেছিলাম, তবে এবার ঢুকতে গিয়ে মনে হল যে আগের চেয়ে অনেক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখা হয়েছে ঠাকুরবাড়িটা। টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকলাম।
আঠারো শতকে দ্বারকানাথ ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দাদা) নির্মাণ করেন। বাংলার নবজাগরণে এই পরিবারের প্রভাব অত্যন্ত গভীর। রাজা রামমোহন রায় এই জাগরনের সূচনা করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সময়কে নব জাগরণের শেষ হিসেবে ধরা হয়। এই পরিবারের সদস্যেরা অনেকেই বাণিজ্য, সমাজ সংস্কার, ধর্মসংস্কার আন্দোলন, সাহিত্য, শিল্পকলা ও সংগীতের জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। এ পাড়াতেই থাকতেন ‘হুতোম প্যাঁচার নকশার’ কালী প্রসন্ন সিংহ, ভারতবর্ষে জুলিয়াস সিজার নাটক প্রথম অভিনীত হয়েছিল যার বাসায় সেই পিয়ারি মোহন বোস, মাইকেল মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী’ প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল যাঁর উদ্যোগে সেই জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ আরও বেশ কয়েক জন বিখ্যাত মানুষ।
মূল ফটক থেকে ভেতরে ঢোকার রাস্তার ঠিক বাঁদিকে ছিল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এখন বি টি রোডে বিশ্ববিদ্যালয়টি স্থানান্তরিত হয়েছে। ঠাকুরবাড়ির সামনে একটি বড় গাছ দাঁড়িয়ে। তার ছায়ায় আশ্রিত কামিনীসহ নাম না জানা অনেক ফুল আর লতা-পাতার গাছ। মাঝে বিশাল সবুজ চত্বর। সবুজ গাছের ঝোঁপের আড়ালে ঠায় দাঁড়িয়ে বিশাল লাল দালান - জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি । এই বাড়ীতেই কবিগুরু জন্মেছিলেন ১২৬৮ সালের ২৫ বৈশাখ, এই বাড়িতেই কবি তার শৈশবকাল কাটান এবং ৭ আগস্ট, ১৯৪১ সালে এই বাড়ীতেই তাঁর মৃত্যু হয়। শিহরিত হচ্ছিলাম। এ বাড়ীতেই আসতেন যদু ভট্টাচার্য কবিগুরুকে শাস্ত্রীয় সংগীত শেখাতে। তার কাছে শিখেছেন কাফি রাগে “রুমু ঝুমু বড়খে – আজু বাদরওয়া”। অনেক পরে এ গানের সুরেই তিনি লিখেছেন “শূন্য হাতে ফিরি হে – নাথ পথে পথে হে”। মশারির ভেতর শুয়ে শুয়ে শুনতেন কানাড়ার আলাপ। ছোট্ট রবি তানপুরা বাজিয়ে গান শিখছেন। ব্রহ্মসঙ্গীত শিখিয়েছেন বিষ্ণু বাবু। সেজদাদা হেমেন্দ্রানাথ ছোটদের গান শেখানোর দিকে বিশেষ নজর রাখতেন। ঠাকুরবাড়ির বন্ধু শ্রীকণ্ঠবাবুর কাছ থেকে ও গান শিখেছেন এ বাড়ীতে। শ্রীকণ্ঠবাবুর সাথে গেয়ে উঠেছেন “ময় ছোড় ব্রজকী বাঁশরী, বংশী হমারি রে”। বাড়ীর ভেতরের মেয়েরা সকাল থেকে রাশি রাশি পান বানিয়ে রাখত পিতলের গামলায়, আর হুঁকো সাজিয়ে রাখত, তামাকে ছিল গোলাপ জল। বাইরের অতিথিদের এই পান আর তামাক দিয়ে আপ্যায়ন করা হত। হুঁকোবরদার বলে তখন একটা পেশা ছিল। সকাল বেলা সামনের এই বাগানে কানা পালোয়ান আর হীরা সিং এর কাছে কুস্তি শিখতে হত। মাঝে মাঝে মেডিকেল কলেজের এক ছাত্র আসত মানুষের হাড় চেনাবার বিদ্যা শেখানোর জন্য। নীলকমল মাস্টার আসতেন অংক, বিজ্ঞান, আরও কত কি! অঘোর মাস্টার আসতেন ইংরেজি পড়াতে।
