সর্প সমাচার আহমেদ সাবের
-১-
আমাদের শিশু বয়সে সাপুড়েরা বাসায় বাসায় সাপের খেলা দেখাতে আসতো। ঝাঁপি থেকে সাপ বের করে বাঁশীতে হিন্দি নাগিন সিনেমার সুর তুলতো আর সাপ বাঁশীর তালে তালে মাথা দোলাতো। আমরা মোহাবিষ্টের মতো নিস্পলক চোখে সাপের খেলা দেখতাম। যুগ বদলের হাওয়ায় সাপুড়েরা এখনো টিকে আছে কি-না, জানিনা। তবে আমাদের মনোজগতে সাপুড়েরা মৃত্যুহীন।
সুতরাং সেই শৈশব থেকেই রজ্জু-সদৃশ প্রাণীটার সাথে আমাদের পরিচয়। পরিচয়টা আরো গাড় হলো বাবার গরু কেনার সূত্রে। আমি সম্ভবত: তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি। আমাদেরকে পানি মিশ্রিত গরুর দুধ (থুক্কু, দুগ্ধ মিশ্রিত পানি) খাওয়ানোর হাত থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে তিনি একটা গাভী কিনেন। মফস্বল শহরের বসত ঘরের সাথে একটা ছাপরা তুলে গাভীটার থাকার ব্যবস্থা করা হলো। গ্রাম থেকে একজন লোক প্রতিদিন গরুর দুধ দুয়ে দিয়ে যেতেন। আমরা ভাই-বোনেরা ওনাকে জলিল চাচা ডাকতাম। ভালোই চলছিলো। প্রথম দিকে গাভীটা আড়াই-তিন সের দুধ দিতো। মাস খানেকের মধ্যে সেই পরিমাণ এক থেকে আধা সেরে এসে ঠেকলো। বাবার প্রশ্নের উত্তরে জলিল চাচা জানালেন, রাতের বেলা সাপ এসে গাভীর দুধ খেয়ে যাচ্ছে। ফলে এই বিড়ম্বনা। সাপ গরুর বাট থেকে দুধ খেতে পারে কি-না, সেটা সর্প বিশারদরা জানলেও জানতে পারেন। তবে জলিল চাচার আলামত গুলো ফেলবার মতো নয়। গরুর পায়ে নাকি সাপের জড়িয়ে ধরার চিহ্ন দেখা গেছে। আমাদের বসত ঘরের যে দিকটায় গোয়ালঘর, সে দিকটায় আমি ঘুমাই। স্বাভাবিক কারণেই রাতের বেলা আতঙ্কে ঘুম আসেনা। মাস দুয়েক পরে বাবার গাভী প্রজেক্টের সমাপ্তি ঘটে আর আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
প্রাইমারী স্কুল টপকানোর সাথে সাথে মোটামুটি স্বাধীন হয়ে গেলাম। খাওয়া আর ঘুমানোর সময় ছাড়া আমাকে কমই বাসায় পাওয়া যেতো। পড়াশুনার মতো অপ্রয়োজনীয় কাজের চেয়ে বৃষ্টিতে ভেজা, ফুটবল খেলা, মাছ ধরা, বাঁশ কিংবা কলার ভেলা অথবা কোশা নৌকায় নদীতে হারিয়ে যাওয়ার মতো অতি দরকারি কাজে বেশী সময় ব্যয় হতে থাকলো। আর সেই সুবাদে আরো অধিকতর সর্প সন্দর্শন। কখনো, ভেলার উপর দিয়ে ওদের ত্বরিত নির্গমন। কখনো, মাছের লোভে মাছ ধরার জন্য পাতানো ফাঁদে মাছের লোভে ঢুকে ওদের অক্কা-প্রাপ্তি। কখনো একই জালে খাদক আর খাদ্যের সমাগমন।
আমরা যে পুকুরে গোসল করতাম, সেখানে হলুদ শরীরে কালো ডোরার ঢোড়া নামক বিষহীন সাপদের প্রায়ই সাঁতার কাটতে দেখা যেতো। আমরা ঐ জাতের সাপকে মোটামুটি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতাম। মাঝে মাঝে মাছ ধরার জালে কিংবা মাছ ধরার বাঁশের ফাঁদে পেলে সাপের লেজ ধরে মাথার উপর কয়েক চক্কর দিয়ে দূরে ছুড়ে মারতাম। আমাদের গোসল করার ঘাটে একবার সাপের বাচ্চার আনাগোনা বেড়ে যায়। কারণ ছিলো, কাছাকাছি কোথাও সাপ ডিম দিয়েছে। এবং গরমে ডিম ফুটে বাচ্চা বেরুচ্ছে। সাপের আস্তানা বের করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। কেঁচোর মতো কিলবিল করে সাপের বাচ্চারা এদিক সেদিক ছুটতে লাগলো পিলপিল করে। এক দঙ্গল কাক জুটে গেলো মহোৎসবে।
