bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













সর্প সমাচার / আহমেদ সাবের



আগের অংশ


আমাদের অফিসের স্থান বদল হলো – প্রসপেক্ট থেকে নর্থ রাইডে। এখানে আসার পর একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। আমাদের অফিস দেলহী (দিল্লী) রোডে, পাশে রয়েছে লাকনাও (লখনৌ) রোড। আর উলটো দিকে একটু পূর্ব দিকে এগুলেই প্লাসী (পলাশী ) রোড। অস্ট্রেলিয়ার আর কোন শহরে এত গুলো ভারতবর্ষ সম্পর্কিত রাস্তার নাম পাশাপাশি আছে কিনা, আমার জানা নেই। সম্ভবত: যে ভদ্রলোক রাস্তাগুলোর নামকরণ করেছেন, ভারতবর্ষের সাথে তার কোন আত্মিক বন্ধন ছিলো।

যাক সে কথা। প্রসপেক্ট থেকে নর্থ রাইডে এসে ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত আগুনে পড়ে গেলাম। প্রসপেক্ট ‘এ কালে ভদ্রে সাপ দেখা যেতো। নর্থ রাইডে সেটা প্রায় নিয়মিত হয়ে গেলো। প্লাসী (পলাশী ) রোড ধরে কবরস্থান বামে রেখে প্রায় আধা কিলোমিটার গেলেই লেন-কোভ পার্ক। পার্কের ভেতর ঢুকে আবার আধা কিলোমিটার গেলেই লেন-কোভ নদী। পুরো যায়গাটা ঘন অরণ্য আচ্ছাদিত আর নানা প্রকার পশু, পাখী আর সরীসৃপের অভয়ারণ্য। পার্কে লাঞ্চ-ব্রেকে এখানে অনেকেই হাটতে/দৌড়াতে আসেন। আমিও আসি। সাপেরা পাল্লা দেয় সবার সাথে। যেন, সাপ আর মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান।



-৩-

এখানকার (বোধ হয় সব যায়গার) বাংলাদেশীদের সময় কাটাবার প্রধান উপায় হচ্ছে দাওয়াত দেয়া কিংবা নেয়া। সুতরাং আমরাই বাকী থাকি কেন। দিন কয়েক আগে কয়েকজন বন্ধুকে ডিনারে ডেকেছিলাম। রাত প্রায় আট টার মতো বাজে। অতিথিরা সবাই এসে গেছেন। একটু পরে খাবার দেয়া হবে। আমরা ছেলেরা ড্রইং রুমে আড্ডা দিচ্ছি, মেয়েরা রান্না ঘরের লাগোয়া একটা রুমে তাদের আড্ডায় ব্যস্ত। আমাদের আড্ডায় আমরা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য অবধি সকল সমস্যার সমাধান বাতলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিতে এসে থামলাম। এক বন্ধু ভোলার জনৈক যুবকের ফেসবুক আইডি হ্যাক এবং পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কথা উঠাতেই গ্যারাজ থেকে আচম্বিতে একটা চিৎকারের শব্দের সাথে দড়াম করে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ ভেসে এলো। গৃহ-কর্তার দায়িত্ব পালনার্থে আমি তাড়াতাড়ি বাসার ভেতর থেকে গ্যারাজে যাবার দরজার দিকে ছুটে গেলাম। আমার পিছু পিছু অভ্যাগতরা সবাই।

গিয়ে দেখলাম, গিন্নী মীরা কপালের এক পাশ ডান হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে বাম হাত দিয়ে গ্যারাজ ‘এর দরজা চেপে ধরে আছে। ডান হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে রক্তের চিহ্ন। আমাদের সমন্বিত উদ্বেগাকুল প্রশ্নের উত্তরে মীরা যা জানালো, তার সারার্থ হচ্ছে, সে টিস্যু বক্স নেবার জন্য গ্যারাজে এসেছিলো। আলো জ্বালানোর সাথে সাথে একটা সাপকে আমার টুল-বক্সের পেছনে লুকাতে দেখলো। তাড়াহুড়া করে বেরুতে গিয়ে দরজার ফ্রেমে ওর কপালের ধাক্কা লেগেছে।

