(১)
করোনার কারণে রকিবদের দৈনন্দিন রুটিনের অনেক ওলট-পালট হলেও খাবার টাইমটা ঠিকই আছে। রাত সাতটা বাজতে চললো। শীতের বেলা। সন্ধ্যে হয়ে গেছে ঘণ্টা দুয়েক আগে। রাতের খাবারের পর্ব শেষ। খাবার টেবিলে বসে গল্প করছে রকিব, স্ত্রী রুমনা আর ওদের সাত বছরের ছেলে ইমন। গল্পের মূল বিষয় করোনা। কি করে করোনার অদৃশ্য হাত সারা পৃথিবীকে থমকে দিয়েছে। সেই নিত্য দিনের গল্প।
অফিসের কাজে রকিবের যেখানে মাসের প্রায় পনেরো দিনই অস্ট্রেলিয়ার নানা শহরে ঘুরে বেড়াতে হতো, গত দু মাস ধরে সে গৃহ-বন্দী। আর সিডনীতে থাকলেও, প্রায় প্রতি দিনই অফিস থেকে ওকে রাত করে ঘরে ফিরতে হতো কাজের চাপে। এখন বাসা থেকেই কাজ করতে হচ্ছে বলে রাত করে ঘরে ফেরার সমস্যাও নাই। করোনার ছোবলে কত লোক চাকুরী হারিয়েছে। সে দিক দিয়ে রকিব ভাগ্যবান। ওর চাকুরী হারাবার আপাততঃ কোন সম্ভাবনা নাই। তবে করোনার সুবাদে ওর একটা লাভ হয়েছে। বিদেশের মাটিতে জন্ম আর বড় হওয়া রকিব বাংলা তেমন বুঝতো না। বিয়ের পর, গত আট বছর রুমনা অনেক চেষ্টা করেছে ওকে বাংলা নাটক-সিনেমা দেখিয়ে বাংলা ভাষার প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে। হাজার হোক, মায়ের ভাষা। তবে তাতে তেমন সার্থক হয়নি। প্রথম কারণ, বাংলা সিনেমা রকিবের বেশ স্লো লাগে। আর দ্বিতীয়তঃ, রকিব বাংলা কথা কিছুটা বুঝলেও নাটক-সিনেমার ডায়ালগ ওকে বুঝিয়ে দিতে হয়। এতে করে সে দেখার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। আর সবার উপরে রকিবের ব্যস্ততা। সব মিলিয়ে রুমনার সব চেষ্টা - সকলি গরল ভেল।
কিন্তু করোনার কারণে রকিবের এখন অফিস যেতে হয়না। দিনের বেলা অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলেও সন্ধ্যের পর কোন কাজ নেই। দাওয়াত দেওয়া নেওয়া সব বন্ধ। দোকান-পাটে ঘুরাঘুরি বন্ধ। সুতরাং সময় কাটাতে রুমনার সাথে বসে দু-একটা বাংলা নাটক পুরোপুরি দেখার পর, রকিব এখন বাংলা ভালোই বুঝতে পারে। তদুপরি, নাটকের নেশাও ওকে পেয়ে বসেছে।
আজকের নাটক কি? কথার মাঝখানে বলে উঠে রকিব।
বাব্বাঃ, তুমি তো দেখছি বাংলা নাটকের খাঁটি সমঝদার হয়ে গেছো। করোনার কারণে অফুরন্ত সময়; সারাদিন নাটক, সিনেমা। ফোঁড়ন কাটে রুমনা।
অফুরন্ত সময় কোথায় দেখলে? এখন বরং আগের চেয়ে বেশী কাজ করি। আগে তো অফিসে আসতে যেতেই মিনিমাম তিন ঘণ্টা চলে যেতে। এখন সে সময়টা বাড়তি অফিসের কাজ করি। তার উপর তোমাকে রান্নায় সাহায্য করতে হয়, ঘর-দোর পরিষ্কার করতে হয়। ইমনের সাথে ফুটবল খেলতে হয়।
আজ কিন্তু খেলতে যাওনি বাবা। বলে উঠে ইমন।
যাব কি করে ব্যাটা? দুপুরের পর থেকেই বৃষ্টি নামলো।
আজকের নাটক? ভাবতে ভাবতে বলে রুমনা। ...... হুমায়ুন আহমেদ ‘এর বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল দেখতে পারো। দারুণ নাটক। আমি বার দশেক দেখেছি। রিয়াজ আছে।
রিয়াজ কে?
