তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম মীর সাদেক হোসেন
পোস্টের ক্যাপশন “ষোল বছরের যুগল বন্দী” সাথে স্বামী-স্ত্রীর একটা হাস্যোজ্জ্বল ছবি। এই ধরণের উষ্ণ প্রেমের ছবি অনীকের ভাল লাগে না। আজো তাই। বির বির করে বলল, মিলন ভাই কোথায় কোথায় নাচ দেখে বেড়ায় তা যদি জানত ভাবী, তাহলে পোস্টের ক্যাপশনটা কেমন হতো? না জেনে ভালোই আছে বেচারি। নাকি নিজের ভয়টাকে আড়াল করতে সব সময় সুখের অভিনয়, কে জানে? ফেইসবুকের নিউজ ফিড স্ক্রল করতে লাগল অনীক।
স্ক্রল করতে করতে একটা পোস্টে এসে একটু থামল। আঠেরো বছর সংসারের পর বিচ্ছেদ, তা নিয়ে পোস্ট। আহা কি দুঃখজনক পরিস্থিতি। পোস্টের একটা কমেন্ট দেখে অনীক মনে মনে হেসে উঠল। পোস্ট পড়ে যত না দুঃখবোধ হচ্ছিল, কমেন্ট পড়ে তার চেয়ে বেশী মজাই পেল। পোস্টের শুরুতেই আঠেরো বছর লেখা দেখেই একজন কমেন্টে লিখেছে, “অভিনন্দন”। ঘটনা কি তা বোঝার জন্য হয়তো পুরো পোস্টটা পড়েই নাই। না পড়েই কমেন্ট। বিবাহ বার্ষিকী ভেবেছে। পোস্টের রচয়িতার পাল্টা কমেন্ট, “পুরো পোস্টটা পড়েন, তারপর কমেন্ট করেন প্লিজ”। গাধার বাচ্চা, কমেন্টকারীকে মনে মনে গালি দিল অনীক। মানুষের ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স এতো কম হয় কি করে, বির বির করতে করতে আবার নিউজ ফিড স্ক্রল করতে লাগল অনীক।
এবারে চোখ আটকালো পুরাতন এক বান্ধবী, জেস, মানে জেসমিনের ছবিতে। পোস্টের ক্যাপশন “আমার আমি”। কলেজ লাইফে ফেইসবুক ছিল না তবে ক্লাসের কিছু জ্ঞানপাপী বাদে বাকী সব ছেলেই জেসমিনের ফলোয়ার ছিল। প্রায় বছর বিশেক আগের কথা। মনে পড়লে অনীকের এখন হাসি পায়। কলেজের পর জেসমিনের সাথে আর যোগাযোগ ছিল না অনীকের। ফেইসবুকের কারসাজিতে আবার বন্ধু। অন্যদের কাছে শুনেছিল, এর মধ্যেই নাকি জেসের দু’বার ডিভোর্স দেওয়া-নেওয়া হয়ে গেছে। এখন নাকি তৃতীয়বারের মতো ডিভোর্সের কথা চলছে। অনীক মনে মনে বলল, ভাগ্যিস আমি তোমার না, তাহলে হয়তো ডিভোর্সের দড়ি ঝুলত আমার গলাতেও ।
অনেকক্ষণ নিউজ ফিড স্ক্রল করে তেমন কৌতূহলোদ্দীপক কিছু পেল না। হাল ছেড়েই দিয়েছিল। ঠিক তখনি শ্যালিকা ষোড়শীর হাসিমাখা ছবি দেখে আবার যেন পালে হাওয়া লাগল। অনীকের মনে হলে ষোড়শী যেন হঠাৎ করে কিশোরী থেকে তরুণী হয়ে গেছে। সেই শিশু শিশু ভাবটি আর নেই। সেই স্থানটা দখল করে নিয়েছে আত্মবিশ্বাসে ভরা এক নারী। সাগর পাড়ে ভিড়ানো নৌকায় ষোড়শী চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছে। নীল সাগর, নীল আকাশের মাঝখানে, দেশী শ্যালিকাকে পুরো বিদেশি লাগছে অনীকের। এমন সুন্দর একটা ছবিতে লাইক না দিলে মহা পাপ হবে। লাইক দিতে যেয়ে অনীকের মনে হল এমন একটা ছবিতে লাইক ইমো কম হয়ে যায়, এ ছবিতে লাভ ইমো দেয়া উচিত। ইমো দিয়ে ক্ষান্ত হল না অনীক। কমেন্টে লিখল, ও গো বিদেশিনী, তোমার চেরি ফুল দাও, আমার শিউলি নাও, দুজনে প্রেমে হই ঋণী। শেষ লাইনটা লিখে মনটা খচ খচ করে উঠল অনীকের। হাজার হলেও বউয়ের বোন বলে কথা, কি আবার ভাবে, তাই শেষ লাইনটা ডিলিট করে বাকীটা পাঠিয়ে দিল শ্যালিকার উদ্দেশ্যে।
অনীকের মনে হল লাভ ইমো আর কমেন্ট জীবনের বিস্বাদ এক তুরিতে অনেকটাই নাই করে দিয়েছে। এর মানে কি পজিটিভিটি আরো পজিটিভিটির জন্ম দেয়, ভাবে অনীক?
