উল্টো পিঠের সোজা কথা (১৩) রিয়াজ হক
একজন পুরুষ সমান তিনজন মহিলা!
স্যার বললেন, “লেখ, একজন পুরুষ সমান তিনজন মহিলা”।
আমার মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না যে এটা কি করে সম্ভব হয়! দুজনই মানুষ। মানুষ হিসেবে একজন তো আরেক জনের সমান। হোক না তা পুরুষ বা মহিলা!
আমি ইতস্তত করে দাঁত দিয়ে পেন্সিল কামড়ে ধরে, স্যারের সামনে প্রথম সারির বেঞ্চেই বসে ছিলাম। স্যার লক্ষ্য করে বললেন, “এই, তুই লেখস না ক্যান ? তোর সমস্যা কি?”
স্যারের দীপ্ত গভীর কণ্ঠস্বরের ধমক আমাকে আরো গুটিয়ে দিল শামুকের মতন। আমি স্যারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। এটা ১৯৬৬সালের কথা। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ি, ঢাকার কলাবাগানের দ্বিতীয় লেনের মিউনিসিপাল প্রাইমারী স্কুলে।
এটা অঙ্কের ক্লাস। আমাদের শিক্ষক রশীদ স্যার। উনি মোটামুটি দীর্ঘ দেহী। পাতলা একহারা চেহারা। বয়সে যথেষ্ট তরুণ। কণ্ঠ ভারী। স্যারের একটাই খুঁত, যদি এটাকে খুঁত বলি, তা হল স্যার একটু টেরা চোখে তাকান। ফলে প্রাথমিক ভাবে বুঝতে একটু কষ্ট হয় যে স্যার কোনদিকে বা কারদিকে তাকিয়ে আছেন।
তবুও বুকে সাহস সঞ্চয় করে দাঁড়িয়ে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম, “স্যার এটা কিভাবে সম্ভব, একজন পুরুষের সমান তিনজন মহিলা?” আমার কথা শুনে ক্লাসের অর্ধেক ছেলেমেয়ে হো হো করে হেসে উঠল। স্যার চমকে তাকালেন। দেখলাম রাগে তার মুখ প্রায় রক্তবর্ণ। আমাকে বললেন, “১৮০ ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়া”। আমি ভয়ের চোটে ত্বরিত উলটো দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই স্যার দড়াম করে আমার পিঠে একটি কিল দিয়ে বসলেন। আমি উবু হয়ে দ্বিতীয় বেঞ্চের ছেলেদের উপর পড়ে যাওয়ার যোগার।
যাহোক, ব্যাপারটা হল, আমাদের অঙ্কের ক্লাসে মাত্রই ঐকিক নিয়ম শুরু হয়েছে। অঙ্কটা ছিল অনেকটা এরকম, দশজন পুরুষের পাঁচ বিঘা জমিত ধান কাটতে লাগে তিন দিন। তিন দিনেই সেই পরিমাণ ধান কাটতে প্রয়োজন হয় ত্রিশ জন মহিলার। তাহলে বিশ বিঘা জমির ধান দুই দিনে কাটতে কতজন মহিলার প্রয়োজন?
