চন্দ্রালোকে চন্দ্রাহত আহমেদ সাবের
-১- নিশীথে যাইওনা ফুল বনে রে ভোমরা, নিশীথে যাইওনা ফুল বনে। নিষেধ ছিলো। নিশীথে ফুল বনে যাবার নিষেধ ছিলো। তবু ছেলেটা গিয়েছিলো। আর যায়গাটায় ফুল বনও নয়; তবুও। সেদিন ছিলো ভরা পূর্ণিমার রাত। চাঁদ প্রায় মধ্য গগনে। এই শহরের এক প্রান্তে নতুন করে গজিয়ে উঠা হাউজিং এস্টেটের প্রান্তে কেউ ওকে টেনে নিয়ে যায় চুম্বকের মতো। এই মহল্লার কিছুই সে চিনেনা। শুধু এই বাড়ীটা ছাড়া। একবার ঘটনা চক্রে ওকে এখানে আসতে হয়েছিলো। ওদের ক্লাসের বার্ষিক বনভোজন ছিলো সেদিন। বাস রাজেন্দ্রপুর থেকে ফিরতে রাত হয়ে যায়। মিরপুর দশ নম্বরের গোল চক্কর থেকে মনুষ্য নামের কিছু শ্বাপদ সঙ্কুল এ মহল্লা আসার পথটুকু ক্লাসের একটা মেয়েকে এগিয়ে দিতে ওকে আসতে হয়। মেয়েটার একা যেতে ভয় করছিলো। বাসার কাছাকাছি এসে রিক্সা থেকে ওকে নামিয়ে দিয়ে বলেছিলো, ওই যে আমাদের বাসা। পাঁচ তলায় আমরা থাকি। বাকী রাস্তাটা আমি একা যেতে পারবো।
সে রাতে মেয়েটার শরীরের ঘ্রাণ অনেক রাত পর্যন্ত ওকে জাগিয়ে রাখে। তারপর কতগুলো পূর্ণিমা গেলো অমাবস্যার মরু পেরিয়ে। সে মেয়েটা ওকে স্বপ্ন দেখালো নদীর অপর পারের। কিন্তু ছেলেটার কাছে পারানির কড়ি ছিলোনা বলে সে আর ওপারে যেতে পারলো না। তীরে বসে থাকলো অপেক্ষায়। যদি কোনদিন, হ্যাঁ, যদি কোনদিন দৈববলে মিলে যায় পারানির কড়ি। ওর উপর লক্ষ্মীর দয়া না থাকলেও সরস্বতীর কৃপা ছিলো অকৃপণ। তাই তার আশা ছিলো, সরস্বতীর বরে একদিন হয়তো সে পৌঁছে যাবে ওর অভীষ্টে। আর মেয়েটাও ওকে বলেছিলো অপেক্ষা করতে।
মেয়েটা ওকে অনেক স্বপ্নের কথা বললেও ওদের বাসায় যেতে বলেনি কোনদিন। কারণ ওদের পরিবার ছিলো দারুণ রক্ষণশীল। তবে আশা দিয়েছিলো, একদিন, হ্যাঁ অবশ্যই একদিন ছেলেটাকে নিয়ে ওদের বাসায় যাবেই। ছেলেটা সে বিশ্বাসে আস্থা রেখে নিজের স্বপ্নকে জিইয়ে রাখে ফুলের চারার মতো। এ দেশের লক্ষ লক্ষ তরুণের মতো জীবনের ঘাটে ঘাটে ঠোক্কর খেতে খেতে, জীবন পরিণত রুক্ষ নুড়িতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষার তকমা আঁটা কপালে। ফলাফলের সোনার মেডেলের চাবিতেও খোলেনা চাকুরীর দরজা। বাড়ী বাড়ী গিয়ে ছাত্র পড়ানো জঠর জ্বালা নিবারণের উপায়। সেই পুরনো চলচ্চিত্রের রিমেক। গতানুগতিক কাহিনী।