এ বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ সংসার পেতেছিলেন মৃণালিনী দেবীর সাথে। এ বাড়ীর সবখানেই কবিগুরু হেঁটেছেন, লিখেছেন, গেয়েছেন, অভিনয় করেছেন। কত সব ঘটনা আর স্মৃতি এই বাড়ীতে। যে অল্প সময় টুকু এই বাড়িতে আমার কেটেছিল, পুরো সময়টাই যেন কোন এক মোহ, কোন এক আবেশে মোহিত হয়ে ছিলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মত অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম এই মহান কবিকে। ডান পাশে বাগান পেরিয়ে সারি সারি ঘর। এখানে আগে বিশ্বভারতীর ক্লাস হত। প্রিন্স দ্বারকানাথের বিলাসবহুল বাড়ির গেটের দু পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুটি মূর্তি। একপাশে রবীন্দ্রনাথের, অন্যপাশে পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের। আরও কত সব স্মৃতি এই বাড়ীকে ঘিরে! সব চোখের সামনে ভেসে উঠলো।
বাঁদিকের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার আগে পায়ের জুতা খুলতে হল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে কানে ভেসে আসল মৃদু শব্দে রবীন্দ্রসঙ্গীত। সুরের এই মূর্ছনা নিয়ে গেল অন্য এক দেশে। এক এক করে কবিগুরুর স্মৃতিময় সব ছবি আর জিনিসপত্র দেখতে শুরু করলাম। শুরুতেই কবিগুরুর খাবার ঘর। এরপর শয়ন কক্ষ। কোনো কোনো ঘরে তাঁর ব্যবহৃত পোশাক, আরাম কেদারা, বইপত্র, বিলেত থেকে আনা নানা জিনিসপত্র। রয়েছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি। একটি ঘরে রয়েছে রবিঠাকুরকে নিজ হাতে লেখা মৃণালিনী দেবীর চিঠি, তার ওপর মৃণালিনী দেবীর একটি বড় ছবি টানানো। এই ঘরেই মৃণালিনী দেবীর শেষ শয্যা পাতা হয়েছিল। সারারাত মৃণালিনী দেবীর মৃত্যুশয্যা পাহারা দেওয়ার পর কবি চলে যেতেন ছাদে। এর সাথের খাবার কক্ষ। পরের ঘরটিতে কবি শুয়ে কাটাতেন জীবনের শেষ সময়টা। ঠিক এর পাশের একটি কক্ষে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। কবির মৃত্যুর মাস খানেক আগে থেকে প্রতিদিনের ঘটনা লেখা ছিল। পড়তে পড়তে চোখে পানি এসে গেল। মনে করার চেষ্টা করছিলাম – কি কষ্টই না পেয়েছেন। প্রস্টেট এর সমস্যায় ভুগছিলেন কবিগুরু।
ডান পাশের লাল বাড়িটির দোতলার চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকতেই রবীন্দ্রনাথের বসার ঘর। এ ঘরে বসেই বাবাকে কবিতা পড়ে শুনিয়েছিলেন ছোট্ট রবি। জ্যোতিদাদার কাছে গান শেখা এ ঘরে বসে – কখনো বা ছাদে। জ্যোতিদাদা ঝম ঝম করে পিয়ানো বাজিয়ে গান করতেন, সুর করতেন – কিশোর রবি তখন তার সাথি। তিনি সুর বাজিয়ে যেতেন – কিশোর রবি সে সুরের ওপর কথা বসিয়ে দিতেন। এভাবেই লেখাটা শুরু কবিগুরুর। কিশোর রবির বউঠাকরুনও (কাদম্বরী দেবী) এসে বসতেন প্রায়ই। জ্যোতিদাদা বেহালায় ধরতেন সুর – কিশোর রবি চড়া গলায় ধরতেন গান। গান শেষে বউঠাকরুন এর প্রশংসা শোনার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতেন কিশোর রবি।