আমি ওকে ধরে এনে একটা সোফায় বসালাম। উপস্থিত ভাবীদের মধ্যে একজন ছিলেন ডাক্তার। উনি রোগী পরিচর্যায় লেগে গেলেন। আমরা বাকীরা সবাই গ্যারাজের বন্ধ দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে কি করা যায়, তাই নিয়ে আলাপ করতে লাগলাম। এক বন্ধু ঝাড়ুর লাঠি খুলে হাতে নিয়ে গ্যারাজে ঢুকতে গেলেই বাকীরা বাধা দিয়ে তাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, এ দেশে সাপ মারা আইনত: অপরাধ। অন্য এক বন্ধু সাপ দেখার জন্য দরজা একটু ফাঁক করতেই বাকীরা তেড়ে এলেন – আপনি সবাইকে মারতে চান নাকি? অবশেষে সবার পরামর্শ মাফিক ট্রিপল-জিরো (ইমার্জেন্সী) নাম্বারে ফোন করা হলো। ওরা অন্য একটা নাম্বারে ফোন করতে বললো। সেই নাম্বরে ফোন করে কাউকে পাওয়া গেলোনা। কয়েক বার ফোন করার পর শেষমেশ এক জনকে পাওয়া গেলো। সে জানালো যে, সাপ ধরার জন্য কাউকে যথাশিঘ্রী পাঠানো হবে। আমরা গ্যারাজে যাবার দরজার নীচের দিকটা ভালো মতো বন্ধ করে দরজার সামনে একটা ভারী বাক্স রাখতে না রাখতেই আমাদের বাসার সামনের দরজার কলিং বেল বেজে উঠলো। আমরা সাপ ধরা ডিপার্টমেন্টের তৎপরতায় চমৎকৃত। ডাকবার প্রায় সাথে সাথেই লোক হাজির! আমি তড়িঘড়ি করে দরজা খুলেই আকাশ থেকে পড়লাম – সামনে সাপ ধরা লোকের বদলে ঈষিতা দাঁড়িয়ে।

ঈষিতাকে আপনাদের অনেকেই হয়তো চিনেন। একজন লেখকের লেখার অনুরাগী পাঠক হয়ে শুরু করে ব্যক্তি লেখকের অনুরাগী হবার তীব্র বাসনার সুবাদে লেখকের দাম্পত্য জীবনে চরম সংকট সৃষ্টির পটভূমিকায় লেখা একটা গল্পে ঈষিতার নাম ভিলেন হিসেবে ব্যবহার করেছিলাম। ব্যক্তিগত জীবনে সে আমার মীরার মামাতো বোন, আমার প্রিয় শ্যালিকাদের একজন। বছর তিনেক আগে আমেরিকা প্রবাসী এক যুবককে বিয়ে করে সে নিউইয়র্ক চলে যায়। গত বছর ওরা আমেরিকা ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ার ওয়াগা ওয়াগা শহরে আস্তানা গাড়ে।

ঘরে ঢুকতেই আমার পেছনে দাঁড়ানো কপালের চার পাশ ঘিরে সাদা কাপড়ের (গজের অভাবে ) ব্যান্ডেজ বাঁধা মীরাকে দেখে ‘তোমার আবার কি হলো আপু?’ বলে ওর দিকে ছুটে যায় সে। কি আর হবে? এই চাষা ( মানে আমি) লোকটা আমাদের সবার মরণ ডেকে আনবে। সারাদিন গ্যারাজের পেছনের দরজা খুলে বাগানে কাজ করে। সেই সুবাদে পোকা-মাকড়, জীব-জন্তু সব গ্যারাজে এসে ঠাঁই নেয়। গতবার একটা ইঁদুর বেশ জ্বালিয়েছিলো। এবার ইঁদুরের খোঁজে সাপ এসে বাচ্চা-কাচ্চা সহ হাজির। এক নিঃশ্বাসে বলে গেলো মীরা।

সাপ? তোমাদের গ্যারাজে? দেখি তো, বলে গ্যারাজের দিকে রওয়ানা হলো মীরা।

না না, তুই ওদিকে যাবি না। তোর কিছু হলে আমি মামাকে কি বলে জবাব দেবো আর রুবেল (ঈষিতার বর) কেই বা কী বলবো? ঈষিতাকে আগলে ধরে মীরা।

না, তুই যাবিনা। একটু পরের সাপ ধরার লোক আসছে। আমিও বাধা দেই।

আরে দেখিই না বাপু তোমাদের সাপ। বলে এক টানে দরজার সামনে রাখা বাক্স সরিয়ে গ্যারাজে ঢুকে পড়ে ঈষিতা। আমরা দরজার ফ্রেমের এপারে দাঁড়িয়ে রুদ্ধশ্বাসে ওর কাণ্ড কারখানা দেখতে থাকি।

আমার টুল বক্সের ধারে কাছে সাপের চিহ্ন মাত্র নেই। ঈষিতা দারুণ একাগ্রতায় গ্যারাজের মেঝেতে রাখা সব বাক্স-পেটরার পেছন দিক খুঁটে খুঁটে দেখে আমার জুতার বাক্স গুলোর কাছে এসে থামে। বাক্সগুলোর পেছনে সাপের লেজের মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। আমি আতঙ্কে ঘেমে উঠি। ঈষিতা ভাল ভাবে দেখার জন্য আরো কাছে এগিয়ে যায়। একটু পরে আমাদের দিকে তাকিয়ে ইন্দ্রনাথীয় স্টাইলে বলে উঠে, জামাই বাবু, এ সাপ নয় বোধ হয়। লেখক সাহেব, এটা তো সাপ না। অহিংস্র ব্লু –টাং লিজার্ড। আমাদের ওয়াগার বাড়ীতে প্রচুর আছে।

ঈষিতা একটা খালি জুতোর বাক্স কাত করে লিজার্ড টার সামনে ধরতেই ওটা হামাগুড়ি দিয়ে বাক্সে ঢুকে পড়ে। সে তারপর বাক্সটা আমার হাতে দিয়ে বললো, যান বীর-পুরুষ, এটাকে বাগানে ছেড়ে দিয়ে আসেন।



-৪-

সাপ সংক্রান্ত উত্তেজনা মিইয়ে এসেছে। খাবারের মূল পর্ব শেষ। মীরা সবাইকে মিষ্টি খাবার জন্য ডাকতেই ঈষিতা বলে উঠলো,

আপু, এক মিনিট থামো, একটা সারপ্রাইজ আছে।

তোর আসাটাই তো একটা সারপ্রাইজ, এর উপর আবার কি সারপ্রাইজ দিবি?

ঈষিতা কিছু না বলে বেরিয়ে গিয়ে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ এবং একটা কেক নিয়ে ঘরে ঢুকলো। কেকটা টেবিলে রাখলো আর পাশে একটা ফুলদানিতে ফুলের তোড়াটা রেখে আমাকে ও মীরাকে টেবিলের পাশে এনে দাঁড় করালো।

তারপর বক্তৃতা দেবার ভঙ্গীতে বললো, আজ থেকে বিশ বছর আগে এই দিনে আমার এস এস সি পরীক্ষা পাশের অজুহাত দেখিয়ে আমার বাবা-মা একটা পার্টির আয়োজন করেছিলেন। আসল কারণটা ছিলো, একজন স্বাধীনচেতা নারীকে বিদেশ থেকে দেশে কনে খুঁজতে আসা একজন অপরিচিত যুবকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া। নিজের অজান্তে সেই নারী ওই পাতানো ফাঁদে সারা জীবনের জন্যে আটকে যান। সেই দিনটার বিশ বছর পরে, দিনটিকে স্মরণ করে আজ আমার দু’জন অতি প্রিয় মানুষের আনন্দে ভাগ বসাতে ওনাদের পাশে থাকতে পেরে আমিও আনন্দিত। শুভ পরিচিতি দিবস।


সিডনী, অক্টোবর ২১-২৭, ২০১৯



পাদটীকাঃ

গল্পের শেষ দিকে যে “ইন্দ্রনাথ” ‘এর নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেটি কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসের একটা চরিত্র। এই গল্পে ঈষিতার সাপ দেখার সাথে শ্রীকান্ত প্রথম পর্বে ইন্দ্রনাথের বাঘ দেখার কিছুটা মিল পাঠকেরা পেলেও পেতে পারেন। বাংলা-সিডনীর পাতায় শরৎ রচনাবলীর একটা লিঙ্ক দেওয়া আছে। যারা “বহুরূপী” গল্পের অংশে সরাসরি যেতে চান, নীচের লিঙ্কটা ব্যবহার করতে পারেন।

https://sarat-rachanabali.nltr.org/content.jsp?001009001007https://sarat-rachanabali.nltr.org/content.jsp?001009001007



আগের অংশ



আহমেদ সাবের, সিডনি




Share on Facebook               Home Page             Published on: 29-Oct-2019

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot