উল্টো পিঠের সোজা কথা (১২) রিয়াজ হক
অসামান্য লাভের ‘সামান্য ক্ষতি’!
‘সামান্য ক্ষতি’ কি বাস্তবিকই সামান্য ক্ষতি ছিল? ষাণ্মাসিক বা অর্ধ বার্ষিকী পরীক্ষায় বাংলা বিষয়ে এই ছিল অনেক প্রশ্নের একটি। আমি উত্তরে লিখেছিলাম: -না ছিল না।
এটা ১৯৬৬-৬৭ সালের কথা। আমি তখন ঢাকার কলাবাগানের দ্বিতীয় লেনের ‘কলাবাগান মিউনিসিপালিটি ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে’ পড়ি। এ স্কুলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হই ১৯৬৩ সালে। তখন কলাবাগান-কাঁঠালবাগান-শুক্রাবাদ মিলে এটিই ছিল ঢাকা মিউনিসিপালিটি পরিচালিত অন্যতম (নাকি অত্র এলাকার একমাত্র!) স্কুল। এটা এজন্যই বলছি যে আমার তখনকার সহপাঠীরা সবাই এসব এলাকা থেকেই আসত।
এখন খুব পরিষ্কার মনে নেই যে ‘সামান্য ক্ষতি’ কবিতাটি চতুর্থ নাকি পঞ্চম শ্রেণীতে ছিল। যাহোক, আমাদের বাংলা পড়াতেন ‘বুড়া স্যার’। বিশ্বাস করেন, এছাড়া আর কোন নামেই আমরা তাঁকে চিনতাম না। অনুমান করি উনার বয়স ছিল তখন ষাটের উপর। উনি ছিলেন বেঁটেখাটো। সমস্ত চুল-দাঁড়ি-গোঁফ ছিল যাকে বলে বরফ সাদা। তার উপর পড়তেন সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী। কিছুটা সামনে ঝুঁকে ধীর লয়ে হাঁটতেন। উনার মুখের দিকে তাকালে মনে হত যেন সারা পৃথিবীর তাবৎ সমস্যায় উনি যারপর নাই উদ্বিগ্ন ও বিচলিত। উনার হাসিমুখ কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। চোখ দুটো ছিল চিতাবাঘের মত জ্বলজ্বলে। আমরা উনাকে যমের মত ভয় পেতাম। উনার পাশে কখনো পড়ে গেলে পা টিপে টিপে হেঁটে অতি দ্রুত উনাকে অতিক্রমের চেষ্টা করতাম।
উনি ক্লাসে এসে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আমাদের বাংলা পড়াতেন। টেবিলের উপর রাখতেন প্রায় ছ’ফুট লম্বা সরু লিকলিকে একটি বেত। তবে বলতেই হবে, উনি ছিলেন সত্যিকারের একজন জ্ঞানী মানুষ। জানতেন অনেক। বিষয়ের গভীর থেকে গভীরে চলে যেতেন অনায়াসেই। এর অর্ধেক আমরা বুঝতাম, অর্ধেক বুঝতাম না।
আমাদের সময় একটি রেওয়াজ ছিল, পরীক্ষার পর বিষয়ের ফলাফল ঘোষণার সময় উত্তরপত্রটি প্রত্যেককে ফেরত দিয়ে তার ভুলভ্রান্তি কোথায় হয়েছে, কেন নম্বর কম দেওয়া হয়েছে তা দেখতে বলা হত। তো যথারীতি সেই ষাণ্মাসিক পরীক্ষার পর বাংলা খাতা নিয়ে স্যার ক্লাসে ঢুকলেন ও নাম ডেকে ডেকে খাতা দিয়ে দিলেন। তারপর বললেন, খাতা দেখে যারা কোন প্রশ্নের উত্তরে শূন্য পেয়েছে তাদের হাত তুলতে।
ঐ যে প্রশ্নটা প্রথমে উল্লেখ করেছি, আমি দেখলাম আমার খাতায় তার উত্তরের পাশে একটা বিশাল শূন্য।
এখানে, ‘সামান্য ক্ষতি’ (‘বহে মাঘ মাসে শীতের বাতাস………) কবিতাটি যারা পড়েন নি তাদের জন্য বলি, এটি রবীন্দ্রনাথের লেখা একটি দীর্ঘ কবিতা। বাংলা ১৩০৬ সালে রচিত। কবিতায় রাজধর্ম কেমন হওয়া উচিত তাই বলা হয়েছে।
ঘটনাটি এমন, কাশীর মহিষী করুণা সখী পরিবেষ্টিত হয়ে নদীতে গোসল সেরে শীত নিবারণের জন্য নদীতীরের কুটিরে আগুন লাগিয়ে দিলেন (………উত্তর বায়ু হইল প্রবল/কুটির হইতে কুটিরে অনল/উড়িয়া উড়িয়া ছুটিল…)। প্রজারা অভিযোগ করাতে রাজা বললেন, “মহিষী একি ব্যবহার/গৃহ জ্বালাইলে অভাগা প্রজার/বল কোন রাজধরমে”। রানী তার উত্তরে বলছেন, “গেছে গুটিকতক জীর্ণ কুটির/কতটুকু ক্ষতি হয়েছে প্রাণীর / কত ধন যায় রাজমহিষীর এক প্রহরের প্রমোদে”। রাজা তখন অগ্নিশর্মা হয়ে রানীর রাজবেশ খুলে ফেলে তাকে ভিখারির বেশে রাস্তায় বেরিয়ে যেতে বললেন। আরো বললেন, “………এক প্রহরের লীলায় তোমার/যে কটি কুটির হল ছারখার/যতদিনে পার সে কটি আবার/গড়ে দিতে হবে তোমারে”। যা হোক স্যারের নির্দেশে ভয়ে ভয়ে হাত তুললাম।
প্রথমেই আমার নাম ধরে ডাক দিয়ে বললেন, “এদিকে আয়”। মানে, উনার কাছে। আর কাছে মানে তার বেতের আওতার মধ্যে। যাওয়া মাত্র বললেন, প্রশ্নটা পড়, সাথে উত্তরটাও। পড়লাম।
বললেন, “হাত পাত”। হাত পাতা মাত্রই শপাং শপাং করে দু’ঘাত। আমার চোখ দিয়ে জলের ধারা যেন “……রুধিয়া রাখিতে নারি”। সারা ক্লাস নীরব। সবার চোখেমুখে আতঙ্ক। কারণ সিরিয়ালে প্রায় সবাই!
বুঝতে পারছিলাম না কেনই বা এই শূন্য আর কেনই বা ধরে-বেঁধে এই মার! যাহোক, ক্লাস শেষ হবে, স্যার চলে যাওয়ার আগে দাঁড়িয়ে বললেন, শুধু প্রশ্ন দেখলেই চলবে না। প্রশ্নের পাশে ওর জন্য বরাদ্দকৃত নম্বর দেখে তবে উত্তর লিখতে হবে। তা না হলে চিরজীবন মিলবে শূন্য ও মার।
বাসায় ফিরে যেয়ে অনেক খুঁজে প্রশ্নপত্র বের করে দেখি ঐ প্রশ্নের জন্য নম্বর রাখা ছিল ছয়। আর আমার উত্তর ছিল মাত্র এক লাইন। এমন কি ছ’শব্দও না। এরপর জীবনে আর কোন ভুল হয়নি। বাকী জীবন প্রশ্নের পাশে বরাদ্দকৃত নম্বর দেখেই উত্তর ছোট বা বড় করেছি। তার সাথে এই কবিতার যে মূল বানী ‘তোমার জন্য যাহা খেলা, আনন্দ বা ক্ষণিকের সুখ অন্যের জন্য তাহা মরণ’ এই বোধ ও বাস্তবতাকেও হৃদয়ে ধারণের শিক্ষা পেয়েছি। সেজন্যই বোধকরি কলাবাগান প্রাইমারী স্কুলের এই স্যারের কথা আজও ভুলি নাই। স্যারের আত্মার শান্তির জন্য হৃদয় থেকে প্রার্থনা করছি। স্যার, যেখানেই থাকেন, ভাল থাকবেন।
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|