উল্টো পিঠের সোজা কথা (৯) রিয়াজ হক
আমরা যা বলি, আমরা যা করি
বেঁচে আছি। ‘বেঁচে আছি’ এটা বুঝি কি ভাবে? কথা বলি, কাজ করি। একেবারে স্থির নই, গতির ভেতরে আছি। সময়কে ছেড়ে চলে যাচ্ছি সময়ের অন্তহীন গন্তব্যে। এভাবেই বুঝি, বেঁচে আছি।
প্রতিদিন নানাভাবে অসংখ্য মানুষের সংস্পর্শে আসছি আমরা। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন প্রসঙ্গে আমাদের কথা ও মত বিনিময় হচ্ছে। কখনো কখনো আমরা আলাপচারিতায় মশগুল হচ্ছি। এর মাধ্যমে আমরা নিজেদের প্রকাশ করছি। দৃশ্যমান হচ্ছে আমাদের ব্যক্তিত্ব, আদর্শ ও চরিত্র।
নিজেকে সহ এমনি দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিদিনের দেখা কিছু মানুষের ভেতর থেকে তুলে আনা ক’জনের কথা বলব, যারা নিজের সম্পর্কে বলছেন বা ধারনা দিচ্ছেন একভাবে অথচ বিশেষ ঘটনার প্রেক্ষিতে নিজেকে প্রকাশ করছেন অন্যভাবে। চরিত্র ও ঘটনাগুলো ঠিক রেখে নামগুলো বদলে দিচ্ছি মাত্র।
শুরু করি নিজেকে দিয়েই।
আমিঃ আমি সবসময় সবাইকে পরামর্শ দিয়ে থাকি জীবনে সব বিষয়ে পজেটিভ বা আশাবাদী থাকার ব্যাপারে সচেতন প্রয়াস নেওয়ার জন্য। পজেটিভিটি যে জীবনকে সামনে এগিয়ে দেয়, মনকে শান্ত ও সুস্থির রাখে, কাজে আনন্দ পাওয়া যায় সে কথা হরহামেশাই সবাইকে বলে থাকি। অথচ এই আমি, স্ত্রী-কন্যা যখন কাজ থেকে ফিরতে দেরি করে, পুত্রের বাসায় ফেরার নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যায়, প্রচণ্ড মানসিক চাপে ভুগতে থাকি। অস্থির হয়ে সময় দেখি, ঘন ঘন ম্যাসেজ পাঠাই, ফোন করি। ঘরের ভেতর দ্রুত গতিতে পায়চারী করতে থাকি। আমার পজেটিভ এ্যাটিচিউড এর সমস্ত চিন্তা ও ভাষ্য ফানুস হয়ে গহীন শূন্যে উড়ে চলে যায়। বুঝিনা কেন এরকম হয়! কথা ও কাজে এতটা তফাৎ কিভাবে কেন ঘটে!
শামসুদ্দিন আহমেদঃ অবসর প্রাপ্ত, সুত্তুরোর্ধ শামসুদ্দিন সাহেব পেশায় একাউন্টেন্ট ছিলেন। ঢাকার নামি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা করেছেন। সরকারী বেসরকারি মিলিয়ে বহু পদে বহু বছর ধরে সাফল্যের সাথে কাজ করেছেন। পাঁচ ভাই, তিন বোনের আট জনের সংসারের জ্যৈষ্ঠ সন্তান তিনি। অন্য ভাই-বোনেরা তাকে দেবতা তুল্য জ্ঞান করেন। তার মুখের উপর কেউ কথা বলতে সাহস করেন না।
ছাত্র জীবনে তিনি বামপন্থী রাজনীতির সাথে নিবিড় ভাবে যুক্ত ছিলেন। সারা জীবন নারীপুরুষের সম অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। কিন্তু পিতার মৃত্যুর পর তার রেখে যাওয়া বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে বলে ফেললেন, “বোনদের কেন সম্পত্তির অংশ দিতে হবে। ওদেরর পড়াশুনা, বিয়ে সবকিছুতে তো অনেক খরচপত্র করা হয়েছে। তাছাড়া স্বামীদের সূত্রেও তো ওরা সম্পত্তি পাচ্ছে”।
প্রশ্ন হল, এমন একজন ব্যক্তির এ ধরনের মনোভাব তার জীবন-চরিত্রের কোন অংশকে প্রকাশ করে?