দালানটার সামনে এসে একটা চক্কর দেয় ছেলেটা। পাঁচ তলার দুটো জানালায় আলো জ্বলছে। গেটে উর্দি পরা দারোয়ান কথা বলছে একটা লোকের সাথে। ছেলেটা সামনে এসে গতি শ্লথ করে খানিকটা। কি চান? দারোয়ানের প্রশ্ন। কিছুতো চাই। কিন্তু কি করে সেটা প্রকাশ করে দারোয়ানের কাছে? না, না, কিছুনা। দারোয়ানের প্রশ্নকে এড়িয়ে যায় সে। তা হইলে এত রাইতে কি করেন এখানে? সরেন, সরেন গেইটের সামনে থেইকা। দারোয়ানের ধমকে দালানটার সামনে থেকে সরে আসতে হয়।
একটু বসার যায়গা দরকার। মাসের শেষ বলে অনেকটা পথ ওকে হেটে আসতে হয়েছে। পা দুটো ক্লান্ত। এদিক ওদিক তাকিয়ে ডোবার ধারে লম্বা বাঁশের স্তূপটার উপর চোখ পড়ে তার। এক পা, দু পা করে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে বসে পড়ে এক কোনে। বিশাল মরুতে একটা মরূদ্যানের সন্ধান পেয়েছে ছেলেটা। আকাশ বালিকাকে সেই সংবাদটা দিতে ফার্মগেট থেকে তার ছুটে আসা। হয়তো ওর নিজের মেস থেকে মোবাইলে বলা যেতো। কিন্তু ছেলেটার ইচ্ছে হলো কাছে এসে বলা; যতো কাছে আসা যায়। সামনা-সামনি নাইবা হলো। আকাশের কাছাকাছি বাড়ীতে তার প্রবেশাধিকার নাই। তবু, সে যদি জানালায় এসে দাঁড়ায়, ফ্রেমে ওর ছবিটাতো দেখা যাবে অন্তত:।
পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে সে। সাথে সাথে কোথা থেকে মাটি ফুঁড়ে উদয় হয় দুজন নেশাগ্রস্থ যুবক। ওরা বোধ হয় এমন একটা ক্ষণের অপেক্ষায় ছিলো। ওদের একটা মোবাইল ফোনের দরকার। গতকাল প্রতিপক্ষ দলের একটা ছেলেকে ওরা কব্জা করেছে। সংবাদটা নিজেদের ফোন থেকে দেয়া নিরাপদ নয়। ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে, ওর ফার্মগেট থেকে এখানে আসার কোন যৌক্তিক কারণ খুঁজে পায়না ওরা। নিজেদের মধ্যে আলাপ করে ওরা সিদ্ধান্তে পৌঁছে, ছেলেটা বিপক্ষ দলের চর। সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ওকে এখানে পাঠানো হয়েছে। ছেলেটার কাছে মোবাইল চায় ওরা। ছেলেটা বললো, এখন দেয়া যাবেনা। আপত্তি ওদের ক্রোধের আগুনকে উস্কে দেয়। বারুদ একটা দেয়াশলাই এর কাঠির অপেক্ষায় ছিলো মাত্র।
-২- একটু আগে ফজরের নামাজের আজান হয়ে গেছে। এখানে ওখানে আয়তকার ক্ষেত্র আলোকময় হয়ে ফুটে দালানের ক্যানভাসে। ছেলেটা কি ঘুমিয়ে পড়েছিলো না জেগেই ছিলো? প্রায় অর্ধ রাতের রক্তক্ষরণে কষ্ট উপলব্ধির সব বোধ লুপ্তপ্রায়। ডোবার কচুরিপানার শয্যায় শুয়ে সে কাঙ্ক্ষিত জানালায় চোখ রাখে। কিন্তু বেশীক্ষণ চোখ খুলে রাখতে পারেনা। সে মেয়েটার কথা ভাবে। ওর মায়ের কথা মনে পড়ে; ভাই-বোনের কথা মনে পড়ে। সে মা, মাগো বলে কাতরে উঠে।
