bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













আমাদের হক ভাই
আহমেদ সাবের



হক ভাই (ড. আবদুল হক) ’এর সাথে আমার পরিচয় ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে – আজ থেকে প্রায় আটত্রিশ বছর আগে। ব্যাঙ্ককে প্রতিষ্ঠিত এশিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজি (এ,আই, টি) তে একটা স্বল্প-মেয়াদী প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণের জন্য সেবার সেখানে যাওয়া। যাবার দু’ চার দিনের মধ্যেই ওনার সাথে সাথে পরিচয় আর ওনার ব্যক্তিত্বের গুণে উনি আমার হক ভাই হয়ে গেলেন। কিছুদিন যাবার পর টের পেলাম, শুধু আমার কাছে নয়, এ,আই, টি’র প্রায় সব বাংলাদেশি ছাত্রের কাছেই তিনি “হক ভাই” – বিপদে আপদে পরম আশ্রয়। তিনি তখন এ,আই, টি থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং মাস্টার্স শেষ করে একই ডিপার্টমেন্টে পি,এইচ, ডি করছিলেন।



এখানে একটা ছোট্ট ঘটনার কথা উল্লেখ না করে পারছি না। এ,আই, টি তে থাকতেই হক ভাই’এর পরামর্শেই আমি মাস্টার্স প্রোগ্রামে ভর্তি হবার জন্য আবেদন করি। প্রশিক্ষণ শেষে আগস্টে আমি দেশে ফিরে আসবার কিছুদিন পর এ,আই, টি কর্তৃপক্ষের এক চিঠিতে আমার ভর্তির আবেদন গৃহীত হয়েছে বলে জানতে পারি। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ইন্সটিটিউটের লেকচারার। ইন্সটিটিউটের পরিচালক মহোদয়কে খুশীর খবরটা জানাই। এর কিছুদিন পর হক ভাই’এর কাছ থেকে পাওয়া একটা চিঠিতে জানতে পারি, পরিচালক মহোদয় এ,আই, টি কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখেছেন - ওনার ইন্সটিটিউট’এর চলমান প্রকল্পের খাতিরে এই মুহূর্তে আমাকে ছুটি দেওয়া সম্ভব নয় বলে আমার ভর্তি যেন বাতিল করা হয়। এদিকে পরিচালক সাহেব আমাকে রোজ বলতে থাকেন - উচ্চ শিক্ষার জন্য এ,আই, টি’র মত একটা বাজে প্রতিষ্ঠানে যাবার দরকার কি? উনি আমাকে আমেরিকার কোন ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাবেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। হক ভাই ‘এর পরামর্শে আমি এ,আই, টি কর্তৃপক্ষকে চিঠি লিখি। উনিও সেখানকার যথাযথ মহলে দেখা করে আমার আসার নিশ্চয়তা দিয়ে আমার ভর্তি এবং স্কলারশিপ রক্ষা করেন। আমি চাকুরীতে তোয়াক্কা না করে ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে এ,আই, টিতে হাজির হই। উনিশ শ’ আশি সালের সেপ্টেম্বরে এ,আই, টি থেকে মাস্টার্স কোর্স শেষ করে দেশে ফিরে আসি এবং (পুরনো চাকুরী ফিরে না পাওয়ার কারণে) আই সি ডি ডি আর ‘এ যোগ দেই।

সামান্য কয়েকদিনে পরিচয়ের সূত্রে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের জন্যে কি করতে পারে, তার উদাহরণ হিসেবেই এই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের অবতারণা। শুধু আমি নই, আমার মতো অনেকেই হক ভাই’এর সহৃদয়তায় ধন্য। আমি নিজেই এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী। লেখার কলেবর সীমিত রাখার স্বার্থে সেগুলো ভবিষ্যতের জন্যে তোলা থাকলো।