এরই মধ্যে ভুলে গেলে? পরশুই তো হুমায়ূন আহমেদের “চৈত্র দিনের গান” দেখলে। রিয়াজ ছিলো সেই নাটকে। চেহারা অনেকটা তোমার মতো দেখতে।
(২)
রকিব ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে নাটক দেখছে – হুমায়ুন আহমেদ ‘এর বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল। ইমন বাবার কোলে মাথা বাবাকে সঙ্গ দিচ্ছে। পায়ে ওর নিত্য সঙ্গী - প্রিয় ফুটবল। সব বুঝতে না পারলেও, বাংলা নাটক দেখতে ওর খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে যা কাণ্ড হয়, হাসতে হাসতে ওর প্রায় দম আটকে আসে।
আজকের নাটকে কমলা রঙের টি-শার্ট পরা রনি নামের একটা ছোট ছেলের মুখে থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর দেখা হচ্ছে।
বাবা, ছেলেটার কি জ্বর? প্রশ্ন ইমনের।
না না, ও পড়াশুনা ফাঁকি দেবার জন্যে জ্বরের ভান করেছে।
ছেলেটার বোকামিতে ইমনের দারুণ হাসি পায়। থার্মোমিটার তো এখনি বলে দেবে জ্বর হয়েছে, কি হয়নি। ও জ্বর হবার কথা না বলে পেটে ব্যথার কথা বললে এভাবে ধরা পড়তে হতো না। পেটে ব্যথা মাপার তো কোন ব্যথা-মিটার নেই। হাঁদারাম কোথাকার।
একটু পর আরেক মজার কাণ্ড হচ্ছে। ইমনের বাবার মতো চেহারার লোকটা সাথের মহিলাকে মিষ্টির প্যাকেট থেকে একটা মিষ্টি নিয়ে খেতে বলছে। সে খেতে চাইছেনা। তখন লোকটা নিজেই মিষ্টিটা টপ করে খেয়ে ফেললো।
কেমন বোকা মহিলা। ভাবে ইমন। ও পেলে তো মিষ্টির পুরো প্যাকেটই সাবাড় করে দিতো।
বাবা লোকটা মিষ্টি খাচ্ছে কেন?
ওরা বিয়ে করেছে। ওটা ওদের বিয়ের মিষ্টি।
বলে কী! হল ভর্তি মেহমান নাই, খানা-দানা নাই, গান নাই, নাচ নাই। এটা আবার কেমন বিয়ে? ইমন এটা ভাবতে ভাবতেই লোকটা কতগুলো রাস্তার ছেলে-মেয়েদেরকে ডেকে মিষ্টি বিলানো শুরু করলো। হঠাৎ একটা ছেলে লোকটার হাত থেকে পুরো মিষ্টির প্যাকেটটা নিয়ে দৌড় দিলো। হাসতে হাসতে ইমনের হিক্কা উঠে গেলো।
বাবা, ছেলেটা মিষ্টি নিয়ে পালালো কেন? আবার প্রশ্ন ইমনের।
তুই চুপ করবি? রকিব ছেলেকে ধমক দিতেই রান্না ঘর থেকে ছুটে আসে রুমনা।
কি হয়েছে? ওকে ধমক দিচ্ছ কেন?