পশ্চিমে একটি বেলজিয়াম আয়নার ড্রেসিং টেবিল। একটি শেলফে এখনো সাজানো আছে রুপার বাক্স, রবীন্দ্রনাথের রুপার গ্লাস এবং কয়েকটি বিলেতি শো’পিস। এগুলো রবীন্দ্রনাথ বিলেত থেকে আসার সময় সঙ্গে করে এনেছিলেন।
সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটু ঘুরে অন্য পাশ দিয়ে অন্য সিঁড়ি বেয়ে যেতে হয় আরেক দালানে। এখানে প্রথম ঘরটিতে রয়েছে কবির ব্যবহৃত পোশাক। একটি বড় আয়না। কবি যতবার পারিবারিক নাটক করেছেন, এই ঘরে এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখেছেন। বারান্দা ঘুরে অন্য ঘরে গেলেই মনটা ভিজে এল। এখানেই কবি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। দেয়ালে টাঙানো কয়েকটি ছবি, যা তাঁর রোগশয্যার চিহ্নমাত্র। এর পেছনের ঘরটিতে পর্দা টেনে কবির শেষ অপারেশন করানো হয়েছিল। ১৯৪১ এর জুলাই এ এ ঘরেই কবি শেষ কবিতা ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি ’-এর ডিক্টেশন দিয়েছিলেন। এর ক’দিন পরই তিনি পাড়ি জমান না ফেরার দেশে।
আরো সামনের ঘরটি কবির লেখার ঘর। গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এখানে এসে মজলিস বসাতেন। কবি থাকতেন মধ্যমণি। অতিথিদের সঙ্গে খোশগল্প করতে কবি খুব পছন্দ করতেন। দেয়ালে টাঙানো স্মৃতিচিহ্ন ছবি শোভা পাচ্ছে। প্রত্যেক ঘরে রয়েছে ঠাকুরবাড়ির ব্যবহৃত সে সময়কার অনেক অনেক স্মৃতি। ঠাকুর পরিবারের ঐতিহ্য ও কয়েক পুরুষের তোলা ছবি; বিশেষ বিশেষ ঘরের ছবি ও ব্যবহৃত তৈজসপত্র। এছাড়া একটি ঘরের দেয়াল জুড়ে বড় বড় ছবি বাঁধানো রয়েছে। এখানে পর্যায়ক্রমে প্রিন্স দ্বারকানাথ থেকে রবীন্দ্রনাথের ছবি পর্যন্ত রয়েছে।
ঠাকুরবাড়ির বড় বারান্দাটা দেখে মনে পড়ল বুড়ো দরজী নেয়ামতের কথা। বারান্দার এক মাথায় বসে বসে চোখে আতশ কাচের চশমা পড়ে সারাদিন সেলাই করে চলেছেন। বারান্দা দিয়ে নীচে তাকালেই ঘোড়া গুলিকে দেখা যেত। চাকররা সকাল বেলা ওদের খাবার দিয়ে যেত। জনি নামের কুকুরটা ঘোরাঘুরি করত ঘোড়াগুলির আশেপাশে। এ বারান্দা দিয়ে বেটে-কালো গোবিন্দ ছোট্ট রবিকে গোসল করতে নিয়ে যেত স্নানঘরে। ওই যে রান্নাঘর, ওখানে বসে প্রতিদিন সকাল সাড়ে নটায় রবি খেতেন ভাত, ডাল আর মাছের ঝোল। সামনের খোলা মাঠ টায় জিমনাস্টটিকস এর প্র্যাকটিস চলত রবির ইচ্ছার বিরুদ্ধে। সব যেন ছবির মত ভেসে উঠল চোখের সামনে।
কবি ও কবিপত্মী মৃণালিনী দেবীর ব্যবহৃত এই ঘরটিতে রয়েছে অনুচ্চ গদিযুক্ত লম্বা পালঙ্ক, বই রাখার তাক ও বেতের চেয়ার। রয়েছে বেশ কয়েকটি ছবি। তার মধ্যে একটি গুরুদেবের শান্তিনিকেতনে ক্লাস নেওয়ার ছবি। সামনের বারান্দায় একটি বিশেষ টেবিলে কাচে ঘেরা রয়েছে একটি ট্রেনের রেপ্লিকা। শান্তিনিকেতন থেকে শেষ যে ট্রেনে করে কবি জোড়াসাঁকো এসেছিলেন, সে ট্রেনটির একটি রেপ্লিকা তৈরি করে ইন্ডিয়ান রেলওয়ে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে উপহার দিয়েছে।
