উল্টো পিঠের সোজা কথা (১০) রিয়াজ হক
১৪ দিনের সুখ ভোগ
এখন না চাইতেই অবসর; পড়াশুনা থেকে, কাজ থেকে, প্রতিদিনের প্রাণান্তকর যাতায়াত থেকে। বাজারের হট্টগোল, অফিস আদালতের কোলাহল ও এর সংশ্লিষ্ট নিদারুণ মানসিক চাপ থেকে।
যদি ধরি ভাইরাস আমার পিছু ধাওয়া করছে - পালাবার পথ নেই, যাওয়ার কোন জায়গা নেই, এই ভেবে যদি সারাদিন হাহুতাশ করি, চিন্তায় মাথার চুল ছিঁড়ি তাহলে এ হবে অক্ষমের অযাচিত আত্মসমর্পণ।
বরং ধরতে হবে, বিধাতা এভাবেই চেয়েছেন। এভাবেই ঘরে নরমে-গরমে, শান্তিতে-অশান্তিতে, ভীরু স্বরে বা চোখ রাঙ্গানিতে সবাইকে নিয়ে চলতে হবে। এর মধ্যেই কাজ ও আনন্দের জায়গা খুঁজতে হবে। নিজের মনের মত কাজ, সৃষ্টিশীল কিছু কাজ দিয়ে এ সময়টাকে অনির্বচনীয় আনন্দে ভরিয়ে তুলতে হবে।
যারা বই ভালোবাসেন, পড়তে পারেন সেরকম বই। আপনি রোমান্টিক হলে, এই মুহূর্তে হাতে তুলে নিন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবা রাত্রির কাব্য’ বা বুদ্ধদেব বসুর সাতশ পৃষ্ঠার উপন্যাস ‘তিথিডোর’। গ্যারান্টি দিচ্ছি, পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাবেন। যারা কাঁদতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য হল, জাহানারা ইমামের “একাত্তুরের দিনগুলো” বা “ক্যান্সারের সঙ্গে বসবাস”। যারা আমার মত রাজনীতি পছন্দ করেন, তাদের জন্য হল বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ যা পড়ে ভাববেন, যে গণতন্ত্রের জন্য এত আত্মত্যাগ, এত বিসর্জন সে গণতন্ত্র আজ কোথায়? মহীউদ্দিন আহমেদের “জাসদের উত্থান পতন-অস্থির সময়ের রাজনীতি”ও পড়তে পারেন স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের টালমাটাল রাজনীতির হালহকিকত জানতে। দর্শন যাদের প্রিয় বিষয়, তারা পড়তে পারেন, সর্দার ফজলুল করিমের “প্লেটোর রিপাবলিক”। একবার শুরু করলে তা শেষ না করে ছাড়তে পারবেন না।
হাতের কাছে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক, আহমেদ ছফা, মাহমুদুল হক এর বই থাকলে নির্দ্বিধায় পড়তে পারেন। এরা প্রত্যেকেই ভাল লিখেন/লিখেছেন।
বই ভাল লাগে না, গান শুনুন। রবীন্দ্র-নজরুল, পুরনো বা আধুনিক। গান ভাল না লাগলে ছবি আঁকুন, বাগান করুন। প্রতিদিনের ঘটনাপঞ্জী ডায়রিতে লিখে রাখুন।
আমি নিজে অতীতে কখনও কখনও ডায়েরি লিখেছি। গতবার এই সময়েই ঢাকায় যেয়ে আমার লেখা ১৯৮৪ সালের একটি ডায়েরি উদ্ধার করি। তাতে বর্ণিত ১৯৮৪ সালের ১২ই মার্চের লেখাটি হুবহু তুলে দিচ্ছিঃ
“ছ’তারিখ থেকে পত্রিকায় কর্মবিরতি চলছে। প্রেস মালিক ও কর্মচারীদের। সাত তারিখ থেকে পত্রিকা হীন বাংলাদেশ। ঘরে-বাইরে জোর কথা চলছে, এ ধর্মঘটের পিছনে সরকারের হাত রয়েছে। বিরোধী দলগুলোর জনযোগাযোগের একমাত্র এ মাধ্যমটিকে অকেজো করে দিয়ে জাতিকে আন্দোলনের ব্যাপারে অন্ধকারে রাখাই হল এর মূল উদ্দেশ্য। ভাবতে অবাক লাগছে বর্তমানের সভ্য জগতে এমন ঘটনা ঘটছে। আচ্ছা এতে করে কি জাতির ভাবমূর্তির কোন উন্নতি ঘটছে? আর সরকারই কি সত্যকার এতে লাভবান হচ্ছেন বা হয়েছেন? নয় ও দশ তারিখে ছিল আইনজীবীদের জাতিয় মহা সম্মেলন। ১৫ দল নেত্রী শেখ হাসিনা ও ৭ দল নেত্রী খালেদা জিয়া এতে বক্তৃতা করেছেন। এই প্রথম একই প্লাটফর্মে তারা একসাথে কথা বললেন। তবে এখন যে রকম গণতন্ত্রের জন্য জীবন পণ করছেন, সামনেও কি তা করবেন?”
এরকম বহু লেখা/মন্তব্য/অভিমত ছড়িয়ে আছে ডায়েরির পাতায় পাতায়। বেঁচে থাকার পদচিহ্ন রেখে যেতে হলে কিছু না কিছু করতেই হবে। জীবন আমাদের কাছে কেবল এইটুকুই দাবী করে।
ইতিহাসের পাতায় আমরা থাকব না এ সত্য তবে কোন কোন মানুষের চোখে ও মনে থেকে যাব। সবশেষে স্পেনের কর্ডোভায় উমাইয়া খিলাফতের এক বিশ্বখ্যাত শাসকের কথা বলে শেষ করি। ৯১২ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ২৩ বছর বয়সে তৃতীয় আব্দ আল রহমান তার দাদু আব্দুল্লার উত্তরসূরি রূপে সিংহাসনে বসেন। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর (৯১২-৯৬১ খ্রিস্টাব্দ) তিনি শাসন করেন। ৫ লক্ষ মানুষ, ৭০০ মসজিদ ও ৩০০ স্নানাগার সহ তখনকার কর্ডোভার স্থান ছিল জাঁকজমকের দিক থেকে বাগদাদ ও কন্সট্যান্টিনেপোলের পরেই। সে সময়ের আলজাহরা রাজপ্রাসাদ (তার এক উপপত্নীর নামে) নির্মাণে দশ হাজার শ্রমিক ও পনেরশ পশুর বিশ বছর লেগেছিল। ভাবুন তাহলে কেমন রাজপ্রাসাদ ছিল সেটি!
৭৩ বছর বয়সে মারা যাবার সময় তৃতীয় আব্দ আল রহমান লিখে গিয়েছিলেন যে তিনি সারা জীবনে মাত্র ১৪ দিন সুখ ভোগ করেছিলেন। (হিস্ট্রি অব দ্য অ্যারাবস, পি কে হিট্টি) রাজার মতই সেই ১৪ দিন এখন আমাদের হাতে!
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|