পি,এইচ, ডি শেষ করে হক ভাই জেদ্দার কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। জেদ্দা থেকে আবার তাগাদা - ওনার ডিপার্টমেন্টে জয়েন করার জন্যে। অবশেষে ঢাকার চাকুরী ছেড়ে চলে গেলাম জেদ্দা। সেখানে যাবার পর পুরো এক মাস ওনার বাসায় রাখলেন। (সে সময় ওনার কিডনির অসুখ ধরা পড়ে এবং পরবর্তীতে ওনার ছোট ভাই আলমগিরের দেয়া একটা কিডনি ওনার শরীরে ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা হয়)। একই ডিপার্টমেন্টে ওনার সাথে কাটালাম দশ বছর। উনিশ ‘শ অষ্টাশি তে উনি সিডনী পাড়ি দিলেন। ওনার পিছু পিছু আমিও সিডনীতে হাজির হলাম।

হক ভাই যেমন ছিলেন ধর্মপ্রাণ, তেমনি সংস্কৃতিমনষ্ক। এক কালে গান লিখতেন। ওনার লেখা “ঈদ এলো ঈদ এলো” গানটা জেদ্দা থাকতে অনেক বার শুনেছি। জেদ্দার বৈরী পরিবেশে ওনার বাসায় নিয়মিত গানের আসর বসতো। দামী-নামী শিল্পীরা হাজির থাকতেন সেখানে। ওনার ছেলে (রাণা) আর মেয়ে (সাথী) র জন্য অল্প বয়স থেকেই সঙ্গীত শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ওরা দু-জনেই ভাল গান করতো। রানা তবলাতেও ছিলো পারদর্শী। সিডনীতেও তাদের সংস্কৃতি চর্চা অনেকদিন অব্যাহত ছিলো।

এখানে আসবার পর হক ভাই’এর উদ্যোগের পরিসর বেড়ে যায়। আমাদের এখন হাতে হাতে ক্যামেরা, ভিডিও ক্যামেরা। দুই দশক আগে অবস্থা এমন ছিলো না। সে সময়, বাংলাদেশীদের আয়োজিত যে কোন অনুষ্ঠানে ভিডিও ক্যামেরা হাতে দেখা যেতো ওনাকে। সিডনীতে বাংলাদেশীদের বিবর্তনের ইতিহাস জানতে হলে ওনার ভিডিও আর্কাইভে হাত না দিয়ে উপায় নেই।

দিনে দিনে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সাহায্যের সাথে যুক্ত হয় সামগ্রিক সহায়তা। ব্ল্যাক-টাউন কাউন্সিলের বিভিন্ন উদ্যোগে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেই প্রয়াসের শুরু। ব্ল্যাক-টাউন কাউন্সিলের সাথে বাংলাদেশী অভিবাসীদের সেতুবন্ধন তিনি। সেই প্রয়াসের সীমানা দিনে দিনে ব্ল্যাক-টাউন কাউন্সিলের সীমানা পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা সিডনীতে – সারা দেশে। যতদূর মনে পড়ে, ব্ল্যাক-টাউন ‘এর বাইরে ওনার প্রথম উদ্যোগ, ম্যাকআর্থার গার্লস হাই স্কুলে ওয়েষ্টমিড শিশু হাসপাতালের সাহাযার্থে অনুষ্ঠিত সঙ্গীতানুষ্ঠান। এ' ছাড়া ব্ল্যাক-টাউনের একটা চার্চে তিনি বাংলাদেশের স্বনামধন্য শিল্পী কুমার বিশ্বজিতের একটা একক সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজনও করেছিলেন। এখানে ওনার সামগ্রিক উদ্যোগের কয়েকটা তুলে ধরছি।


ট্যালেন্ট ডে -

এখানকার বাংলাদেশী এস এস সি ও এইস এস সি পরীক্ষার্থীদের উৎসাহ দেবার লক্ষ্যে হক পরিবার উনিশ শ চুরানব্বই সাল থেকে “ট্যালেন্ট ডে” পালন করে আসছেন। নিউ সাউথ ওয়েলস এ প্রতি বছর যে সব ছাত্র ছাত্রী এস এস সি এবং এইস এস সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, তাদেরকে একটি বিশেষ দিনে আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরীক্ষার্থীদের মায়েরা সন্তানদের গলায় মেডেল ঝুলিয়ে দেন। বাবা মা রা সন্তানদের সম্পর্কে বলেন। বিভিন্ন পরিবারের সাথে জানাশোনা হয়। আমন্ত্রিত অতিথিরা মধ্যাহ্ন ভোজে আপ্যায়িত হন। উনিশ শ চুরানব্বই সাল থেকে শুরু করে গত বাইশ বছর হক পরিবার অব্যাহত ভাবে দিনটি পালন করে আসছেন।