ওকে নিয়ে যাও তো এখান থেকে। শান্তি মত নাটকটাও দেখতে দিচ্ছে না।
আয় তো ইমন। চল, রুশোকে ফোন করি।
রুশো ইমনের খালাতো ভাই। বয়সে ইমনের চেয়ে এক বছরের বড়। ইমন লক্ষী ছেলের মতো উঠে আসে মায়ের হাত ধরে।
(৩)
ইমন মায়ের সাথে ওর শোবার ঘরে।
রুমনা ওর বড় বোনকে ভিডিও ফোন করে রুশোকে দিতে বলে।
নে কথা বল রুশোর সাথে। ইমনের হাতে ফোন দিতে দিতে বলে রুমনা।
দুই ভাই কথা বলতে থাকে। রুমনা ইমনের ঘর গুছাতে গুছাতে কান পেতে ওদের কথা শুনে। বেশীর ভাগই করোনা সংক্রান্ত। করোনা দেখতে কেমন। কি করে করোনাকে মারা যায়। তা হলে ওরা একে অন্যের বাসায় যেতে পারবে, শপিং এ যেতে পারবে, পার্কে যেতে পারবে।
এদিকে ড্রইং রুম থেকে একটু পর পর রকিবের হো হো হাসির শব্দ ভেসে আসতে থাকে।
মা, আমি রুশোদের বাসায় যাবো। ফোন শেষ করে কাঁদো কাঁদো মুখে বলে ইমন।
কি করে যাবি বাবা? ইমনকে জড়িয়ে ধরে বলে রুমনা।
কেন, আমাদের গাড়ীতে।
পুলিশ ধরবে আমাদের।
না ধরবেনা। পুলিশ অনেক ভালো। আমাদের স্কুলে এসেছিলো কয়েক মাস আগে। আমাদেরকে কত্তো গিফট দিয়েছে; বলেছে, দরকার হলে ওদের ফোন করতে।
করোনার জন্যে পুলিশই বলেছে বাসা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বের বাইরে না যেতে। রুশোদের বাসার দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটারের বেশী বাবন সোনা।
ফোন দাও। আমি পুলিশকে ফোন করে বলবো আমাকে একটা বন্দুক দিতে।
কি করবি বন্দুক দিয়ে?
আমি করোনাকে গুলি করে মেরে ফেলবো। রুশো ভাইয়া আমাকে বলেছে, করোনা দেখতে কেমন।
আয়, নাটক দেখি।
না, আমি দেখবো না। গাল ফুলিয়ে বসে থাকে ইমন।
(৪)
ইমনকে রেখে রুমনা ড্রইং রুমে এসে বসে।
নাটকে শফিকের (রিয়াজের) বিবাহোত্তর সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। নীতুর (শাওনের) বিয়ে এখনো ঝুলে আছে। এরই মধ্যে আবার সবাই মিলে ছাদে যাচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজতে।
নীতুর সাথে কি শেষ পর্যন্ত শেখ নূরুজ্জামানের (ফজলুর রহমান বাবুর) বিয়ে হবে? রুমনাকে প্রশ্ন করে রকিব।
না, আমি বলবো না। তা হলে তোমার নাটক দেখার মজাটাই মাঠে মারা যাবে। রুমনা উত্তর দেয়।
ঠিক সেই মুহূর্তেই আমি করোনাকে মেরে ফেলেছি, আমি করোনাকে মেরে ফেলেছি বলে চিৎকার করতে করতে ড্রইং রুমে ছুটে আসে ইমন।
লাফ দিয়ে উঠে ইমনকে জড়িয়ে ধরে রুমনা। কি করে মারলি রে বাবন সোনা?
আমি করোনাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলেছি।
একটা প্লাস্টিক পোড়া গন্ধ ভেসে আসে রান্না ঘর থেকে।
রুমনা দৌড়ে রান্না ঘরে ছুটে যায়। দেখে জ্বলন্ত চুলার উপর ইমনের প্রিয় বল টা জ্বলছে।
(৫)
ইমন ওর রুমে ঘুমাচ্ছে।
শুয়ে আছে রকিব আর রুমনা ওদের বিছানায়। ওদের ঘুম আসছে না।
ইমন ওর বলটা আগুনে জ্বালাতে গেলো কেন? রকিবের প্রশ্ন।
ওর নানা রঙ এর বলটার গায়ে স্পাইক আছে। দেখতে অনেকটা টেলিভিশনে দেখানো করোনার সেলের মতো। তাই ইমন হয়তো ভেবেছে, ওটাই করোনা।
-সমাপ্ত-
সিডনী, ২২-২৩ আগস্ট, ২০২০
আহমেদ সাবের, সিডনি
|