একজন মসজিদ গামী পরহেজগার মানুষের প্রথম চোখ পড়ে ছেলেটার উপর। এদিকে মসজিদে নামাজের আকামত দেয়া হচ্ছে। তিনি নামাজে শরিক হবার জন্যে ছুটে যান। নামাজ শেষে তিনি দু-চার জন মুসুল্লিকে ঘটনাটার কথা বলেন। কেউ গা করেনা। এদিকে ইমাম সাহেবের নামাজ পরবর্তী বয়ান শুরু হয়ে গেছে। সবাই তাতে শরীক হয়ে যান।
ছেলেটাকে এর পর দেখেন দু'জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। তারা দুজন একই বিল্ডিং 'এ থাকেন। রোজ ভোরে প্রাতঃভ্রমণে বের হন এক সাথে। যাবার পথে ছেলেটাকে দেখে তারা সাম্প্রতিক অশান্ত বিশ্ব নিয়ে নিজেদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তাদের একজন, যিনি সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সামাজিক অবক্ষয়ের উপর লেখা তার সাম্প্রতিক গবেষণা প্রবন্ধের উল্লেখ করেন। অপরজন, যিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক, তিনি ব্যাপারটাকে সামাজিক অবক্ষয়ের বদলে রাষ্ট্র-যন্ত্রের ধ্বস বলে ইঙ্গিত দেন। এ নিয়ে দু'জনের প্রচণ্ড তর্ক বেঁধে যায়।
এদিকে কী করে সংবাদটা থানায় পৌঁছে যায়। এমনকি কারা এই ঘটনার হোতা, তাও। যেহেতু খুনিরা বেশ প্রভাবশালী, 'এ ব্যাপারে থানার কিছুই করার থাকেনা। ভারপ্রাপ্ত অফিসার ওদের ফোন করে তার এলাকায় ঘটনাটা ঘটানোর জন্য মৃদু ভৎসনা করেন। ওরা জানায় ওদের শিকার প্রতিপক্ষ দলের পাণ্ডা। আত্মরক্ষার তাগিদে ওরা কাজটি করেছে। সুতরাং ভারপ্রাপ্ত অফিসার যেন এ ব্যাপারে নাক না গলান । বাড়াবাড়ি করলে তার নিজেরই বিপদ ঘটতে পারে।
আস্তে আস্তে দু-চারজন মানুষ জমতে থাকে ছেলেটাকে ঘিরে। একজন সাংবাদিক কেমন করে সংবাদ পেয়ে যান, বিরোধীদলের গুণ্ডারা সরকারী দলের একজন ছেলেকে আহত করে ডোবায় ফেলে গেছে। তিনি সাথে সাথেই ঘটনাস্থলে হাজির হন। ক্রাইম রিপোর্টার হিসাবে তার বেশ সুনাম আছে। তিনি ছেলেটার কাছে এসে ওর মুখের কাছে কান লাগিয়ে ছেলেটা কি বলছে তা শুনার চেষ্টা করেন। ছেলেটার ঠোঁট নড়া দেখে তিনি উৎসাহিত হন। আরেকটু জোরে বলুন। আমি বুঝতে পারছিনা, আপনি কি বলছেন। আরেকটু জোরে বলুন। কারা আপনাকে মেরেছে? আপনি কি তাদের চিনতে পেরেছেন? সাংবাদিক থাকতে আপনার ভয় নেই। তিনি চিৎকার করে বলতে থাকেন।
প্রায় সাথে সাথেই একজন চিত্রশিল্পী হাজির হন ঘটনাস্থলে। তিনি এলাকার বাসিন্দা। পৃথিবীর নানা দেশে তার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। ভোরের আলো একটু একটু করে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। কচুরিপানার সবুজ পটভূমিতে দু-পাশে হাত ছড়ানো একটা মৃতপ্রায় মানব সন্তান। বুকের কাছে কালচে-লাল রঙের জমাট বাধা রক্ত। আহা! যেনো ক্রুশবিদ্ধ বাংলার যিশু। আহ! আহ! কি অসাধারণ একটা চিত্র! তিনি দ্রুত হাতে স্কেচ করতে থাকেন।