অস্ট্রেলিয়া’স বিগেষ্ট মর্নিং টি –

ক্যান্সার কাউন্সিল - অস্ট্রেলিয়ার একটি বড় উদ্যোগ হচ্ছে “অস্ট্রেলিয়া’স বিগেষ্ট মর্নিং টি” বা অস্ট্রেলিয়ার সর্ববৃহৎ প্রভাতী চা। ব্যাপারটা নিয়ে বলার আগে ক্যান্সার কাউন্সিল সম্পর্কে একটা ভূমিকা দেয়া বোধ হইয় অসমীচীন হবে না। ক্যান্সার কাউন্সিল হচ্ছে, ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কাজে নিয়োজিত অস্ট্রেলিয়ার প্রধান বেসরকারি সংস্থা। অস্ট্রেলিয়ান ক্যান্সার সোসাইটি নামে এ প্রতিষ্ঠানটির জন্ম উনিশ শ একষট্টি সালে। উনিশ শ সাতানব্বই সালে প্রতিষ্ঠানটির নাম বদলে ক্যান্সার কাউন্সিল – অস্ট্রেলিয়া রাখা হয়। প্রতিটি ষ্টেটের জন্য এ সংস্থার আলাদা আলাদা শাখা রয়েছে।

ক্যান্সার কাউন্সিল প্রতিবছর মে মাসের একটি দিনকে এ উদ্যোগের দিন হিসেবে নির্ধারণ করে। এ দিনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা তাদের অফিসের চায়ের জন্য নির্ধারিত সময়ে একসাথে জড় হয় এবং বাড়ী থেকে নিয়ে আসা ঘরে তৈরি খাবার দাবার সহকর্মীদের কাছে বিক্রি করে। বিক্রয় লব্ধ অর্থ ক্যান্সার কাউন্সিলকে দান করা হয়। বিক্রি ছাড়াও, এ সময় অনেকে নগদ অর্থ দান করে থাকেন।

বাংলাদেশীদের মধ্যে ডঃ আবদুল হক ও তার স্ত্রী মিসেস লায়লা হক প্রথম এ মহতী উদ্যোগে নিজেদের হাত বাড়িয়ে দেন। দু হাজার সালে শুরু দু হাজার আট পর্যন্ত তারা পারিবারিক উদ্যোগে “অস্ট্রেলিয়া’স বিগেষ্ট মর্নিং টি” আয়োজন করে আসছিলেন। উনিশ শ নয় সাল থেকে ডঃ আবদুল হকের তত্বাবধানে প্রতিষ্ঠিত “বাংলাদেশ ফোরাম ফর কমিউনিটি এনগেজমেন্ট” এর দায়িত্বভার গ্রহণ করে। এ আয়োজন দু হাজার পাঁচ সাল পর্যন্ত ব্ল্যাক-টাউনেই পালন করা হতো। দু হাজার ছয় সাল থেকে গ্লেনফিল্ড, দু হাজার দশ সাল থেকে ল্যাকেম্বা এবং ২০১৩ থেকে মাস্কট এ উদ্যোগে ব্ল্যাক-টাউনের সাথে যোগ দিয়েছে।

বাংলাদেশীদের “অস্ট্রেলিয়া’স বিগেষ্ট মর্নিং টি” বাঙ্গালী কায়দাতেই অনুষ্ঠিত হয়। সকাল নটার দিক থেকে মিসেস লায়লা হকের নেতৃতে কিছু পরিবার ঘরে বানানো পিঠা, মিষ্টি নিয়ে টেবিল সাজিয়ে বসে যান। আবার কেউ কেউ চুলোয় পরোটা, ডাল-পুরী, ডিম ভাজতে শুরু করেন। কেউবা বাড়ী থেকে রান্না করে এক পাতিল সবজি নিয়ে আসেন। সকাল দশটা থেকে লোক আসতে শুরু করে।