সর্প বাবাজিদের সখ্যতা নদী-নালাতেই সীমাবদ্ধ থাকলেও চলতো। কিন্তু আমার প্রতি অদম্য ভালোবাসা ওদেরকে আমার পড়ার ঘর পর্যন্ত টেনে আনলো। এস এস সি টেস্ট পরীক্ষার আগে (মশাদের হাত থেকে বাঁচার জন্যে) মশারির ভেতরে বসে সারা বছর লেখাপড়া না করার খেসারত হিসেবে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনার চেষ্টা চালাচ্ছি। সন্ধ্যে তখন সাত-আটটার মতো। বাইরের গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো। এমন সময় আড়চোখে জানালার পাশে রশির মতো কিছু নড়তে দেখলাম। এখানে বলে রাখি, আমার পড়ার ঘরের বেড়াগুলো ছিলো বাঁশের তৈরি। একটু পরের বিস্ফারিত চোখে জানালার পাশের বেড়া বেয়ে একটা সাপকে ঊর্ধ্বমুখী হবার কসরত করতে দেখলাম। হাতের বই কখন যে হাত থেকে ফসকে বেড়ার উপর গিয়ে পড়েছে, নিজেই জানিনা। তবে মশারির কারণে, কিংবা নিজের অদক্ষতার কারণে হাতের অস্ত্র লক্ষ্যচ্যুত। সর্প মহারাজ কোন দিকে গেলেন, টেরই পেলামনা।
শব্দের কারণে পাশের ঘর থেকে সবাই ছুটে এলেন। আমি তোতলাতে তোতলাতে সাপের আগমন-নির্গমনের পুরো ঘটনাটা বর্ণনা করলাম। আমার নয় বছরের ছোট ভাইয়ের ধারনা, ওটা অবশ্যই পদ্ম গোখরো। দুধ খেতে এসেছিলো (কয়েক দিন আগে ওকে কাজী নজরুলের পদ্ম গোখরো গল্পটা শুনিয়েছিলাম)। আমার পিঠোপিঠি ছোট বোন বেশ গম্ভীর মুখে বললো, ভাইয়া, বই শুধু জ্ঞানার্জনের কাজেই লাগেনা, আত্মরক্ষার কাজেও লাগে।
আস্তে আস্তে আমার পড়ার ঘরে একটা ছোটখাটো জটলা জমে গেলো। সর্পাঘাতের নানা রোমহর্ষক কাহিনী একের পর এক বর্ণিত হতে লাগলো। সাথে বিভিন্ন ওঝার কেরামতির অবিশ্বাস্য কাহিনী। সবাই নিশ্চিত যে, আমাদের ঘরের আশে পাশে কোথাও সাপের বাসা আছে। যেহেতু সাপটার শান্তি বিঘ্নিত করা হয়েছে, তার যোগ্য প্রতিউত্তর দিতে ওরা সদলবলে আসবে। গুনীন এসে বাড়ী বন্ধ না করলে ওদের আক্রমণ ঠেকায়, কার সাধ্য। সুতরাং চার মাইল দূর থেকে গুনীন কে আনার জন্য আমার চাচাতো ভাই সাইকেলে রওয়ানা হলেন। এক মামা বাজারে গেলেন কার্বলিক এসিড আনতে। এশার নামাজের পর ইমাম সাহেব এসে ঝাড়ফুঁক দিয়ে গেলেন। সারা বাড়ীতে উৎসব উৎসব ভাব।
