আনন্দঘন বিষণ্ণতা রেজা হোসেন
আজকের সকালটা বিষণ্ণ। ব্যক্তিগত কিছু কারণে মনটা খারাপ, তাই অফিসে পৌঁছেই বের হয়ে পাশের পার্কে গেলাম এক পেয়ালা কফি হাতে। শীতের সকাল। কেমন শির-শির বাতাস। পুরো রাস্তা জুড়ে শুকনো পাতা। অনিকেত (হোমলেস) কিছু মানুষ তাঁবু খাটিয়ে পার্কের রেলিং ঘেঁসে বাসা বানিয়েছে। কাছে গেলে হয়তো দেখতে পাবো- রেলিং-এ শাড়ী-লুঙ্গি শুকচ্ছে। পাখিগুলো অলস ভঙ্গিতে খুটে খুটে খাচ্ছে। কাছেই সেন্ট্রাল ইস্টিশান। একটু পর-পর যাচ্ছে রেলগাড়ি। তার সাথে জোড় দিয়ে যাচ্ছে ট্রাম; টিং-টিং ঘণ্টা বাজিয়ে। অফিস-গামী মানুষ পার্কটা আড়া-আড়ি পার হচ্ছে সময় বাচাতে। আর আমি; চায়ের পেয়ালা হাতে, একা; বিষণ্ণ।
বিষণ্ণতা আমাদের বাঙালিদের জন্মগত অধিকার। সামান্য মেঘ গুড় -গুড় করলে আমাদের মন 'কেমন' করে। বৃষ্টি নামলেই খিচুড়ি-ইলিশ। দুদিন আড্ডা দিতে না পারলে জীবন বৃথা যায় (অন্তত এই বিদেশে)। বাল্যে কবিতা লেখাটা আমাদের জাতীয় চরিত্র। এহেন মন-খারাপ করা সকালে যদি এমন একটা পার্কে বসি, তার চারিদিক এমনি-এমনিই বাঙালি প্রাকৃতিক নিয়মে বিষণ্ণতায় ঘিরে আসে। মনে পড়ছে এইসব 'মন-খারাপ' প্রায় হতো যখন প্রথম বিদেশ আসি। কেমন বিষণ্ণ লাগতো চারিদিক! এতো মানুষ তবু কেউ নিজের নয়। ইংরেজি বলতে পারিনা তখনো। তাই সবকিছু আরও দূরের মনে হতো। কোনো পার্কে একা বসে থাকলে মনে হতো - আহা - কোন বাদাম-অলা যদি এসে বিরক্ত করতো - 'মামা বাদাম নেন!' বিদেশ না আসলে জানতেই পারতাম না আমাদের দেশের সবকিছু এমন সুন্দর। এতো আপন। দেশে থাকতে খালি গালি দিতাম- 'চোরের দেশ এটা, এখানে লাইফে কিচ্ছু হবে না'। আর এখন মনে হয়- খালি দেশটা যদি একবার দেখতে পেতাম চোখ দিয়ে! ছুতে পারতাম যদি ভাই-বোনদের ইচ্ছে করলেই! খেতে পারতাম যদি শাহবাগ মোড়ে পরোটা-ডিম! একদম গরম-গরম! একবার এখানে বৈশাখী মেলায় কনসার্ট হচ্ছে। দেশ থেকে কোন এক শিল্পী এসেছেন। বেশ জমজমাট। একের পর এক বাংলা ঝাকানাকা চলছে; পুরো-দমে; বাপুরাম সাপুড়ে, মীরাবাঈ, বিজলী। সবাই মশগুল। হঠাৎ শিল্পী ধরলেন - 'ধন-ধান্যে পুষ্পে ভরা'। ধড়াম করে সবাই কেমন নরম হয়ে গেলো । কেমন চুপচাপ। যেন ফিসফিস করে গাচ্ছে। সবাই গাচ্ছি একসাথে। যেন একটা ক্ষুদ্র বাংলাদেশ। এই পর্যন্ত সব ঠিক ছিল। কিন্তু ঐ লাইনটা- 'তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে, ফুলের মধু খেয়ে'। সব উলট-পালট করে দিলো। কেমন করে উঠলো বুকের ভেতরটা, গলা ধরে আসলো