সবাই এটা সেটা কিনে খান। বেশী চলে, পরোটা আর ডিম/সবজি। এদিকে ডঃ হক ক্যান্সার কাউন্সিল – অস্ট্রেলিয়া প্রদত্ত রশিদ বই নিয়ে বসে পড়েন চাঁদা তুলতে। যে যা পারেন, সাহায্য করেন। এ উদ্যোগে আজ পর্যন্ত তোলা চাঁদার পরিমাণ ১৫৩,৭০১ ডলার।


কোয়েকার্স হিল মসজিদ -

হক ভাই এই উদ্যোগ শুরু করেন রুটি হিল মসজিদে অনুষ্ঠিত মাসিক ধর্মীয় আলোচনা সভার মাধ্যমে। আলোচনার শেষে উপস্থিত সবাই যার যার সঙ্গতি মোতাবেক দান করতেন। এ ছাড়া মাঝে মাঝে পুরনো জিনিষের অকশন হতো। এভাবে বছরের পর বছর, মাসের পর মাস জমা-কৃত সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দানে জমে উঠে সামান্য কিছু তহবিল। সেই তহবিল এবং ব্ল্যাক-টাউন ও সংলগ্ন এলাকার মুসলমানদের অনুদানে একটা পরিত্যক্ত চার্চ কিনে স্থাপন করা হয় কোয়েকার্স হিল মসজিদ। মসজিদ স্থাপনের পরই ওনার কাজ শেষ হয়ে যায়নি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি দিবারাত্র মসজিদের উন্নয়নকল্পে কাজ করে গেছেন।


রিভারষ্টোন মুসলিম কবরস্থান –

এই কবরস্থানের সৃষ্টি থেকেই হক ভাই এর সাথে জড়িত ছিলেন। কবরস্থান রীতিমত পরিষ্কার করা, কবরস্থানের উন্নয়ন ও পরিবর্ধনের জন্য কাউন্সিলের সাথে যোগাযোগ রাখা, এসব কাজে হক ভাই ‘এর অবদান ছিল অনন্য।


ঢাকা আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল

হক ভাই ‘এর উদ্যোগে “বাংলাদেশি ফোরাম ফর কমুনিটি এংগেজমেন্ট” ঢাকা আহসানিয়া মিশন ক্যান্সার হাসপাতাল ‘এর জন্য ২৫০,০০০ হাজার ডলার সংগ্রহের অঙ্গিকার করেছেন। এ উদ্দেশ্যে তারা কয়েকটি ফান্ড-রেইজিং ডিনারের আয়োজন করেন।

এ ছাড়াও বাংলাদেশের বিভিন্ন মসজিদ, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিরতিহীন ভাবে সাহায্য করে গেছেন গত চার দশক ধরে।


রিটায়ারমেন্ট হোম

এটা ছিলো এই স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষটির সর্বশেষ স্বপ্ন। সিডনীর বয়োবৃদ্ধ বাংলাদেশীদের জন্য একটা পল্লী নির্মাণ। যেখানে বৃদ্ধ বয়সে সবাই শান্তিতে বসবাস করবে, সকল স্বাস্থ্য সুবিধা পাবে, আর নিশ্চিন্ত মনে ইবাদত বন্দেগীতে বাকী জীবন কাটিয়ে দেবে। এ জন্যে গত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এই প্রকল্পটা অসম্পূর্ণ রেখেই ওনাকে চলে যেতে হলো।

এই মেধাবী, পর-দরদী, অসাম্প্রদায়িক ধর্মপ্রাণ মানুষটি আজ আমাদের মাঝে নেই – এটা ভাবতেই কষ্ট হয়। কিছু ক্ষণজন্মা মানুষ এই পৃথিবীতে আসেন, যাদের জীবন কাটে পরার্থে। হক ভাই ছিলেন তেমন একজন মানুষ। মৃত্যু তাকে নিয়ে গেছে, কিন্তু তার অবিনশ্বর কীর্তির মাঝে তিনি যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন। পরম করুণাময় তার অনন্ত যাত্রার পথ কুসুমাস্তীর্ণ করুন, এই প্রার্থনা করি।




আহমেদ সাবের, সিডনি




Share on Facebook               Home Page             Published on: 14-Sep-2016

Coming Events:
বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে মেলার তারিখ ১ দিন পিছিয়ে ২১ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার) করা হয়েছে......




A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far