bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













“আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে”
দিদির (মহুয়া হক) প্রতি আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি
রিতা করীম



আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে ২৯শে জুলাই ২০২১ চলে গেছেন আমার দিদি, চিরদিনের মত ইহজগৎ থেকে আমাদের সবাইকে ছেড়ে আমাদের সবার প্রিয় ও পছন্দের মানুষ মহুয়া হক। চলে গেছেন এপারের মায়া ছেড়ে আমাদের সবাইকে চোখের জলে ভাসিয়ে পরপারে “উজ্জ্বল দাদা” অর্থাৎ তাঁর স্বামীর কাছে। নিশ্চয় অনেক ভালো আছেন সেখানে তিনি।

দিদির কথা বলে শেষ করা যায় না। দিদির পরিচিতি নূতন করে দেবার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। তাই একেবারেই আমার মনের কিছু কথা বলছি। যদিও তাঁকে ‘দিদি’ বলেই সম্বোধন করতাম, কিন্তু মায়ের মতই শ্রদ্ধা আর ভক্তি করতাম তাঁকে, আর তিনিও আমাকে মেয়ের মতই স্নেহ করতেন আর ভালবাসতেন।

সিডনিতে বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে দিদির অবদান অতুলনীয়। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড সংস্কৃতি-মনা। গানকে ভালবাসতেন মন প্রাণ দিয়ে। গান শোনা, গল্পের বই পড়া, সামাজিকতা, মানুষের উপকার করা আর দেশবিদেশে ভ্রমণ করা ছিল তাঁর নেশা। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর।

আমি, আমার হাজব্যান্ড ফজলুল করীম আর আমার বড় ছেলে মাহাথির (খুবই ছোট) আমরা সিডনিতে মাইগ্রেশন নিয়ে আসি ১৯৯০ সালের পঁচিশে ডিসেম্বর। আমার ছোট ছেলে মাহির জন্মাল তার কয়েক বছর পর। দিদির সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৯১ সালে সিডনিতে বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। স্টেজে বসে গান গাইছিলাম আমি, আর দেখতে পাচ্ছিলাম দর্শকদের প্রথম সারির ঠিক মাঝখানে খুব টিপটপ সুন্দরভাবে সাজগোজ করা এক ভদ্রমহিলা বসে খুব মনোযোগ দিয়ে আমার গান শুনছেন আর পাশে বেশ ভাব-গম্ভীর এক ভদ্রলোক মুজিব কোর্ট পরে বসে আছেন। ধরেই নিয়েছিলাম ঐ ভদ্রলোক হবেন বাংলাদেশের হাই কমিশনার আর ঐ ভদ্রমহিলা হবেন তাঁর স্ত্রী।

অনুষ্ঠান শেষে যখন বাড়িতে ফিরব, হঠাৎ দেখতে পাই সেই ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতে আমার দিকে এগিয়ে আসলেন, বললেন, “তোমার গান আমার খুব ভাল লেগেছে” এবং আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মুহূর্তের মধ্যেই মনে হল আমার মা’র কথা, কাছে থাকলে তিনিও ঠিক এমনিভাবেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আমার গানের প্রশংসা করতেন। সেই মুহূর্ত থেকেই দিদির উপরে আমার কেমন যেন একটা ভক্তি আর শ্রদ্ধা জন্মাল, তিনি আমার ফোন নাম্বার চেয়ে নিলেন আর বললেন তিনি আমার সাথে যোগাযোগ করবেন। তার কিছুদিন পরেই তিনি আমাকে ফোন করলেন। ভেবে পাচ্ছিলাম না কি বলে সম্বোধন করব উনাকে, তাই জিজ্ঞেস করে বসলাম, “আপনাকে কি বলে ডাকব?” তিনি বললেন, “তুমি আমাকে দিদি বলে ডেকো।” বেশ অনেকক্ষণ কথা হল। তারপর বললেন, “তোমাদের বাসায় একদিন আসব, তোমার গান শুনতে।” আমি বললাম, “নিশ্চয় আসবেন দিদি, কিন্তু আমি তো এখানে আসার সময় হারমোনিয়াম আনতে পারি নাই।” শুনে তো তিনি অবাক, বললেন, “কী, তোমার কোন হারমোনিয়াম নাই? ঠিক আছে আমি তোমাকে আমার হারমোনিয়াম দিব, তুমি যতদিন খুশি রাখতে পার, কিন্তু আমি চাই তুমি গান কর।” তারপর একটা ডেট দিয়ে বললেন, “তোমরা আমাদের বাসায় এসে আমাদের সাথে রাতে খাবে, আমাকে গান শোনাবে আর আমার হারমোনিয়াম সাথে করে নিয়ে যেয়ে নিয়মিত গানের চর্চা করবে।” অবাক আর অভিভূত হয়ে গেলাম দিদির উদারতা আর আন্তরিকতা দেখে। মনে হল, এমন মানুষ তো সচরাচর এযুগে দেখা যায় না। নিজেকে খুবই ভাগ্যবতী বলে মনে হল দিদির মত এত সুন্দর মনের অধিকারিণী একজন মানুষের সাথে পরিচিত হয়ে। তাঁর আচরণে বারবারই আমার মায়ের সাথে কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পেতে থাকলাম। অপরিসীম শ্রদ্ধা আর ভক্তি জন্মাল তাঁর প্রতি। তখন থেকেই শুরু হল দিদির সাথে আমার পথচলা, মেলামেশা আর ঘনিষ্ঠতা।