টিং করে স্মার্টফোন বেজে উঠে। ধ্যান ভাঙ্গে। ফেইসবুক নোটিফিকেশন খুলে দেখে ষোড়শীর মেসেজ। ভাবে এরই নাম হয়তো, মেঘ না চাইতেই জল। ষোড়শী লিখেছে, দিন, অপেক্ষায় রইলাম। সাথে লাভ ইমো।
চোখ বুজে পজিটিভিটির স্বাদ আস্বাদনের চেষ্টা করে অনীক। টিং করে আবার বেজে উঠে স্মার্টফোনটা। একগাদা আকর্ষণ সাথে কিছুটা অনিশ্চয়তা। অনীক এর কোন কারণ ভেবে পেল না। মেসেজটা দেখার জন্য তাড়াতাড়ি স্মার্টফোনের দিকে তাকালো।
শ্যালিকার বড় বোনের মেসেজ। লেখা, ফ্রিজে দুধ নেই, নিয়ে এসো।
আশাহত অনীক উঠে দাঁড়াল। ভদ্র ছেলের মতো দুধ আনতে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার অভিশাপ নিয়ে তর্ক করতে ব্যস্ত অনেকেই, অনীকের কাছে সোশ্যাল মিডিয়াটা যেন আশীর্বাদ। বাস্তবে যা সম্ভব না, সোশ্যাল মিডিয়ার বদান্যতায় সেটাই সম্ভব। সেদিনের পর থেকে শ্যালিকার সাথে নিয়মিত ডিজিটাল আদান-প্রদান তারই প্রমাণ।
আপনাকে একটা কথা বলতে চাই। সিক্রেট। একটু দেখা করতাম, ডিজিটাল বার্তা পাঠায় ষোড়শী। নতুন করে সজীবতা ফিরে পায় অনীক।
কোথায়, কখন? পাল্টা মেসেজ দিল অনীক।
হট বাইটে, আজ বিকেল চারটায়, কনফার্ম করল ষোড়শী।
ষোড়শীর বেঁধে দেওয়া সময়ের আগেই পৌঁছে গেল অনীক।
ষোড়শীও পৌঁছে গেল অল্পক্ষণের মধ্যে। ভাড়া মিটিয়ে নামল উবার থেকে।
ষোড়শীকে দেখে অনীকের মনে হল আজ নীল দিবস। পরনে নীল শাড়ি, নীল ব্লাউজ, নীল চুড়ি, কপালে নীল টিপ এমন কি পায়ের স্যান্ডেলটাও নীল। কি সুন্দরই না লাগছে মেয়েটাকে!
অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে গেল অনীকের। ষোড়শীর বড় বোন, পড়শিও এরকম সাজগোজ করত। তখন ভালই লাগত। বিয়ের পর আস্তে আস্তে কেমন যেন সব পাল্টে গেল। কিচেনের কিছু ফুরিয়ে গেলেই এখন শুধু কথা হয়। অন্য সময় শুধু নীরবতা। অনীক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।
সৌজন্য সাক্ষাতের পর সিক্রেট শোনার আশায় সামনে ঝুঁকে কণ্ঠস্বর নামিয়ে অনীক বলল, তুমি কি যেন বলবে বলছিলে?
আনন্দ! ঐ তো এসে পড়েছে, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল ষোড়শী।
আনন্দ কে? বলল অনীক।
বলতে বলতেই পঁচিশ-ছাব্বিশের বছরের একটি ছেলে ওদের টেবিলের কাছে এল।
ওর নাম আনন্দ। আমার বয়ফ্রেন্ড। ওর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্যই আপনার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলাম।
অনীক একটা ধাক্কা খেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিল ।
ষোড়শী প্রায়ই আপনার কথা বলে। আমাদের সময় দেবার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, আনন্দ বলল।
না, না ধন্যবাদ দিতে হবে না, আবেগ সামলে কথাগুলো বলল অনীক।
ষোড়শী আর আনন্দের কাছ থেকে বিদায় অনীক গাড়ি স্টার্ট দিতেই ইঞ্জিনের সাথে গাড়ির রেডিও বেজে উঠল।
ছোট্ট একটা বিজ্ঞাপন বিরতি নিয়ে আবার হাজির হলাম আমি আরজে অভিজিৎ সিনহা, রেডিও গানবাক্সের সাথে থাকার জন্য আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ।
প্রেম ব্যাপারটাই বড্ড ঘোলাটে, তাই না? কখন যে কোথা থেকে প্রেম এসে ছুঁয়ে দিয়ে যায়, বোঝা মুশকিল। অনেকে সামলাতে না পেরে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। পালিয়ে কিন্তু বাঁচা যায় না, একদম না।
বন্ধুরা স্বীকার করুন আর নাই করুন, প্রেম ছাড়া কিন্তু জীবন একদম পানসে। তেল ছাড়া গাড়ি চলে না, প্রেম ছাড়া জীবন চলে না। যার রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস যাই হোক না কেন, প্রেম কিন্তু থাকতেই হবে। তাই হাল ছাড়বেন না বন্ধুরা।
অনেক কথা হল, এবার একটা কঠিন প্রেমের গান হয়ে যাক। গানের শিল্পী আমাদের অতি প্রিয় শহুরে বাউল, জেমস।
গানটি শেষ হলেই আমাদের হট লাইনে কল করে জানিয়ে দিন গানের সুরকার আর গানটি কোন সিনেমার? সঠিক উত্তরদাতার জন্য আছে সিনেমেকারের পক্ষ থেকে মুভি শো-এর ফ্রি টিকিট এবং পপকর্ন।
আরজে অভিজিৎ সিনহা কথা শেষ হতেই জেমস এর কণ্ঠ শোনা গেল।
তোর প্রেমেতে অন্ধ হলাম, কি দোষ দিবি তাতে... বন্ধু তোরে খুঁজে বেড়াই, সকাল দুপুর রাতে...
মীর সাদেক হোসেন, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|