bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













ভদ্র কে? ভদ্রতা কি আদৌ সম্ভব?
রিয়াজ হক



‘আদর্শ লিপি’ দিয়ে শুরু হয়েছিল আমাদের জীবন; আমাদের শৈশবের শিক্ষা। সীতানাথ বসাক প্রণীত বইটির পুরো নাম ছিল ‘আদর্শ লিপি ও সরল বর্ণ পরিচয়’। ১২ পৃষ্ঠার পাতলা নিউজ প্রিন্টের একটি অতি সাধারণ বই। বইটির না ছিল কোন চাকচিক্য না ছিল কোন জৌলুস; কি ভেতরে, কি বাইরে । কিন্তু বইটিতে ছিল জীবন গড়ে দেওয়ার মত কিছু বাণী। সকাল আর সন্ধ্যায় মেঝেতে মাদুর পেতে বা শোয়ার চকিতে পদ্মাসনে বসে বাবা-মা বা বড় ভাই-বোনের তত্ত্বাবধানে আমরা সুর করে পড়তাম।

স্বরে ‘অ’। ‘অ’ তে অজগর ঐ আসছে তেড়ে-

স্বরে ‘আ’। ‘আ’ তে আমটি আমি খাব পেড়ে। ইত্যাদি। আদর্শ লিপিতে স্বরবর্ণ ছিল ১৫টি। একটি স্বরবর্ণ ছিল ৯ (নয়) এর মত যাকে আমরা বলতাম ‘লী’ (৯)। এখনকার প্রজন্মের এসব জানার কথা নয়। আর ব্যঞ্জন বর্ণ ছিল ৪১টি।

বর্ণ পরিচয় শেষ হলেই বাক্যের গঠন ও বাক্যের পাঠ শুরু হত। আমরা যেসব অমূল্য বাক্য তখন পড়েছি তার কিছু এখনও স্মৃতিতে ভাস্বর। যেমনঃ

‘সদা সত্য বলিবে’, ‘কদাচ মিথ্যা বলিও না’ ‘মিথ্যা বলা মহাপাপ’, ‘আলস্য দোষের আকর’।

‘কটু বাক্য বলা অনুচিত’, ‘কুকথায় কর্ণপাত করিওনা’, ‘কাহাকেও কুপরামর্শ দিওনা’।

‘অসৎ সঙ্গ ত্যাগ কর’, ‘সৎপথ অন্বেষণ কর’, ‘পরোপকার মহাব্রত’। ইত্যাদি।


বাক্যের পরপরই ছিল ‘শ্রুতি বাক্যের পাঠ’। যেমনঃ

“খেলায় মজিয়া শিশু কাটাইওনা বেলা / সময়ের প্রতি কভু করিও না হেলা”।


ছিল ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের কবিতাঃ

“আপনাকে বড় বলে বড় সেই নয় / লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়”।


ছিল মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুর প্রার্থনা’ কবিতাটিঃ

“সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি / সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি…………”।


দিনে সূর্যের আলো আর সন্ধ্যায় বা রাতে কুপি তথা সলতে-প্রদীপ বা হ্যারিকেনের আলোয় ছিল আমাদের শৈশবের পড়ালেখা। আমরা মা-বাবার শক্ত আদেশ ও রক্তচক্ষুর দিকে তাকিয়ে খুব ভোরে ঘুম কাতুরে চোখে মক্তবে যেয়ে ‘কায়দা’ পড়েছি বোঝার বা আনন্দের জায়গা থেকে নয়, সম্পূর্ণ ভক্তির জায়গা থেকে। কারণ আরবী আমাদের জন্য মাতৃভাষার বাইরের এক বিদেশী ভাষা। তবে যেহেতু এ ভাষার মধ্য দিয়েই এসেছে আমাদের ধর্ম তাই তার প্রতি আমাদের সবার ছিল এক গভীর ভক্তি-ভাব।