জানা যায়, জাপানি নামীদামী ব্যক্তিদের উপস্থিতি উপলক্ষে ঠাকুরবাড়িতে প্রথম চা খাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সে উপলক্ষে বিশেষ আকৃতির চায়ের সরঞ্জাম তৈরি করা হয়েছিল। কাঠের চুলার পরিবর্তে দোতলাতেই কয়লার চুল্লির বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সে স্মৃতি ধরে রাখতে এখনো সেখানে কৃত্রিম কয়লার আগুন, কেতলি ও কাঠের তৈরি চামচ আর কয়েকটি মগ রাখা আছে। যে বিছানায় বসে তারা সময় কাটিয়েছিলেন সেটি সংরক্ষিত করা হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থায়। কবির সাথে তোলা সেই বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি এখনো সে বিছানায় শোভা পাচ্ছে।
এই ঘরে তখন বাজছিল “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ সুরের বাঁধনে”। এ যেন আমারই মনের কথা কবির গানে ধ্বনিত হচ্ছিল। ভাবছিলাম এই সেই মানুষ – কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ – যিনি বাঙালিকে বদলে দিয়েছেন, আমাকেও বদলে দিয়েছেন। এই যে এখনকার আমি – তা অনেকটা এই কবিগুরুর কারণেই। তাঁকে ভালবেসেই তাঁর গান গাই, তাঁর গান ও বাণী অন্যের কাছে পৌছিয়ে দেই –প্রবাসী জীবনের সার্থকতা খুঁজে পাই। ধন্য মানি নিজেকে।
পুরো বাড়িটার আয়তন ও কক্ষ দেখে অনায়াসে অনুমান করা যায় এ বাড়িতে প্রায় শ খানেক লোকের বসবাস ছিল। বাড়ির ছাদগুলো এমনভাবে করা যেন দোতলার মানুষও ছাদের স্বাদ পান। ‘রাজা ও রাণী’ নাটকের মঞ্চায়নও হয়েছে এই ছাদে। এ ছাদ ঘিরে বাংলা সাহিত্যে অনেক কথা অনেক গল্পের জন্ম হয়েছে।
সিঁড়ি বেয়ে তিনতলায় উঠলে চোখে পড়বে একটি কক্ষ। খুব বড় নয়। এখানে প্রিন্স দ্বারকানাথের ছবি বাঁধানো আছে। এছাড়া আছে কিছু বইপত্র ও শাস্ত্রীয় বই। এ ঘরটিতে কবিমাতা সারদা দেবী তাসের আসর জমাতেন সখীদের সাথে। কখনো কখনো দাসীদের সাহায্যে শরীরের ব্যায়াম করাতেন।
এ ঘরটির ভেতর দিয়ে একটি দরজা রয়েছে। তার ওপারে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের কক্ষ। রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেবেলা’য় পাওয়া যায়, তিনতলায় বাবার ঘরে ঢুকে তিনি দরজা বন্ধ করে সময় কাটাতেন। এখানে দেবেন্দ্রনাথের কক্ষে এখনো শোভা পাচ্ছে কুচকুচে কালো একটি মজবুত খাট। খুব জমকালো না হলেও দেখলে মনে হয় আভিজাত্যের ছোঁয়া আছে। পাশে শেলফে রাখা আছে জমিদারির কিছু নথিপত্র, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। এছাড়া শাস্ত্রীয় বই রাখা আছে। আছে দুটি বিশেষ ধরনের জলচৌকি। একটিতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বসতেন, অন্যটি সামনে থাকত। এখানে বসেই তিনি উপাসনা করতেন। কখনো কখনো শাস্ত্রপাঠ করতেন।
পরের অংশ
|