আমার। পাশে চেয়ে দেখি - শুধু আমি না, মোটামুটি সবারই একই অবস্থা। কারো-কারো গাল বেয়ে পানি পড়ছে। লুকোবার চেষ্টা করছে কেউ কেউ। কেউ কেউ আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছে কেউ দেখছে না। আর একটা মেয়ে। সুন্দর মিষ্টি মেয়ে। মনে হয় সদ্য এসেছে দেশ থেকে। আর সামলাতে পারলো না। মুখ ঢেকে, হাউ মাউ করে মা! মা! করে কান্না জুড়ে দিলো। ওরে আমার আদরের 'চোরের' দেশরে... দেশ ছেড়ে থাকার 'না-পাওয়া' গুলো কিছুটা পুষিয়ে যায় অস্ট্রেলিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। ফুল যে কত রঙিন হতে পারে আমার ধারণা দেশের মানুষ তা জানতে পারে না বাতাসে ধুলার কারণে। এখানে প্রায় সব খানেই ছোট-বড় বেশ অনেকগুলো 'বোটানিক্যাল গার্ডেন'। সেগুলো দেখার মতো। দারুণ সুন্দর তাদের ফুল আর রঙ, দারুণ সুন্দর তার গাছ আর পাতা। আর প্রত্যেকটা ঋতু আসে তার নিজ নিজ সৌন্দর্য নিয়ে। দারুণ সুন্দর প্রত্যেকটা ঋতু। এখানে আবার বর্ষাকাল নেই। শীত কালেই বেশ খানিক বৃষ্টি হয় এখানে। ইংরেজি সমাজে বৃষ্টির দিন হচ্ছে 'বাজে-দিন' (শীটি-ডে)। কিন্তু আমার ভীষণ ভালো লাগে। বৃষ্টি হলেই সহকর্মী বন্ধু সাইমন-কে নিয়ে অফিসের নিচে চা খেতে যাই। অফিসের নিচের বারান্দাটা দারুণ সুন্দর। কয়েকটা খাবার দোকান আছে, সাথে কিছু সুন্দর-সুন্দর সোফা-টেবিল-চেয়ার; তারপর বাহিরের দিকের জায়গাটা নিচ থেকে ছাদ পর্যন্ত কাচের দেয়াল। একদম পুরটাই কাচের। আমারা দেয়াল ঘেঁসে, দু কাপ চা নিয়ে বসি। আর বৃষ্টির পানি দেয়ালের অপর দিকে জাপটা মারে। জন্মসূত্রের প্রভাবে ঘন হয়ে আসে মন। চুপ করে থাকা কঠিন হয়ে উঠে। অগত্যা বাংলাতেই রবি বুড়োর অনেক কবিতা শুনিয়ে দেই সাইমনকে। সে হাসে। বাংলা কবিতা না বুঝলেও আবৃতির ঝংকারটুকু তাঁকে মুগ্ধ করে। বলে- 'তোমার আনন্দ-ঘন ভাব দেখে বুঝতে পারছি, সুন্দর কবিতা; তোমার লেখা?'। বলি - 'না, সে এক মাথা খারাপ করা বুড়ো ছিলেন আমাদের বাংলায়। তিনি এখন বেঁচে নাই, কিন্তু তার ভূত তাড়ানো যাচ্ছে না বাঙালির মাথা থেকে কিছুতেই'। সে বিস্মিত হয় 'এতো দিনেও তোমাদের সাহিত্যের টেস্ট বদলায়নি?' বলি 'বদলেছে কিছুটা, কিন্তু বুড়ো ছিলেন অনেক এগিয়ে'। এখন বাদলার দিনে চা খাওয়াটা প্রায় একটা রীতি হয়ে গেছে আমাদের। আকাশ কালো করে আসলেই সাইমন চলে আসে আমার ডেস্কে, বলে- 'চলো! এক রাউন্ড কবিতা হয়ে যাক!' আমি মুচকি হেসে বলি - 'আলবৎ!
রেজা হোসেন, সিডনি - rezaru2000@yahoo.com
|