এখন যখন পিছন ফিরে তাকাই তখন দেখি আমাদের জীবনের বহু আদর্শ, নীতি বা শিক্ষা গড়ে দিয়েছিল আমাদের শৈশব-কৈশোর জীবনের নানা পাঠ ও বিশেষ করে আমাদের পরিবার। শ্রেণী বা ধাপ বিন্যাসে ধর্মের অবস্থান ছিল সেখানে পরে। এখন অ-ধর্মের (অসততা, দুর্নীতি ইত্যাদি) পথে চলা মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে বলে ধর্ম (Religion) নিয়ে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে মাতামাতি শুরু হয়েছে একেবারে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে। তখন সু-ধর্মের (নীতি-নৈতিকতা ইত্যাদি) পথের লোকের সংখ্যা বেশি ছিল বলে ধর্ম নিয়ে তেমন মাতামাতি বা হৈ-চৈ ছিল না। এখন সবাই সবাইকে কেবল ধর্ম শিক্ষা দিতে চায়! বাইবেল হাতে, কি ট্রাম্প, কি এরদোগান সহ মোদী রূপী ধার্মিক থেকে শুরু করে রাম-রহিম, যদু-মধু সবাই!

আমাদের নিজেদের বড় চিন্তা, দেশ বা সমগ্র মানব জাতির জন্য কিছু করা, উদ্যোক্তা হওয়া, উদ্ভাবনী- সৃষ্টিশীল কোন কিছুর জন্য জীবন-সাধনায় ব্যাপৃত হওয়ার বদলে আমরা ক্ষুদ্র গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়-গত চিন্তায় আজ বিভোর। বিল গেটস বা স্টীভ জবস এর আবিষ্কার বা প্রযুক্তি দিয়ে নিজ নিজ সম্প্রদায়-গত বিশ্বাসকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে আমরা যার পর নাই কাতর কিন্তু তাদের চিন্তা, চেষ্টা ও সাধনার কানাকড়িও নিজের মধ্যে নিতে বা প্রয়োগে আমাদের কোন আগ্রহ নেই। অন্ধ কূপের এমনই সঙ্কীর্ণ জীবন ও দৃষ্টিভঙ্গিতে আজ নিজেদের নিক্ষেপ করেছি আমরা।

সাম্প্রতিক কালে, বিশেষ প্রয়োজনে চীনা জাতির ইতিহাস নিয়ে কিছু পড়াশুনা করতে যেয়ে এক পর্যায়ে পেলাম যে, এ জাতিকে বুঝতে হলে তোমাকে এ জাতির আদর্শের ধারক-বাহক কনফুসিয়াস (Confucius) কে বুঝতে হবে। এটা অনেকটা কান টানলে মাথা আসার মত আর কি! কনফুসিয়াস কে পড়তে, বুঝতে ও দেখতে যেয়ে উপলব্ধি করলাম যে, সে এক মহাকাব্য। এর কোন শেষ নেই। ভাবতে অবাক লাগে যে কনফুসিয়াসের জন্ম (খৃষ্ট পূর্ব ৫১১-৪৭৯) হয়েছিল সক্রেটিসেরও (খৃষ্ট পূর্ব ৪৭০-৩৯৯) আগে। কনফুসিয়াস যখন মারা যান সক্রেটিস তখন নয় বছর বয়সের কিশোর। কনফুসিয়াস ‘পরিবার’ কে রাষ্ট্রের একক ধরে তার ভিত্তিতে সাজিয়েছিলেন তার জীবন দর্শন।