দুর্ভাগ্যবশত: গুনীন সাহেবকে পাওয়া গেলোনা। তিনি অন্যত্র কাজে গেছেন। রাতে আমার ঘুমানোর যায়গা বদল করা হলো। ঘরের চার পাশে কার্বলিক এসিড আর শুকনো মরিচ পুড়ে ছিটানো হলো। । সাবধানের মার নেই। ঘরের মধ্যে খাটের চার পাশও বাদ থাকলোনা। কাজের ছেলে তৈয়ব আমাকে পাহারা দেবার জন্য আমার খাটের পাশে মেঝেতে শয্যা নিলো (ওদের বোধ হয় সাপে কাটেনা)। ঘরে হ্যারিকেন জ্বলিয়ে রাখা হলো। একে একে সবাই বিদায় হলেন। আমার আর ঘুম আসেনা। একটু চোখ লেগে আসে আর লক্ষ্মীন্দরের বাসর ঘর সিনেমার পর্দার চোখের উপর ফুটে উঠে। লোহার বাসর ঘরের সূক্ষ্ম ফুটো দিয়ে যেমন করে সাপ ঢুকেছিলো, তেমন করে সাপ ঢুকছে আমাদের জীর্ণ গৃহে। পায়ে ছোবল দিতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে জেগে উঠি। দেখি, সারা দিনের ক্লান্তির পর তৈয়ব গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। সে যা হোক, দীর্ঘ রাত্রির শেষে নির্বিঘ্নে সকাল আসলো। দিনের পর রাত, রাতের পর দিন। সেই ঘটনার স্মৃতি মিলিয়ে যেতে কেটে গেলো অনেক দিন।
তারপর বড় হলাম, আরো বড়। বিদেশ গেলাম। নানা ঘাটের পানি খেয়ে অবশেষে নোঙ্গর ফেললাম অস্ট্রেলিয়ার সিডনী শহরে। এর মধ্যে আমার শৈশবের হস্ত-পদ-বিহীন বন্ধুদের সাথে যে দেখা হয়নি, তা নয়। গল্প দীর্ঘ হবার ভয়ে সেগুলো এড়িয়ে গেলাম। ভেবেছিলাম, নদী, নালা, বন-জঙ্গলের দেশ ফেলে ইট-কাঠের দেশে এসেছি। ওদের সাথে বোধ হয় আর কোনদিন দেখা হবেনা। কিন্তু ললাটের লিখন খণ্ডাবে কে?
-২-
যদিও দেশে একটা বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিতে দীর্ঘকালীন চাকুরীর অভিজ্ঞতা ছিলো, এ দেশে আসবার পর সেটা কোন কাজে এলো না; কোন ভালো কাজ জুটাতে পারলাম না। অগত্যা মিথ্যা আভিজাত্য বোধ আস্তাকুড়ে ফেলে যখন যা পেলাম, তাতেই লেগে গেলাম। সাথে কিছু লেখাপড়াও চালিয়ে গেলাম রাতের বেলা। অবশেষে বছর খানেক পর কষ্টের ফল মিললো। একটা ফরেনসিক ল্যাবে ল্যাব-এসিসট্যান্ট হিসেবে মোটামুটি ভালো একটা চাকুরী মিলে গেলো। অফিস সিডনীর প্রসপেক্ট সাবার্বে।
চাকুরীতে জয়েন করতে গিয়ে আমার চক্ষু চড়কগাছ। কম্পাউন্ডের এখানে সেখানে পোষ্ট দিয়ে নোটিশ টানানো – “সাবধান, এই এলাকায় সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। চলাফেরায় সতর্কতা বাঞ্ছনীয়“। অবশ্য ওই সাবধান বাণীকে আমি তেমন পাত্তা দিলাম না। কারণ, ল্যাবের দালানটা বেশ পুরনো। সম্ভবত: যে সময় দালানটা বানানো হয়েছিলো, সে সময় আশেপাশে অনেক ঝোপ-ঝাড় আর ডোবা-নালা ছিলো। আর তাতে সাপের বসতি থাকা অস্বাভাবিক নয়। গত কয়েক বছরে ল্যাবের আশেপাশের এলাকার অনেক পরিবর্তন হয়েছে, অনেক নতুন আবাসিক এলাকার পত্তন হয়েছে। সাপ আর ভুত কখনো ঘন লোক বসতির ধারে কাছে থাকেনা।
এলাকাটা বেশ সুন্দর। এক পাশে একটা মনুষ্য-সৃষ্ট লেক। অন্যদিকে সবুজ গাছ-গাছালী সমৃদ্ধ একটা ছোট-খাট টিলা। লাঞ্চ ব্রেকে লেকে কিংবা টিলায় ঘুরে আসি। সহকর্মীরা ভয় দেখায়, সাবধান, টিলায় যেওনা, সাপ আছে। আমি এক কানে শুনি, আর অন্য কান দিয়ে বের করে দেই। মনে মনে বলি, সমুদ্রে শয়ান যার, শিশিরে কি ভয় তার? দেখতে দেখতে মাস ছয়েক কেটে গেলো। জয়েন করেছিলাম শীতের সময়। এখন