উল্টো পিঠের সোজা কথা (১৪) রিয়াজ হক
এ সময়ের বাঙলা টিভি নাটকের জীবন, জীবনের নাটক
ছেলেটিঃ কেমন আছে ময়না পাখি? মেয়েটিঃ ভাল, আপনি? ছেলেটিঃ ভালোই, তবে রাতের ডিনারটা ভাল হয়নি। মেয়েটিঃ কেন? ছেলেটিঃ আপনাকে বলেছিলাম আমার মা নেই। বুয়ার হাতের রান্না খেতে আর কতদিন ভাল লাগে? তবে জানেন আমাদের বুয়ার হাতের রান্না কিন্তু অদ্ভুত। মেয়েটিঃ কি রকমের? ছেলেটিঃ মাঝে মাঝে খুব ভাল রান্না করে, মাঝে মাঝে খুব বিশ্রী। মেয়েটিঃ তাহলে এক কাজ করেন, আপনি বিয়ে করে ফেলেন।
এ হল গত বছর ঢাকার টিভি তে প্রচারিত একটি নাটকের (নাম-পাশাপাশি ব্যবধান, রচনা-সাইফুর রহমান কাজল, প্রযোজনা- সুরাঞ্জলি, পরিচালনা-বি.ইউ.শুভ, পরিবেশনা-রিং আইডি) শুরুর দৃশ্যে নায়ক-নায়িকার কথোপকথন। যাকে বলে টেলিফোন চ্যাট। যদি প্রশ্ন করা যায় যে নাটকের এ খণ্ডিত জীবন চিত্রায়নের মাধ্যমে আম দর্শকের সামনে সমাজের কি ছবি উপস্থাপিত হচ্ছে? উত্তর খুব সোজা। রাজধানী শহরের সুবিধাভোগী উচ্চবিত্ত পরিবারের একজন প্রকৌশলী তরুণের অন্যতম সমস্যা সুস্বাদু খাবারের অভাব যা খুবই অতিরঞ্জন ও হাস্যকর। বিজ্ঞান, প্রযুক্তির ও শিল্পের (আর্টস) অভূতপূর্ব উৎকর্ষের এই যুগে সমাজ কে জানান দেওয়া হচ্ছে যে রান্নার দায়িত্ব কেবলমাত্র জায়া ও জননীর। মা নেই; রান্নার/খাবারের কষ্ট; বিয়ে করে বউ ঘরে নিয়ে আসেন! সেই বদ্ধ অতি পুরনো জং ধরা চিন্তার মাঝে এখনও আটকে আছে আমাদের বিবেচনাহীন বোধ ও বিশ্বাস। আর তাই সগৌরবে প্রচার করা হচ্ছে আমাদের জনপ্রিয় মিডিয়া মাধ্যম টিভির নাটকে।
এরকম অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া যাবে আমাদের দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত নানা নাটক থেকে। ইউটিউবে ভিউ সংখ্যার দিক থেকে উপরে এমন দশটি নাটক যদি আপনি বিবেচনা করেন তবে দেখবেন সেসব নাটকে আমাদের জীবনের চিত্রায়ন মর্মান্তিক ভাবেই হতাশা জনক। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা বাস্তবতা বিবর্জিত, বানানো বা আরোপিত।
এক্ষেত্রে অবশ্য ২০১৭ সালে নির্মিত ও প্রচারিত ‘বড় ছেলে’ নামের টিভি নাটক টিকে ব্যতিক্রম হিসেবে ধরতে হবে। মিজানুর রহমান আরিয়ান পরিচালিত এ নাটকটিতে অবসর প্রাপ্ত এক স্কুল শিক্ষকের নিম্নবিত্ত পরিবার, সংসারের হাল ধরা বড় ছেলে রাশেদ ও তাদের প্রতিদিনের জীবন যুদ্ধকে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে চিত্রায়ন করা হয়েছে। উচ্চ বিত্ত পরিবারের কন্যার প্রেম যেখানে পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে ‘বড় ছেলে’ রাশেদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে নিজ পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার মাধ্যমে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এ রকম নাটকের উদাহরণ খুবই কম।