অঙ্কের হিসাবে ধরলে এটা ঠিকই আছে যে এখানে একজন পুরুষের সমান কাজ করতে তিনজন মহিলার প্রয়োজন। কিন্তু আমার সমস্যাটা হচ্ছে, আমি ওভাবে দেখতে ও চিন্তা করতে তখনও অভ্যস্ত নই। তার মূল কারণ আমার মা। আমার মা নিজেও একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন। আমি ছোট বেলা থেকেই দেখে এসেছি উনি সারাদিন শিক্ষকতার কাজ শেষ করে বাসায় এসে ঘরের সমস্ত রান্নাবান্না করতেন, পরিবারের সবার অভিযোগ মেটাতেন, অনেক সময় নিয়ে নামাজ ও কোরান পড়তেন। তারপর বেশ রাত করে ঘুমাতে যেতেন। আবার ফজরের নামাজের সময় ঘুম থেকে উঠে পড়তেন। ফলে আমি কোনভাবেই ভাবতে পারিনি যে একজন মহিলা একজন পুরুষের সমকক্ষ ছাড়া অন্য কিছু। বরং ক্ষেত্র বিশেষে ঘরের, এমন কি বাইরেরও নানা কাজে আমি পুরুষের মধ্যে যে শৈথিল্য ও উদাসীনতা দেখেছি তা মহিলা বা মেয়েদের মধ্যে দেখেছি কম। ফলে স্যারের কথা মেনে নিতে আমার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না।
রশীদ স্যারের কথা কি বলব? উনি ছিলেন একের ভিতর অনেক। রশীদ স্যার আমাদের সবই পড়াতেন। পুরো পাঁচ বছরের প্রাইমারী স্কুল জীবনে বিভিন্ন ক্লাসে তার কাছ থেকে অঙ্ক, ইংরেজি, বিজ্ঞান, ভূগোল সবই পড়েছি। নিঃসন্দেহে উনার কাছ থেকে শিখেছি অনেক। সত্যি করে বললে আমাদের জীবনের শিক্ষার ভিত তৈরি করে দিয়েছিলেন এই রশীদ স্যারের মতই গুণী শিক্ষকেরা।
অসম্ভব নীতিবান ও দৃঢ় চরিত্রের মানুষ ছিলেন রশীদ স্যার। তার দেশের বাড়ি ছিল মুন্সীগঞ্জের দিকে। ঢাকায় উনি ছাত্রদের বাড়িতে লজিং থেকে শিক্ষকতা করতেন। অর্থাৎ ছাত্র পড়ানোর বিনিময়ে থাকা ও খাওয়ার সুযোগ। কেমন আদর্শবান ছিলেন রশীদ স্যার তার একটা গল্প বলি। তার লজিং এর এক ছাত্র তারই এক সাবজেক্টে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় ফেল করে বসে (কেন যে উনি ওদের বাসায় থেকে-খেয়ে উনার সাবজেক্টেই ওকে ফেল করালেন, এখনও অবাক হয়ে ভাবি!)। এ ঘটনায় তখনকার পিতা-মাতা ও তাদের সামাজিক নীতি-বোধের কিছুটা পরিচয়ও আমরা পাব। পরীক্ষায় তারই লজিং মাস্টারের সাবজেক্টে ফেল করার পরও ঐ ছাত্রের পিতা স্যারকে বলেছিলেন, “……আপনি আর কি করবেন, ও তো একটা বাঁদর, ওতো সারাদিন ঘুরাঘুরি আর খেলা নিয়ে ব্যস্ত। আপনি ওকে পিটিয়ে হাড্ডি-গুড্ডি পানি পানি করে ফেলেন। এ ছেলের আমার আর দরকার নেই”। তখন কলাবাগান ১ম-২য়-৩য় লেনের প্রায় প্রতিটি পরিবার প্রতিটি পরিবারকে চিনত। সবাই সবার খবর রাখত।
রশীদ স্যারের সঙ্গে আমাদের পুরো পরিবারের প্রায় প্রতিটি সদস্যের পরিচয় ছিল। আমার আম্মাকে উনি আপা বলে ডাকতেন। বড় বোনের মত শ্রদ্ধা করতেন। এমন কি উনার ছেলের মুসলমানিতে আমার আম্মা ও ছোট ভাইকে দাওয়াত করে মুন্সীগঞ্জ নিয়ে গিয়েছিলেন।
রশীদ স্যারের আরো অনেক গল্প আছে যা পরে কখনো বলব। স্যার গত হয়েছেন বেশ ক’বছর। স্যারের বিদেহী আত্মার জন্য কায়মনোবাক্যে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছি।
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া Jsfn21@gmail.com
|