সিডনিতে বঙ্গবন্ধু পরিষদ আর বৈশাখী মেলার উদ্যোক্তা এবং প্রতিষ্ঠাতা হলেন দিদি আর তাঁর হাজব্যান্ড উজ্জ্বল দাদা (গাজী রুহুল হক উজ্জ্বল)। বঙ্গবন্ধু পরিষদ বছরে দুটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করত, তার একটা হল বৈশাখী মেলা আর আরেকটা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু বার্ষিকী আর আমি হয়ে গেলাম এই প্রতিষ্ঠানের একজন নিয়মিত সংগীত শিল্পী। বহু বছর ধরেই সিডনির SBS রেডিওতে বাংলাদেশ কম্যুনিটির অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন দিদি। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্মরণীয় দিন উপলক্ষে লাইভ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন, সেখানেও আমি হয়ে গেলাম তার নিয়মিত সংগীত শিল্পী। মিজানুর রহমান তরুণ আর আমি হচ্ছি সিডনিতে দিদির সবচাইতে পছন্দের সংগীত শিল্পী। অনেক অনুষ্ঠান তিনি আমাদের দুজনকে দিয়ে করিয়েছেন সিডনিতে। তাছাড়াও অনেক ছোটখাটো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দিদি আমাকে আর তরুণ ভাইকে গান গাইবার সুযোগ করে দিয়েছেন। এইভাবেই দিদি আমাকে অনবদ্য-ভাবে উৎসাহ দিয়ে যেতেন গান গাইবার জন্য আর রীতিমত বকা দিতেন নিয়মিত রেওয়াজ না করার জন্য। দিদির আয়োজনের শেষ গানের অনুষ্ঠান ছিল আমার আর তরুণ ভাইয়ের ২০১৯ সালে দিদির ৮০তম জন্মবার্ষিকীতে উনার ছেলে রাহুলের বাসায়। দিদির বাসায় যখনই যেতাম প্রায়ই তাঁর পছন্দের কিছু গান শুনিয়ে আসতাম।

দিদি আমাদেরকে সিডনীতে বসবাসরত উনার ছোট বোন কুমকুম দিদির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন, আর তাঁর কাছেও আমি হয়ে গেলাম তাঁর ভীষণ আপন আর কাছের মানুষ। এই দুই বোনের স্নেহ, মমতা আর ভালবাসা আমাকে সবসময় আগলে রেখেছে। আস্তে আস্তে উনাদের পরিবারের প্রত্যেকের সাথে আমাদের পরিচয় উঠাবসা শুরু হল। এইভাবে কখন যে আমরা উনাদের পরিবারের সদস্য ও পরম আত্মীয় হয়ে গেলাম বুঝতেই পারিনি। এই পরিবারের প্রতিটি সদস্যই যেন এক ভিন্ন জগতের মানুষ। এত ভালো আর অমায়িক ব্যবহার সবার যে বলে বোঝানো যাবে না। আর দিদির একমাত্র ছেলে রাহুলের কথা বলাই বাহুল্য, এত ভাল একটা ছেলে, মায়ের প্রতি এত যত্নবান এযুগে খুব কম ছেলেই দেখা যায়। দিদি চলে গেছেন কিন্তু দিদির পরিবারে আমার স্থানটুকু রাহুল ঠিকই অক্ষয় রেখেছে। আর তাইতো এই করোনা-কালীন সময়ের সীমিত ১০জন পারিবারিক সদস্যের মধ্যেও দিদির শেষ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আমাকে উপস্থিত থাকার সুযোগ করে দিয়েছে আর উনার কবরে ফুল আর মাটি দিবার সুযোগ করে দিয়েছে।

দিদি চলে যাবার দুদিন আগেও ভিডিও কলে দিদির সাথে আমার দেখা হয়েছে। কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছুদিন আগে আর সমস্ত শরীরও অবশ হয়ে গিয়েছিল। তাই শুধুই ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। মনে হচ্ছিল কত কথা তাঁর বলার ছিল আমাকে। মনে হয়েছিল আমার গলায় গাওয়া উনার সবচাইতে পছন্দের রবীন্দ্র সংগীতের কথা, “অনেক কথা যাওযে বলে, কোন কথা না বলি, তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি”।

দিদি চলে গেছেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে সুদূর কোন নাম না জানা দেশে কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর অফুরন্ত সুখস্মৃতি, স্নেহ, মমতা আর ভালবাসা।
দিদি,
“তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমা নিশীথিনী সম
মম জীবন যৌবন মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী সম”

দিদিকে তাঁর ঈশ্বর স্বর্গের সবচাইতে উচ্চতর আর শান্তিময় স্থানে ঠাই দেন এই কামনাই করি।


রিতা করীম, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
২৯ আগস্ট ২০২১






Share on Facebook               Home Page             Published on: 28-Aug-2021

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far