পরিবার কে সংহত করতে তিনি তাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন শিয়াও (Xiao) বা Fillial Piety নামে। যার অর্থ আমার দেহ, ত্বক, চুল সমেত সবই আমি পেয়েছি আমার পিতা মাতা থেকে। তাকে সংরক্ষণের দায়িত্বও আমার। পিতা মাতার সঙ্গে সৌজন্যমূলক আচরণ, তার যত্ন নেওয়া, যে কোন প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানো আমার জন্য অবশ্য কর্তব্য। জীবিত অবস্থায় যেমন তেমনি মৃত্যুর পরও তাদের উদ্দেশ্যে গভীর ভাবে শ্রদ্ধাবনত হওয়া ও পূর্ণ সম্মানের সঙ্গে তাদের বিদায় জানানোও আমাদের দায়িত্ব। ঘরের বাইরে অন্যদের সঙ্গে ন্যায়সঙ্গত আচরণও আমার দায়িত্বের অংশ। কারণ এর মাধ্যমেই মানুষ আমাকে ও আমার পিতামাতার পরিচয় পাবে। আমি এমন কোন আচরণ ও কাজ করব না যা আমার পিতা মাতার জন্য কষ্ট ও অনুশোচনা বয়ে আনে বা তাদের পরিচয়কে ধিক্কৃত করে। কনফুসিয়াস ভাবতেন যে পুত্রের ভূমিকায় একজনকে আদর্শায়িত করা গেলে একদিন সে বড় ভাই, স্বামী ও বাবার ভূমিকায়ও আদর্শ মানুষ হিসেবে উপস্থিত হবে। তার লক্ষ্য ছিল সমাজের মধ্যে আনুগত্য, সহযোগিতা ও আদর্শের বীজ বপন করে সমাজকে নৈতিকতার উঁচু সোপানে নিয়ে যাওয়া যেখান থেকে শাসকরাও ন্যায়ের বন্দনা করবে ও ন্যায়ানুগ শাসনের পথে হাঁটবে।

পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতরের সম্পর্ক গুলোকে তিনি পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন।

এক। শাসক-শাসিতের বা ঊর্ধ্বতন-অধস্তনের সম্পর্কঃ শাসক বা ঊর্ধ্বতন কে হতে হবে হিতৈষী বা কল্যাণকামী। নীতিমালা ও আইনের সেরা রক্ষক। অন্যদিকে শাসিত বা অধস্তন কে হতে হবে বিশ্বস্ত ও সেবা দানকারী।

দুই। পিতা-পুত্রের সম্পর্কঃ পিতা তার সন্তানকে ভালোবাসবেন ও তাকে যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করবেন। অন্যদিকে সন্তান তার পিতার প্রতি বাধ্যতা মূলক আচরণে বাধ্য থাকবে।

তিন। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কঃ স্বামী যে কোন বিচারে ভাল হবেন। স্বচ্ছ ও যৌক্তিক আচরণ করবেন। স্ত্রী হবেন অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন ও সহানুভূতিশীল।

চার। বড় ভাই-ছোট ভাইয়ের সম্পর্কঃ বড় ভাই ছোট ভাইয়ের প্রতি সৌজন্য মূলক আচরণ প্রদর্শন করবেন। ছোট ভাই হবেন বড় ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।

পাঁচ। বন্ধুর সাথে সম্পর্কঃ কনফুসিয়াস বলছেন, “সমতা ও সম মর্যাদা বন্ধুত্বের পূর্ব শর্ত”। তার মতে, বন্ধু হল সে যে তোমাকে সব কাজে শুধু সমর্থনই দিবে না প্রয়োজনে সতর্কও করবে। বন্ধু হবে নির্ভরতার প্রতীক যেমন তীব্র শীতের দুঃসময়েও পাইন ও সিপরিস গাছের পাতা থাকে মোহনীয় সবুজ।

কনফুসিয়াস কে তার এক শিষ্য জিজ্ঞেস করেছিল, সম্পন্ন বা ভদ্র কে? বা ভদ্রলোক কাকে বলব?