কর্মস্থলে যাবার পথে ছোট্ট জটলাটা দেখেন একজন কাজের বুয়া। তার দাঁড়ানোর সময় নাই। আজ শুক্রবার। সকাল বেলা চারটে বাসায় যেতে হবে। সারা সপ্তাহর সব কাজ জমে থাকে আজকের জন্যে। বেগম সাহেবরা কথার ছুরি শান দিয়ে বসে থাকেন। দেরী হলেই মুখে আতশবাজি ফুটতে থাকে। এক ঝলক উঁকি মারতে গিয়েই আটকে যান বৃদ্ধা। আহারে! কি মায়াকাড়া মুখ। আহারে! অদৃশ্য আকর্ষণ ছেলেটার কাছে টেনে আনে তাকে। ওর মুখের কাছে কান নিতেই মনে হয় ছেলেটা পানি চাচ্ছে। আহারে!
এদিকে কাজে বাধা পড়াতে ধমক দিয়ে উঠেন চিত্রশিল্পী। সাথে যোগ দেন অনুসন্ধানী ক্রাইম রিপোর্টার। কোথাকার উটকো ঝামেলা তাদের কাজে অনর্থক বাধার সৃষ্টি করছে। বৃদ্ধা সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে থাকেন, জান আছে। পোলাডার জান আছে। আপনেরা একটু হাসপাতালে খবর দেন, একটু এম্বুলেন্সে খবর দেন। ভাইরা, বাবারা, আপনাগো হাতে ধরি, পায়ে পড়ি। বৃদ্ধা চিত্রশিল্পীর হাত ধরতে যান, সাংবাদিকের পায়ে পড়তে যান। পোলাডারে বাঁচান। পোলাডারে বাঁচান। তারা বিরক্ত হয়ে যুগপৎ চিৎকার করে উঠেন, চুপ মাতারী, যা ভাগ।
সেই বৃদ্ধা পানির জন্যে এ দালান, সে দালান ছুটাছুটি করতে থাকেন, কেউ দরজা খুলেনা। এই হৃদয়হীন শহরে কোন গৃহ থেকে সামান্যতম করুনাধারা বর্ষিত হয়না। একটা চায়ের দোকান সবে মাত্র খুলেছে। তিনি সেখানে গিয়ে পানি চান। দোকানীর দয়া হয়। বৃদ্ধা একটা মগে করে পানি নিয়ে ছুটে যান ছেলেটার কাছে। ওর প্রানপাখী যেন পানিটুকুর জন্যেই অপেক্ষা করছিলো। মুখে পানি দিতেই মাথাটা এক দিকে কাত হয়ে ঠোঁটের কষ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।
এবং মেয়েটা? ছুটির দিনে একটু দেরী করে উঠে সে। ফজরের নামাজের পরে আরেক প্রস্থ ঘুম দেয়। আজ কেন জানি ওর ঘুম আসছিলো না। কয়েকদিন ধরে ছেলেটা বলছিলো, নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দু'একদিনের মধ্যে ওর স্কলারশিপের খবরটা আসার কথা। খবরটা এলেই ওকে নিয়ে মা-বাবার মুখোমুখী হবে সে। ছেলেটা প্রায় প্রতি রাতে ফোন করে। গতকাল কেন করলোনা? প্রশ্নটা একটা কাঁটার মতো ওর বুকে সূঁই ফোটাতে থাকে।
সিডনী, এপ্রিল ১৭, ২০১৪
আহমেদ সাবের, সিডনি
|