মনোয়ার হোসেনঃ পেশায় প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেনের বয়স এখন মধ্য ষাটের কাছাকাছি। গর্ব করার মত স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা, ভাল চাকুরী, বিশাল বাড়ি ও বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক তিনি। তার মুখ আলোকিত করার মত সাফল্যের অধিকারী তার তিন সন্তান। সন্তানদের মানুষ করার ক্ষেত্রে তার মনোযোগ, রীতিনীতি, প্রক্রিয়া ও বুদ্ধি নিয়ে তিনি কথা বলতে ভালবাসেন। নিজেকে এ ব্যাপারে একরকম বিশেষজ্ঞের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন বলেও মনে করেন।
সেই মনোয়ার হোসেন সাহেব আবার একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের গোঁড়া সমর্থক। কিন্তু তাই বলে তার সমস্ত শিক্ষা, আদর্শ ও চেতনার বাইরে গিয়ে যখন দেশের ছাত্রদের কোটা আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবীর বিরুদ্ধে গিয়ে বলে উঠেন, “ওদের পিটিয়ে রাস্তা থেকে উঠিয়ে দেওয়া উচিৎ”। তখন বুঝতে পারিনা এ তার কোন আদর্শ বা চরিত্রকে প্রকাশ করে!
তৌফিক চৌধুরীঃ তিনি জানেন না এমন কোন বিষয় নেই। আপনি কি নিয়ে কথা বলতে চান! রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, ক্রীড়া, নারীর অধিকার এমন কোন বিষয় নেই যা তিনি জানেন না বা কথা বলতে পারেন না বা চান না। শুধু তাকে সূত্র ধরিয়ে দিলেই হয়।
বয়স তার ষাট প্রায়। তিনি আবার যাকে বলে পাড় নাস্তিক। প্রকাশ্যে নিজের সম্পর্কে এ স্বীকারোক্তি না দিলেও তার কথায় অন্যেরা ঠিকই বুঝে নেন তার অবস্থান। সেই তিনি হঠাৎ শুনি চলে গেছেন হজ্বে। ভাল কথা, ভাবলাম হয়ত তার মতের পরিবর্তন ঘটেছে। এমন করিৎকর্মা-জ্ঞানী মানুষ নিশ্চয়ই যা করেছেন বুঝে শুনেই করেছেন।
একসময় সুযোগ মিলল তার সাথে দেখা ও কথা বলার। আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বলে ফেললেন, “ওসব ধর্ম-টর্ম কিছু না, গিয়েছিলাম দেখতে। মানুষ, ইমারত, ব্যবস্থাপনা এসব দেখাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য”। শুনে ভিমড়ি খেলাম!
এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে যা মনে হল, তা হচ্ছে, আমাদের চরিত্রের মধ্যে এই যে নানা বৈপরীত্য তা কি খুবই স্বাভাবিক না কি যে পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার ভেতর দিয়ে আমরা বেড়ে উঠছি তার সূক্ষ্ম প্রতিফলন! অথবা আমরা নিজেদের একটা আদর্শের যায়গায় দেখতে ও দেখাতে চাই। কারণ আমরা জানি, ওটাই হচ্ছে সত্য ও আদরণীয়। কিন্তু অনেক সময় নানা স্বার্থের সংঘাতে আমরা পেরে উঠি না ফলে বের হয়ে আসে আমাদের ভেতরের আসল রূপ বা চরিত্র!
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|