কনফুসিয়াস তার উত্তরে বলেছিলেন, ভদ্রলোক (Gentleman) হচ্ছে উচ্চ আদর্শের লোক। সম্পন্ন বা ভদ্রলোক হল সে যার জীবনের চিন্তা ও চলার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আছে, যার জীবনে আছে বিশেষ পাঁচটি সৎ-গুনের সমাবেশ। তা হলঃ

এক। বদান্যতা বা দয়াশীলতা (Benevolence)

দুই। ভালোবাসা (Love)

তিন। সমবেদনা বা সহানুভূতিশীলতা (Kindness / Compassion)

চার। মানবতা বা মানবিকতা (Humanness)

পাঁচ। উদারতা বা মহানুভবতা (Magnanimity)

কনফুসিয়াসের নিজস্ব কিছু উক্তিতে জীবনের ক্ষেত্রে আমাদের যা শেখার আছে তা হলোঃ

এক। Everything has its beauty, but not everyone sees it.
(প্রত্যেক বস্তুর ভেতরই সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। কেবল আমাদের একটি অনুসন্ধিৎসু মন চাই তা দেখবার জন্য।)

দুই। The strength of a nation derives from the integrity of the home.
(একটি জাতির শক্তি ও সমৃদ্ধির শুরু পরিবার থেকে। তাই আমাদের পরিবার কে আমাদের ঠিক করতে হবে।)

তিন। Wherever you go, go with all your heart.
(আপনি যাই করেন না কেন তা হৃদয় দিয়ে করুন। সবকিছুতে আপনি শতকরা একশ ভাগ দিন।)

চার। It doesn’t matter how slowly you go as long as you do not stop.
(পথে নেমে আপনি যত আস্তেই পথ চলতে থাকুন না কেন যদি আপনি থেমে না যান তবে একসময় আপনি আপনার গন্তব্যে পৌঁছে যাবেনই। কাজেই থেমে যাবেন না। চলতে থাকুন।)

পাঁচ। If I am walking with two other men, each of them will serve as my teacher. I will pick out the good points of the one and imitate them and the bad points of the other and correct them in myself.
(আমাদের সহযাত্রী বা আশে পাশের প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে আমাদের শেখার আছে অনেক কিছু। তারাই আমাদের শিক্ষক। আমাদের দায়িত্ব হল তা লক্ষ্য করা ও শেখা।)

ছয়। Better a diamond with a flaw than a pebble without.
(একটি মসৃণ চকচকে পাথর হওয়ার চেয়ে একটি অমসৃণ ত্রুটি যুক্ত হীরের টুকরো হওয়াতেও গৌরব। অর্থাৎ চেষ্টা করুন টেকসই মূল্যবান কিছু হওয়ার।)

সাত। Silence is a true friend who never betrays.
(নীরবতা বন্ধুর মতই সুন্দর ও আদরণীয়। নীরবতা জীবন কে জীবনের অর্থ খুঁজে নিতে সাহায্য করে।)

আট। Learning without thought is labour lost; thought without learning is perilous.
(চিন্তাহীন শিক্ষা শ্রমহীন অকেজো জীবনের সমতুল্য। অন্যদিকে শিক্ষা ছাড়া অর্থহীন চিন্তা বিপদজনক।)

নয়। Imagination is more important than knowledge.
(জ্ঞানের চেয়ে মূল্যবান হচ্ছে মানুষের কল্পনা শক্তি। কল্পনা শক্তি মানুষকে নতুন জিনিষ উদ্ভাবনের পথে নিয়ে যায়। )

দশ। A good man does not give orders, but leads by example.
(একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ কেবল নির্দেশ প্রদান করে বসে থাকে না। সে কাজে নেমে পড়ে উদাহরণ তৈরি করে। কথা ও নির্দেশনার চেয়ে বড় হল কাজে নেমে পড়া। কাজই মানুষ কে এগিয়ে দেয়।)





রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া, Jsfn21@gmail.com






Share on Facebook               Home Page             Published on: 16-Oct-2020

Coming Events: