উল্টো পিঠের সোজা কথা (৫) রিয়াজ হক
ক্রিকেট, নেতৃত্ব ও দেশপ্রেম
আমাদের রাজনৈতিক বিশ্বাস ও সমর্থন, ধর্মীয় বোধ ও ব্যাখ্যা সেই সঙ্গে ভিন্নতরও সামাজিক আচার বাংলাদেশের এই আমাদের নানা বিভক্তি রেখায় ঠেলে দিয়েছে। ফলশ্রুতিতে আমরা পরমত-অসহিষ্ণু হয়েছি, অন্যের সঙ্গে সহ অবস্থানের চেয়ে নিজের নিরঙ্কুশ অবস্থানে আমরা বিশ্বাসী। অন্যের ন্যায্য বোধ ও মতকে আমরা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করি। কোন বিষয় নিয়ে বিতর্কের চেয়ে অন্য মতের বিনাশে আমরা মনোযোগী। গায়ের জোরে রামদা চাপাতি দিয়ে হলেও অন্যের ধ্বংস সাধনে আমরা তৎপর।
আমরা এমন একটা সমাজের চাষবাসে মত্ত হয়েছি যেখানে কোন বিষয় বা বক্তব্য নিয়েই সুস্থ নিয়মতান্ত্রিক আলোচনা-সমালোচনা বা বিতর্কের অবকাশকে অবান্তর করে তুলেছি। এসবের মাঝেও যে জিনিসটা এখনও আমাদের জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ করে রেখেছে সে হল ক্রিকেট। প্রতিদিনের জীবন যাপনের সমস্ত গ্লানি-পরাজয়-পরাভবকে ঠেলে ফেলে এই এক জায়গায় সমস্ত জাতি ঐক্যবদ্ধ। তারা যে কোন মূল্যে চায় বাংলাদেশের ক্রিকেটের জয় বা বলা চলে ক্রিকেট দলের জয়।
একজন রাজনৈতিক নেতার বলশালী উত্থানের চেয়েও বিশ্ব ক্রিকেটে সাকিবের শতক-অর্ধ শতক তাই আপামর জনসাধারণের মন কাড়ে। বিপরীত দিক থেকে একজন শিক্ষিত তরুণের বেকারত্বের অসহায়তার চেয়েও নিদারুণ হয়ে উঠে তামিম ইকবালের সহজ ক্যাচ ধরার ব্যর্থতা। কারণ ঐ একটি আশা ও আনন্দের জায়গায় বাঙ্গালী পরাজিত হতে বড় কষ্ট পায়।
বাঙ্গালীর নিজেকে নিয়ে গর্বিত হওয়ার সুযোগ অনেক, তবে সুযোগের ব্যবহৃত হওয়ার প্রক্রিয়া বড় হতাশাজনক। বাঙ্গালী রাজনীতিতে চতুর যুধিষ্ঠির, বানী ও বন্দনায় যেমন লাগামহীন তেমনি যুক্তি ও ন্যায্যতার প্রশ্নে দীনহীন। অর্থনীতিতে ভারসাম্যপূর্ণ সাশ্রয়ী ব্যবস্থাপনার চেয়ে বহু বাহুল্যের নগ্ন প্রদর্শনীতে কাতর। শিক্ষায় যতটা বাগাড়ম্বরতা ততটাই খালি কলসির বেশী বাজনার উন্মত্ততা। বাঙালি কেবল লোক দেখানোয় আগ্রহী। কিন্তু কিভাবে কতটা দেখানো যাবে তার প্রস্তুতিতে যাচিত শ্রম ও মেধার পরিমিত প্রয়োগ নেই। ফলে সবকিছুই আধা কাঁচা; যাকে বলে দরকচড়া।
এমনি পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্তেই বাঙ্গালীর প্রয়োজন সাফল্য ও আনন্দের সংবাদ। তা যেহেতু রাজনীতি-অর্থ-শিক্ষায় পাওয়ার আশা কম বাঙ্গালীর তাই চোখ পড়েছে খেলায়, তাও একটি মাত্র জায়গায়, ‘ক্রিকেট’ এ।
একসময় সারা বাংলাদেশে ফুটবল ছিল অসম্ভব জনপ্রিয়। সে ছিল বাঙ্গালীর এক নম্বর খেলা। সেখানে নব্বুই দশকের শুরু থেকেই ক্রিকেট একটু একটু করে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ফুটবলে দেহের শক্তি, দম ও কৌশলের প্রবল প্রয়োজন। ক্রিকেটে শক্তি ও দমের চেয়ে কৌশল (টেকনিক) বেশী কাজের। ফলে মুশফিকের মত হাল্কা-পাতলা ছোট দেহ নিয়ে ফুটবল খেলায় সাফল্য না পাওয়া গেলেও ক্রিকেটে পাওয়া সম্ভব। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে মুশফিকের দারুণ সেঞ্চুরিটিই তার বড় প্রমাণ নয় কি !
এহেন এই ক্রিকেটে নেতৃত্ব একটি বড় বিষয় সন্দেহ নেই। বিপক্ষের শক্তি বুঝে নিজের পরিকল্পনা (স্ট্রেটিজি) সাজানো, কোন বোলারকে কখন উইকেটে আনতে হবে, কোথায় ফিল্ডিং সাজাতে হবে, প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যান কে কিভাবে মানসিক চাপে ফেলতে হবে এর সব কিছুই মাঠের নেতার উপর নির্ভর করে। তবে সেরের উপর সোয়া সেরের মতই নেতাকে নেতৃত্ব দিতে হলে ও তাকে সতীর্থদের উপর কার্যকর (ইফেক্টিভ) করে তুলতে হলে নিজের সেরাটা দিয়ে নিজেকে সর্বত্র দৃশ্যমান করে তুলতে হবে। তা কি ব্যাটে, কি বলে, কি ফিল্ডিং এ। এর কোন বিকল্প নেই। এ না হলে নেতার নেতৃত্ব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে বাধ্য।
কারণ ক্রিকেট এগার জনের খেলা। ঐ এগার জনকেই তার তার জায়গায় পারফর্ম করতে হবে। কেবল পরিকল্পনার ছক আঁকা ও মাঠে তার প্রয়োগের ভূমিকার আড়ালে যদি ব্যাট-বল-ফিল্ডিং কে সেকেন্ডারি করে দেই তাহলে তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে এগার জনের দলে দশ জন খেলছেন। একজন থেকেও নেই। অন্তত ক্রিকেটের পরিসংখ্যানে নেই; রানের খাতায়, বলের উইকেট প্রাপ্তিতে ও ফিল্ডিং এ রান বাঁচানোর ধারায় তখন হাহাকার উঠতে বাধ্য।
নেতা ও নেতৃত্ব চিরস্থায়ী নয়। একজন যাবেন, আরেক জন আসবেন। মনে রাখা প্রয়োজন, আমাদের জীবন ও জীবন-আসরে কেউই অপরিহার্য নন। ব্রায়ান লারা ও তেন্দুলকারদের মত অসম্ভব কুশলী ক্রিকেটারদেরও একসময় নেতৃত্ব ও ক্রিকেট ত্যাগ করতে হয়েছে। আর যোগ্য নেতা তো তিনিই যিনি জানেন কখন তাকে সরে যেতে হবে। নিজের অবস্থান ও জনগণের হৃদ স্পন্দন বুঝে দেশের প্রয়োজনে যিনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন তিনি স্বাভাবিক ভাবেই তখন দেশ প্রেমেরও পরিচয় দিতে পারবেন।
নানা সময় নানা ভাবে আমরা দেশ প্রেমের কথা বলি। কিন্তু দেশ প্রেম কোন বলার বিষয় নয়। প্রতিদিনের কাজ দিয়ে, দায়িত্ব পালন ও সিদ্ধান্ত দিয়ে আমদের প্রতি মুহূর্তে প্রমাণ করতে হবে আমরা দেশ প্রেমিক।
রিয়াজ হক, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|