গ্রীষ্মকাল। এক সহকর্মী সকালে এসেই বললো – গতকাল বাড়ী যাবার সময় সে ওর গাড়ীর নীচে একটা সাপ দেখতে পেয়েছিলো। ওর পায়ের শব্দে সাপটা রাস্তার পাশের ঘাসের মধ্যে লুকিয়ে যায়। এর কয়েকদিন পর লাঞ্চ ব্রেকে হাটতে যাচ্ছি। আমাদের অফিস কম্পাউন্ড থেকে বেরুবার গেইটের পাশে একটা সাপকে ত্বরিত গতিতে ছুটে পাশের ঝোপে লুকাতে দেখলাম। এর পর থেকে বেশ সাবধান হয়ে গেলাম। কিন্তু সেই সাবধানতা কাজে এলো না। ওরা বন-জঞ্জাল ছেড়ে শেষ-মেষ রুমেই আক্রমণ করলো।
এখানকার বেশীর ভাগ অফিসের মতো আমাদেরও প্রতি সোমবার সকাল ন’টা থেকে দশটা একটা মিটিং হয়। ওতে বিভিন্ন প্রজেক্টের গত সপ্তাহের অগ্রগতি/সমস্যা এবং এ সপ্তাহের করনীয় নিয়ে আলোচনা হয়। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের টিমের সাত জন সদস্যের সবাই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অভিবাসী। মিটিং ‘এর প্রায় মাঝামাঝি সময় আমাদের ভিয়েতনামী সহকর্মী লাফ দিয়ে চেয়ারের উপর পা তুলে বসে, ঘরের এক কোনে রাখা ফটোকপিয়ার ‘এর নীচের দিকে ডান হাতের তর্জনী নির্দেশ করে সবাইর দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন। চোখ বড় করে মুখে শুধু গোঁ গোঁ শব্দ। তার সাথে সাথে ভারতীয় বন্ধু এক লাফে টেবিলের উপর উঠে, দু-হাত প্রণামের ভঙ্গি করে মুখে এক বাক্যে সাপ সাপ বলে যেতে লাগলেন। ব্যাপারটা বুঝে উঠতে একটু সময় লাগলো। আমরা যারা টেবিলের এ পাশে বসেছি, ফটোকপিয়ারটা আমাদের পেছনে। সুতরাং যখন বুঝলাম, একটা সাপ আমাদের পেছন দিয়ে গিয়ে ফটোকপিয়ার ‘এর নীচে লুকিয়েছে তখন আমরা সবাই এক যোগে ছুটে উল্টো দিকে চলে গেলাম। সবার তির্যক দৃষ্টি, সাপের গতি পথের দিকে। আমাদের ম্যানেজার, জার্মান ভদ্রলোক শান্ত গলায় সিকিউরিটিকে ফোন করে আমাদের মিটিং ‘এ অনাহুত আগন্তুকের সংবাদ জানালেন। ফোন করা শেষে উনি আমাদের জানালেন যে, সাপ ধরার লোককে খবর দেয়া হচ্ছে। ভয়ের কোন কারণ নেই। ওরা শীঘ্রি এসে যাবে।
ভয়ের কোন কারণ নেই বললেই কি ভয় চলে যায়? আমি মনে মনে যা দোয়া-দরুদ মনে আসে সব পড়তে লাগলাম। আমাদের রাশিয়ান সহকর্মী মহিলার ফর্শা গাল আরো লাল হয়ে গেলো (জানতাম, ভয়ে সাদা হয়)। এত সব গণ্ডগোলের মধ্যে আমাদের চাইনিজ ছোকরা সহকর্মী ওর মেয়ে-বন্ধুকে ফোন করে বিদায় নিচ্ছে। ধরেই নিয়েছে, সাপের ছোবলে আজ ওর মৃত্যু নিশ্চিত। একমাত্র নির্লিপ্ত থাকতে দেখলাম আমাদের পাঁড় খাওয়া ক্যাম্পিং বিশারদ অস্ট্রেলিয়ান সহকর্মীকে।
রুমের দরজার বাইরে অনেক পদশব্দ পাওয়া গেলো। প্রায় আধা ঘণ্টা পর সাপ ধরার লোক এসে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সাপটাকে ধরে একটা বাক্সে পুরে চলে গেলেন। আমরা সবাই বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
দেখতে দেখতে প্রায় দেড় যুগ কেটে গেলো . . . পরের অংশ
|