দর্শক সংখ্যার দিক থেকে ‘ইউটিউব’ এ বিশ মিলিয়ন ভিউ ছাড়িয়ে গেছে এমন একটি নাটক হল ‘এক্স বয়ফ্রেন্ড’। কাজল আরেফিন অমির একক প্রতিভার গল্প, চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় সিদ্ধ এ নাটক। দেখলে মনে হবে আপনি অন্য কোন গ্রহের মানব-মানবীদের দেখছেন। এখানে বাংলাদেশ (রক্তের আঁখরে লেখা যার মানচিত্র), দেশের মানুষ (অদম্য সাহসী ও প্রতিনিয়ত সংগ্রাম মুখর), তাদের জীবনাচরণের (ত্যাগ-তিতিক্ষা, স্বপ্ন-আরাধনা-বিশ্বাস) কোন চিহ্ন খুঁজে পাওয়া মুশকিল। মাটি ফুঁড়ে উদ্ভূত তিনটি গায়েবি চরিত্র (রায়েন-আফরান নিশো, নাহিয়া-তানজিন তিশা, ফারিন-তাসনিয়া ফারিন), যাদের কোন পরিবার বা সমাজ বলে কিছুই নেই, কেবল তাদের অনিয়ন্ত্রিত-অযৌক্তিক আচরণ-আস্ফালনে তারা পর্দায় স্থূল রুচি ও বিরক্তি উৎপাদনে তৎপর। এরা রাস্তায়-পার্কে-শপিং মলে অনবরত ঘুরে বেড়ায়, বাজে বকে সাথে নায়ক ক্রমাগত ধূম উদগীরন করে। এই হল তাদের নিত্য-জীবন। এ জীবনে বাবার শাসন, মায়ের-বোনের স্নেহ, জীবন-সাফল্যের পথে দুঃখ অতিক্রমের অবিরত চেষ্টা, তাতে সাথী-সমব্যথী হয়ে বন্ধু প্রেমিক-প্রেমিকার পথ চলা ও স্বতন্ত্র ভাবে প্রত্যেকের নিজের নিজের জীবন সংগ্রামের কিছুই নেই।
মোটা অঙ্কে কাহিনী হল, অর্থহীন বোকা চেহারা, অবিন্যস্ত চুল, কাতুকুতু হাঁটা-চলায় উদ্ভট ভাবে টিভি স্ক্রিনে উপস্থাপিত ‘বয়ফ্রেন্ড’ আফরান নিশো এক আধুনিকার (তিশা) সাথে প্রেম-প্রেম খেলায় মত্ত। যে প্রেমে কেবল শরীর দেখার মোহ, নেই বুদ্ধির-আবেগের কোন গভীরতা, নেই হৃদয়জাত স্পর্শের কোন আঁচ। অথচ সে প্রেমকেই মহান করে দেখাতে চাচাত বোন ফারিনের আমদানি। নিশো তাঁর প্রেমের তীব্রতা বোঝাতে ফারিনের সঙ্গে প্রেমের নাটক মঞ্চায়ন করে তিশার ভেতরে তাকে ছেঁড়ে যাওয়ার জন্য অনুশোচনার জন্ম দিতে চায়। এ জন্য নিজেকে পরিবর্তন করতে সে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত চলে আসে এম বি এ করতে। প্রশ্ন হল গবেট-রূপের ঐ ধরনের একটা ছেলে কি চাইলেই তা পারে? আর অস্ট্রেলিয়ায় আসলেই কি স্বয়ংক্রিয় ভাবে রাতারাতি মৌলিক জীবনযাপনের পরিবর্তন ঘটে যাবে? জীবনের পরিবর্তন কি এত সহজ?
এ নাটকের ডায়ালগ কতটা স্থূল রুচির তার একটি উদাহরণ দেই; তিশা যখন নিশো কে অতীতে অবহেলার জন্য গল্পকার-পরিচালক কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে ‘স্যরি’ বলার জন্য নিশোর বাসস্থানের মেইন গেটের সামনে হাজির হয় তখন এক পর্যায়ে নিশো বলতে থাকে; “অই, তুই আমায় ধরলি কেন? তুই আমায় ধরলি কেন? কি, ধরাধরি করতে ভাল লাগে? চল, উপর চল। ধরাধরি করি, উইদাউট কমিট্মেন্ট, কেউ কোন কিছু জানবে না......” ইত্যাদি ইত্যাদি। নাটকে একটি গান আছে, “উড়ু উড়ু মনটা/বেজে গেছে যে তোর ঘণ্টা”। নাট্যকার আসলে প্রকারান্তরে টিভি নাটকেরই বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। এর নাম হল বিকৃত তথা অপ-সংস্কৃতির তোষণ, প্রচার ও প্রসার।
তারপরও এ ধরনের নাটক গুলো বিপুল সংখ্যায় দর্শক-আদৃত হচ্ছে, কেন? এ প্রসঙ্গে আমার অত্যন্ত প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ এর একটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ লেখার স্মরণ নিতে পারি। ‘লেখক ও জনপ্রিয় লেখক’ নামের তার এক প্রবন্ধে তিনি বলছেন, “প্রেমের অগভীর ফেনিল আবেগ-উচ্ছ্বাস, বিশেষ করে প্রথম যৌবনের মিষ্টি রঙিন প্রেম, এর অপার্থিব সুখ ও অকথ্য যন্ত্রণা, এর সুনীল স্বপ্ন জগত ও নরম কোমল আবেশ আপামর পাঠকের খুবই প্রিয় জিনিস। একে পুঁজি করে একজন লেখকের পক্ষে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছানো সম্ভব” (‘সেরা লেখা। দ্বিতীয় খণ্ড। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। পৃষ্ঠা-২৪৯)। আর একথা আমরা কে না জানি যে জনপ্রিয় লেখক মানেই সেরা বা শ্রেষ্ঠ লেখক নন। নাটকের ক্ষেত্রেও তাই। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ইতিহাসের জনপ্রিয় ছবির নাম ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’। অন্যদিকে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ ছবিটি দর্শক অভাবে হল থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল। তার অর্থ এই নয় যে ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’ শিল্প মানে উত্তীর্ণ একটি ভাল বা শ্রেষ্ঠ ছবি!
এ সময়ের শতকরা আশি ভাগ টিভি নাটক দেখে আপনার এই প্রতীতি জন্মাবে যে সদস্য সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশের পরিবার গুলো সব ভঙ্গুর-পঙ্গু। বাবা আছে তো মা নেই, মা আছে তো বাবা নেই। কোথাও কোথাও বাবা-মা কেউ নেই। ভাই-বোন নেই, থাকলেও একজন যা কোন ভাবেই বাংলাদেশের প্রকৃত পরিবার-সমাজের বাস্তবতা কে প্রকাশ করে না। কাহিনীগুলো সব সুবিধা প্রত্যাশী মধ্য ও উচ্চ বিত্তের বিলাসী প্রেম-প্রীতির ছিঁচকাঁদুনে গল্প দিয়ে ভরা। আর এসব নাটকের কিছু নাম দেখুন, তাহলে বুঝবেন কেন ভাষার জন্য বাহান্ন’র শহীদদের রক্ত দেওয়া আজ বৃথায় পর্যবসিত হতে যাচ্ছে বললেও কম বলা হবে।
দ্য লাভ স্টোরি, আনটোল্ড লাভ স্টোরি, সুইট লাভ স্টোরি, আই হেট লাভ স্টোরি, ওল্ড লাভ স্টোরি, এনাদার লাভ স্টোরি, এম প্লাস এন লাভ স্টোরি, নাইন্টিন নাইন্টি লাভ স্টোরি, ওয়ান সাইডেড লাভ স্টোরি, দ্য এন্ড অভ এ লাভ স্টোরি এসবই বাংলাদেশের টিভি নাটকের নাম। এ রকম নাম অসংখ্য। আমাদের বাংলা ভাষা কি বিত্ত-বৈভবে, মানে-মর্যাদায় এতই দরিদ্র হয়ে পড়েছে যে অহেতুক অন্য ভাষায় তার প্রকাশ ঘটাতে হবে? এসবই কি এক ধরনের হীনমন্যতা বোধ থেকে আসছে না!
আমাদের টিভি নাটকের চরিত্রাভিনেতা-অভিনেত্রীরা প্রতিভায় কোন অংশেই কম নন। অভিনয় কুশলতায় তারা তাদের মেধার স্বাক্ষর রাখছেন। এ সময়ের অতি ব্যস্ত যেসব তারকারা (আমি ইচ্ছে করেই একটু সিনিয়র যারা যেমন, চঞ্চল চৌধুরী, মোশাররফ করিম, নুসরাত ইমরোজ তিশা, জাকিয়া বারী মম প্রভৃতিদের বাদ রাখছি) যেমন আফরান নিশো (যোগ বিয়োগ, এই শহরে, মিস শিউলি প্রভৃতি), জিয়াউল ফারুক অপূর্ব (বড় ছেলে, ২২শে এপ্রিল, আপনার ছেলে কি করে প্রভৃতি), মেহজাবিন চৌধুরী (বড় ছেলে, এই শহরে প্রভৃতি), তানজিন তিশা (অবুঝ দিনের গল্প) তাদের প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়েছেন ব্রাকেটে উল্লিখিত এরকম বেশ কিছু নাটকে । অবুঝ দিনের গল্পে একটি এক রোখা অবুঝ কিশোরী হৃদয়ের চাওয়া-পাওয়ার আর্তনাদ কে অবিস্মরণীয় মুগ্ধতায় ফুটিয়ে তুলেছেন তিশা। কিন্তু এই এরাই যখন আবার গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়া নাটক গুলিতে তাদের অখণ্ড সময় ও শ্রম দেন তখন একে নিদারুণ অপচয় ছাড়া আর কি বলা যায়। এসব করে হয়ত তাদের অর্থের প্রাপ্তি যোগ ঘটছে কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে তাদের অভিনয় প্রতিভা, বঞ্চিত হচ্ছে দর্শক, সংস্কৃতি হারাচ্ছে তার রূপ, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য।
আমাদের টিভি নাটকের একটি ঐতিহ্য আছে। আমরা দেখেছি ‘মুখরা রমণী বশীকরণ’,সংশপ্তক, রক্তকরবী, নিথুয়া পাথার কান্দে, বাবার কলম কোথায়, বরফ গলা নদী, ইডিয়ট, সকাল সন্ধ্যা, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি, যত দূরে যাই, নক্ষত্রের দিনরাত্রি, খেলা প্রভৃতি। এসব নাটকে আমাদের সমাজ-জীবনের চিত্রায়ন ঘটেছে। আমরা আমাদেরই দেখেছি;, আমরা আমাদের কথা শুনতে পেয়েছি। তা নিয়ে ভেবেছি ও আবেগে আপ্লুত হয়েছি। কিন্তু এ সময়ের টিভি নাটকে আমাদের জীবনের চিত্রায়ন খুবই কম। এখন যা দেখছি তার অনেক কিছুই আমাদের নয়; তা এতোটাই সংযোগ হীন, কৃত্রিম ও অনাবশ্যক যে মনে হয় আমরা যেন হারিয়ে ফেলেছি আমাদের চিরচেনা নিজস্ব গন্তব্য। তাই আজ মুক্ত কণ্ঠে বলতে ইচ্ছে করে, আমরা এরকম উদ্ভট নাটকের জীবন চাই না, চাই নিজেদের জীবনের নির্মল নাটক।
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া Jsfn21@gmail.com
|