পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পুস্তক আহমেদ সাবের
গিনিজ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডএর তথ্য মোতাবেক, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পুস্তক হচ্ছে This the Prophet Mohamed (দিস দ্য প্রফেট মোহাম্মদ)। পাঁচ মিটার প্রস্থ এবং ৮.০৬ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪২৯ পৃষ্ঠা সম্বলিত বইটি ২০১২ খৃষ্টাব্দে প্রকাশ করেছে দুবাই এর মাসেদ ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপ। বইটির ওজন প্রায় ১৫০০ কিলোগ্রাম। তবে আমি যে বইটার কথা বলবো, সেটা কাগজে প্রকাশিত নয়, পাথরে খোদাই করা। আমার সাম্প্রতিক মায়ানমার ভ্রমণকালে বইটা সচক্ষে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো। সময়টা ছিলো রাজা মিন্দন মিন এর যুগ। তিনি ১৮৫২ থেকে ১৮৭৮ পর্যন্ত উত্তর বার্মায় রাজত্ব করেন। তখনকার বার্মার বিভিন্ন রাজার মতো রাজা মিন্দনও ছিলেন প্রচণ্ড ধর্মপরায়ণ। তার শাসনকালের চারটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে
১) বার্মার রাজধানী অমরাপুরা শহর থেকে মান্দালয়ে স্থানান্তর এবং সেখানে নতুন রাজপ্রাসাদ নির্মাণ। ২) মান্দালয়ে কুথোদাও প্যাগোডা নির্মাণ এবং পুরো ত্রিপিটক প্রস্তরে খোদাই-করন। ৩) শ্রী লঙ্কায় অনুষ্ঠিত চতুর্থ মহাসভার ১৮০০ বছর পর মান্দালয়ে বৌদ্ধদের পঞ্চম মহাসভার আয়োজন। ৪) ত্রিপিটকের পালি ভাষায় অনুবাদ।
রাজা মিন্দন মিন
তার শাসনকালে তিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য যে সব প্রকল্প হাতে নেন, তার মধ্যে অন্যতম উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৮৫৯ সালে মান্দালয় পাহাড়ের পাদদেশে কুথোদাও প্যাগোডা (Kuthodaw Pagoda) নির্মাণ। একই সময়, বৌদ্ধদের মহা পবিত্র গ্রন্থ ত্রিপিটককে বিকৃতি থেকে রক্ষা করার জন্য তিনি ত্রিপিটকের বার্মিজ ভাষ্যকে পাথরে খোদাই করার এক বিরাট প্রকল্প হাতে নেন। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে সৃষ্টি হয় পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পুস্তক।
এবার মায়ানমার ভ্রমণকালে, বিভিন্ন শহরের সাথে মান্দালয়ও গিয়েছিলাম। স্থানীয় লোকেরা মান্দালয় শহরকে বলে, মান্দালে। সেখানকার অনেক দর্শনীয় স্থানের একটা ছিলো কুথোদাও প্যাগোডা। সাথেই লাগানো ১৩ একর জমির উপর স্থাপিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পুস্তক। দুই হাজার তের সালে এই পুস্তককে ইউনেস্কো সমগ্র বিশ্বের একটা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারই সাক্ষ্য মিলে প্যাগোডার প্রবেশ পথে।
ইউনেস্কোর স্বীকৃতি
প্যাগোডার সীমানায় ঢুকে একটুখানি যাবার পরেই ডান পাশে অসংখ্য সাদা রঙ এর ছোট ছোট মন্দির চোখে পড়বে। প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। পরে একটা প্রস্তর ফলক দেখে জিনিষটা বোধগম্য হলো। সেখানে লেখা তথ্যের অনুবাদ নীচে দেওয়া হলো।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পুস্তকের সামনে পুস্তক সম্পর্কিত তথ্য। পেছনে কুথোদাও প্যাগোডার চুড়া দেখা যাচ্ছে।
১) রাজা মিন্দন ১৮৫৯ সালে এই প্যাগোডা নির্মাণ করেন। এটার উচ্চতা ১৮৭ ফুট ৯ ইঞ্চি।
২) ৭২৯ টা মার্বেল পাথর স্ল্যাবের উপর বৌদ্ধদের কেনন (ত্রিপিটক গ্রন্থের) খোদন কাজ ১৮৬০ সালে শুরু হয়ে ১৮৬৮ সালে শেষ হয়।
৩) ৭২৯ টা সাদা মার্বেল স্ল্যাবের (ত্রিপিটক গ্রন্থের) সূচীপত্র নিম্নে প্রদত্ত হলো (ক) সুত্তা পিতাকা (সত্য বিষয়ক প্রবন্ধ) র তিনটা বই ৪১০ টা মার্বেল স্ল্যাবের উপর (খ) বিনয়া পিতাকা (আচরণ বিধি) র পাঁচটা বই ১১১ টা মার্বেল স্ল্যাবের উপর (গ) আভিধর্ম পিতাকা (ধর্মের বিশ্লেষণ) র সাতটা বই - ২০৮ টা মার্বেল স্ল্যাবের উপর (ঘ) সকল মার্বেল স্ল্যাবের খোদন কর্মের ইতিহাস - ১ টা মার্বেল স্ল্যাবের উপর
৪) প্যাগোডার তিনটা এলাকায় ১৩ একর জমিতে উপস্থাপিত প্রতিটা মার্বেল স্ল্যাবের উপর একটা করে ছোট মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে।
সারি সারি ছোট মন্দির ধাম্মা চেটি। প্রতিটা মন্দিরে একটা করে স্ল্যাব সংরক্ষিত আছে
একটা স্ল্যাবের (পৃষ্ঠার) ছবি
প্রতিটা ছোট মন্দিরকে ধাম্মা (ধর্ম?) চেটি বা গুহা বলা হয়। প্রতিটা চেটিতে ১৫৩ (সেঃমিঃ) উচ্চতা, ১০৭ (সেঃমিঃ) প্রশস্ত এবং ১১ (সেঃমিঃ) পুরু একটা করে মার্বেল পাথরের দু পার্শ্বে দুটো পৃষ্ঠা খোদাই করা হয়েছে। এতে ৭২৯ টা পাথর ব্যবহার করা হয়। বাড়তি একটা স্ল্যাবে এই পুস্তক খোদনের ইতিহাস বর্ণিত আছে।
প্রতিটা পাথরে খোদাই করা অক্ষরগুলো স্বর্ণ দ্বারা মিনা করে পুরো প্রস্তর খণ্ডকে মনি-মুক্তা শোভিত করা হয়। উনিশ শ আশি সালে ব্রিটিশ বাহিনী পুরো বার্মা দখল করে। ফলশ্রুতিতে পুস্তকে খোদিত স্বর্ণ এবং মনি-মুক্তা লুণ্ঠিত হয়।
মূল প্যাগোডার প্রবেশ দ্বারে পুরো পুস্তকের একটা মডেল রাখা হয়েছে।
পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পুস্তকের মডেল
আহমেদ সাবের, সিডনি
|