উল্টো পিঠের সোজা কথা (৭) রিয়াজ হক
বিবাহ ও বিবাহ-বাহুল্যের সমাচার
| সাধারণ ভাবে সম ধর্ম ও সংস্কৃতির দু’জন ব্যক্তির (পুরুষ ও মহিলা) একটি ধর্মীয় ও সামাজিক চুক্তির নামই ‘বিবাহ’ বা বিয়ে বলে একসময় স্বীকৃত ছিল বা আছে।
তবে যুগ ও সভ্যতার বিবর্তনের সাথে সাথে তার সমূহ পরিবর্তন ঘটেছে।
একসময় যা ছিল সমাজ ও সভ্যতাকে সংগঠিত ও নিয়মানুবর্তী রাখার সঠিক প্রয়োজনে সিদ্ধ এখন তাই এসে দাঁড়িয়েছে সংখ্যা গরিষ্ঠের ইচ্ছে আবেগ ও অনুভূতির সাথে আইন কে মিলিয়ে চলার আবশ্যকতা হিসেবে।
ফলে এক সময় শিশু-বিবাহ, জোর পূর্বক বিবাহ, সম্বন্ধের বিবাহ ও বহু-বিবাহ যেমন সমাজের নীরব অনুমোদন পেয়েছিল এখন তেমনি ‘না-বিবাহ’ (বিবাহ হীন বসবাস, যাকে বলে লিভিং-টুগেদার), চুক্তি ভিত্তিক বিবাহ, সম লিঙ্গের বিবাহ ক্রমে সমাজের (বিশেষ ভাবে পাশ্চাত্য সমাজের দিকে লক্ষ্য করুন) অনুমোদন লাভে সমর্থ হচ্ছে।
সমাজের এ অনুমোদন শুদ্ধ না ভুল, উচিৎ না অনুচিত সে প্রশ্নে না যেয়েও বলা যায় যে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষা ও সভ্যতার হাত ধরে এগুলেও নৈতিকতা ও যৌক্তিকতার প্রশ্নে আমরা এ বিষয়ে কোন সর্বজন গ্রাহ্য মীমাংসায় পৌছতে পারিনি।
ফলে শিক্ষার উপরেও ধর্ম, সংস্কৃতি ও নানা স্থানীয় আচার বিবাহের রূপকে বহু ধারায় বিভক্ত করে রেখেছে। সার্বিক ভাবে এর মূলে যে অর্থ একটি বড় বিষয় তাতে বোধ করি কারো সন্দেহ থাকার অবকাশ নেই।
বহু প্রাচীন কাল থেকেই বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী কে জানান দেওয়ার রেওয়াজের মধ্যে আছে জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে। ভাল কথা। কিন্তু প্রশ্ন হল, কতটুকু বা কি পরিমাণে?
বাহুল্য, বিলাসিতা ও দুঃখ জনক অমিতাচার আজ বহুলাংশেই আমাদের বিয়ের স্বরূপ হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। দেশে ও দেশের বাইরে বাঙালি কমিউনিটির মধ্যে এ প্রবণতা এখন সংক্রামক ব্যাধির মত বিস্তার লাভ করছে।
বাহুল্য অর্থে, বিয়ের মূল অনুষ্ঠান কে কেন্দ্র করে প্রসারিত নানা নামের আরো নানা অনুষ্ঠানের উৎপীড়ন। যেমন এঙ্গেজমেন্ট বা আংটি পড়ানো, পান-চিনি, মেহেদি-নাইট, সঙ্গীত-রাত, ফিরানী ইত্যাদি। ভুলে গেলে চলবে না যে এসবের উপরে আছে বিয়ের মূল তিনটি অসম্ভব ব্যয়বহুল অনুষ্ঠান; হলুদ-বিয়ে-বৌভাত।
বিলাসিতা অর্থে, হাই-হ্যালো পরিচিতির ছত্র ছায়ায় শত শত লোককে নিমন্ত্রণ, বিশাল মাপের ওয়েডিং ভেনু, বর ও বধূর অর্থহীন কারুকার্য খচিত দামী পোশাক, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেবল একদিনের জন্যই ব্যবহৃত হবে। সাথে নিজস্ব লোকদের আলাদা করে চেনাবার জন্য আলাদা সব জমকালো পোশাক ! নিগুঢ় অর্থ একটাই, দেখে যাও আমার কত আছে! এখানে অন্য মানুষ বা সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার প্রশ্ন নেই!
অমিতাচারের আদলে আসছে বিয়ের বৈশিষ্ট্য-হীন চমকপ্রদ কার্ড, লাগামহীন ফটোগ্রাফি, রুচিহীন সাজ, ডিজে পরিবেশিত বাছ-বিচারহীন ধামাকা সঙ্গীত।
অনেকেই এসব করছেন তার একরোখা ইচ্ছেপুরন বা সমাজে তার সামর্থ্যের জানান দিতে।
অনেকেই করছেন ঘরের ও বাইরের চাপে বাধ্য হয়ে।
অনেকেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে।
কিন্তু ভাল করে চিন্তা করে দেখলে আমাদের আদৌ এতসবের প্রয়োজন কতটুকু। আসুন ভাল করে চারদিক তাকিয়ে দেখি। রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতির নানামুখী পীড়নে আমাদের বৃহদাংশের চেহারা মলিন। শিক্ষা অপর্যাপ্ত, অকার্যকর। স্বাস্থ্য রুগ্ন, করুণ। ঘর ছিন্ন, আলোহীন।
বাহুল্য কি আমাদের সাজে! আমরা কি আমাদের এই অবিবেচক আচরণ দিয়ে সামর্থ্যহীন অন্যদের প্রলুব্ধ করছি না ন্যয়হীন ব্যয়ের পথে হাঁটার!
আমাদের প্রয়োজন যৌক্তিক আচরণ। সমাজ ও দেশের কথা যদি বাদও দেই; ধর্ম, যার পৃষ্ঠপোষকতায় আমরা অনেকেই স্বস্তি ও সন্তোষ লাভ করি। সেই ধর্ম আমাদের কি বলে? মিতব্যয়ী হতে, নয় কি? কারণ, বলা হয়েছে, “মিতব্যয়ীতা হল অন্তঃজ্যোতির বহিঃপ্রকাশ”।
কিন্তু জীবনে প্রয়োগের ক্ষেত্রে এসব বোধ, বিশ্বাস আমাদের উদ্বুদ্ধ করে না কেন?
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|